এনসেফ্যালাইটিসের চিকিৎসা হাসপাতালের মেঝেতেই। বুধবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
গত বছরের বিপর্যয় থেকে কার্যত কোনও শিক্ষাই নেয়নি উত্তরবঙ্গ।
জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম (এইএস)-এর উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রক্ত ও দেহরস দ্রুত পরীক্ষা করার জন্য গত বছর সেখানকার জেলা হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামো তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। এ বছর ফের ওই রোগ হানা দেওয়ার পরে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ জেলা হাসপাতালেই সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা উঠে গিয়েছে!
কোথাও কিট নেই। আবার কোথাও কিট থাকলেও তা ব্যবহার করতে জানেন, এমন কর্মী নেই। এর ফলে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রক্ত ও দেহরসের নমুনা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হচ্ছে। সেখানে পরীক্ষার রিপোর্ট তৈরির পরে তা জেলায় পৌঁছতে চার-পাঁচ দিন লেগে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, যে-সব রোগীর রক্তপরীক্ষা দরকার বলে মনে করা হচ্ছে, তাঁদের সোজা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ‘রেফার’ বা পাঠিয়ে দিয়েই হাত ঝেড়ে ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি হাসপাতালে এমন কিট রয়েছে, যেগুলির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার মুখে। সে-সব ক্ষেত্রেও চিকিৎসকেরা কোনও ঝুঁকি নিচ্ছেন না। যে-সব রোগীর শরীরে ওই রোগের উপসর্গ মিলছে, পত্রপাঠ তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
উত্তরবঙ্গে মে মাসে পাঁচ জন, জুনে দু’জন এবং জুলাইয়ে এ-পর্যন্ত দু’জন এইএস রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি একাধিক বার উত্তরবঙ্গে এসেছেন। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রভানু মঞ্চে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ারের মতো জেলা প্রশাসনের আধিকারিক নিয়ে বিভিন্ন দফতরের কাজকর্মের পর্যালোচনাও করেছেন। স্বাস্থ্যকর্তারাও সেখানে ছিলেন। অথচ এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতি নিয়ে সেই সব বৈঠকে কোনও কথাই হয়নি বলে জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। গত বার মুখ্যমন্ত্রীকে ঠিক সময়ে এই খিঁচুনি-জ্বরের খবর না-দেওয়ায় বেশ কয়েক জন স্বাস্থ্যকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
এ বার আগেভাগে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতাকে রোগ সংক্রমণের কথা জানানো হল না কেন?
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, স্বাস্থ্য দফতরে নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানো হচ্ছে। গত বছর সংক্রমণের পর থেকে মুখ্যমন্ত্রী স্বাস্থ্যকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠকে বসেছেন। বয়স্কদের প্রতিষেধক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ‘‘পরিস্থিতির উপরে নজর রাখতে ইতিমধ্যেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমি দু’দফায় বৈঠক করেছি। চিকিৎসা পরিষেবায় যাতে কোনও সমস্যা না-হয়, সে-দিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে,’’ বললেন গৌতমবাবু।
কিন্তু কিট-সহ নানা সরঞ্জামের কী ব্যবস্থা হবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। রায়গঞ্জ, আলিপুরদুয়ার, শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে ওই রোগ পরীক্ষার কিট নেই। কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালে কিট আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। অথচ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ সূত্রে জানা গেল, মঙ্গলবার সেখানে ২৮ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। জলপাইগুড়ি, মালবাজার, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার থেকে ওই সমস্ত নমুনা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি কয়েক জন রোগীর রক্তের নমুনাও ছিল। এই অবস্থায় কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার রায়গঞ্জের মতো প্রত্যন্ত এলাকার রোগীদের রক্ত পরীক্ষা রিপোর্ট পেয়ে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হচ্ছে। রোগীর শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে পাঠানো হচ্ছে। আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন তাই উঠছেই।
রাজ্যের স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান তথা রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য জানান, জলপাইগুড়ি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। তাঁদের জেলা হাসপাতালে কিট রয়েছে বলেই জানিয়েছেন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের সুপার পার্থ দে, কোচবিহার জেলা হাসপাতালের সুপার জয়দেব বর্মনেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের কাছে যে-কিট আছে, তাতে সমস্যা হবে না। ‘‘বেশ কিছু হাসপাতালে এনসেফ্যালাইটিসের রক্তপরীক্ষার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকেও প্রয়োজনমতো কিট পাঠানো হয়। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা বিষয়টি দেখছেন,’’ আশ্বাস দিয়েছেন রুদ্রনাথবাবু।
রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালের সুপার অনুপ হাজরা জানান, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এনসেফ্যালাইটিসের রক্ত পরীক্ষা করার মতো পরিকাঠামোই নেই। তাই রোগীদের রক্তের নমুনা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার রেজাউল মীনা, শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের সুপার অমিতাভ মণ্ডলেরাও জানান, তাঁদের হাসপাতালে কিট নেই, পরীক্ষা হচ্ছে না। মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কিট নেই বলে জানান স্বাস্থ্য আধিকারিক মহম্মদ আব্দুল রশিদ। তিনি জানান, এখনও সে-ভাবে রোগী আসেনি।