আপনার ডায়াল করা নম্বরটি আপাতত বিকল আছে—কোনও সাধারণ পরিষেবা নয়, অ্যাম্বুল্যান্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাতেও এমনটাই দস্তুর!
মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য অ্যাম্বুল্যান্স চেয়ে ‘১০২’-এ ডায়াল করে এই উত্তরই পাচ্ছেন মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দারা। হতাশ শহরবাসীর প্রশ্ন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবাকেও কি সচল রাখা যায় না! বাড়িতে মুমূর্ষু রোগীকে ফেলে রেখে কী অ্যাম্বুল্যান্সের খোঁজে দৌড়ে বেড়াতে হবে।
পশ্চিম মেদিনীপুরে কিন্তু নথিভুক্ত অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা খাতায় কলমে খুব একটা কম নয়। জেলায় ২৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ৮টি পুরসভা। স্বাভাবিক ভাবেই গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরসভা মিলিয়ে একটি করে হলেও ৩০০টি অ্যাম্বুল্যান্স প্রয়োজন। জেলা পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, পশ্চিমে মোট অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। প্রায় সাড়ে ৩০০। এর কোনওটি বিধায়কের বা সাংসদ তহবিল থেকে দেওয়া, কোনওটা রাজ্য সরকারের, আবার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে স্বাস্থ্য দফতরও পেয়েছে কিছু। কিন্তু, কাজের অ্যাম্বুল্যান্সের সংখ্যা বড় জোর একশো বা তার কিছু বেশি। তার মধ্যে আবার বেসরকারি নার্সিংহোমের আওতাধীন অ্যাম্বুল্যান্সগুলিই বেশি সক্রিয়। কারণ, সেগুলির ভাড়া বেশি। পাশাপাশি নিশ্চয় যান (নিখরচায় গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় বা প্রসবের পর মা ও সন্তানকে বাড়ি পৌঁছে দেয়, বিনিময়ে টাকা দেয় সরকার) যা বিধায়ক, সাংসদ বা সরকারি ভাবে দেওয়া সেগুলির দেখা পাওয়া ভার। মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা সুনীল তুলশিয়ানের কথায়, “দাদা অসুস্থ হওয়ার সময় বুঝেছিলাম, অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া কত ঝক্কির। ১০২-এ ফোন করলে বিকল বলছে। শেষে পরিচিতদের ফোন করে নানা ঝক্কির পর বেসরকারি নার্সিংহোমের অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করি।”
কেন সার্বিক ভাবে কোনও স্থায়ী সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না? প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের তরফে চেষ্টা থাকেই। তারই অঙ্গ ছিল ১০২ ডায়াল। রেডক্রসের উপর সে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই নম্বরে ডায়াল করলেও নির্দিষ্ট জায়গায় অ্যাম্বুল্যান্স পৌঁছে যেত। কিন্তু, তাতেও নানা সমস্যা দেখা দিতে থাকে। অ্যাম্বুল্যান্সের মালিককে ফোন করলে তিনি জানিয়ে দিতেন, বাইরে ভাড়া নিয়ে গিয়েছেন। অবস্থা দেখে জিপিএসের মাধ্যমে অ্যাম্বুল্যান্সের গতিবিধিও জানার চেষ্টা করতে পরিকল্পনা নেওয়া হয়। যদিও তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট যায়। কারণ, তাতে কেউ রাজি হননি। কারণ, বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় চলা গাড়ি ‘নো প্রফিট, নো লস’-এ চালানোর কথা। সে ক্ষেত্রে কিলোমিটার প্রতি ৬ টাকা ভাড়া নির্ধারিত হয়েছিল। আর, নিশ্চয় যানের ক্ষেত্রে তা ছিল কিলোমিটার প্রতি ৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে কাউকে কলকাতা নিয়ে যেতে হলে বড় জোর আড়াই হাজার টাকা মিলবে। সেখানে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কম করে সাড়ে তিন হাজার টাকা ভাড়া নেয় অ্যাম্বুল্যান্স! জরুরি পরিষেবা হওয়ায় বাধ্য হয়েই মানুষ বেশি টাকা দিয়েই ভাড়া গুনতে বাধ্য হন।
এ ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ ভাবেও ভাড়া খাটে অ্যাম্বুল্যান্সগুলি। ঘাটালের এক ব্যক্তির কথায়, “সন্ধের পর হঠাৎ মেদিনীপুর আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। অ্যাম্বুল্যান্সেই চলে এলাম। অ্যাম্বুল্যান্স দেখলেই সকলে পথ ছেড়ে দেয়। ফলে দ্রুত পৌঁছে গেলাম। না হয়, ২০০ টাকা বেশি ভাড়া গুনতে হল।” আবার যে সব সংস্থা বিধায়ক বা সাংসদ তহবিলের টাকায় অ্যাম্বুল্যান্স নিয়েছে, সেই সব সংস্থার পদাধিকারীরা নিজেই যাতায়াত করেন অ্যাম্বুল্যান্সেই। কেননা, সে ক্ষেত্রে দ্রুত আসার পাশাপাশি খরচও কম পড়ে। কিন্তু সেই সময় যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন! ভুক্তভোগী এক শহরবাসীর অভিজ্ঞতা, “তখন ফোন করলেই চালক বলবেন, অন্য ভাড়ায় আছি।”
আবার, কিছু সংস্থা অ্যাম্বুল্যান্স নেওয়ার পর ব্যবসা করে গিয়েছে বলেও অভিযোগ। ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণও করেনি। ফলে, তা নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে। পরিবহণ দফতরের কর্তাদের অভিমত, এই সব বিষয়গুলি ধরার জন্যই জিপিএস এ ট্র্যাক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। আর মিথ্যে বলা যাবে না বুঝেই, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে সকলেই। তারপর আর প্রশাসন বা স্বাস্থ্য দফতর, কেউই বেশি দূর এগোয়নি।
অথচ, এই সব অ্যাম্বুল্যান্সগুলি সরকারি টাকাতেই কেনা। এমনকী লাভ না করার প্রতিশ্রুতিতে নেওয়ার জন্য গাড়ি রেজিস্ট্রেশনেও টাকা লাগে না। তা হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবার ক্ষেত্রেও কেন সরকারি অর্থের নয়ছয় করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কারও কাছ থেকেই কোনও সদুত্তর মেলেনি।