মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো গড়ার ব্যাপারে গড়িমসি চলছিল এত দিন। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র কড়া মনোভাবে শেষ বেলায় হুঁশ ফিরেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের।
এমসিআই ৮০০ আসনে ছাঁটাইয়ের খাঁড়া ঝুলিয়ে দেওয়ায় সোমবার স্বাস্থ্য ভবনে জরুরি বৈঠক ডেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পরিকাঠামো ঠিক করার অঙ্গীকার করেছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। কোথাও, কোনও তরফে সামান্য বিচ্যুতি হলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। যে-পদক্ষেপ অনেক আগেই করা উচিত ছিল, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরে তা করতে হল কেন, সেই প্রশ্ন উঠছে অবশ্য দফতরের অন্দরেই।
প্রশ্ন আরও আছে। পরিকাঠামো দ্রুত ঠিক করার কথা এখন বলা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু চলতি বছরের মধ্যে তা করে ফেলা কতটা সম্ভব? আজ, মঙ্গলবারেই মেডিক্যালে ভর্তির প্রথম কাউন্সেলিং শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে যেখানে যত পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে, সব তৈরি করে এমসিআই-কে দেখিয়ে বাতিল হওয়া আসনের জন্য অনুমতি পাওয়া কি সম্ভব?
“ইচ্ছা থাকলে মানুষ পারে না, এমন কিছু নেই। সবই সম্ভব,” জবাব স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে-র।
তা হলে সেই ইচ্ছা এত দিন দেখানো হয়নি কেন? এত দিন এমসিআই এতটা কড়াকড়ি করেনি বলেই কি বহু মেডিক্যাল কলেজে মাত্র অর্ধেক পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও নিশ্চিন্তে বসে ছিল স্বাস্থ্য দফতর?
স্বাস্থ্যসচিব বলেন, “আমি এত দিন বিষয়টি দেখার সুযোগ পাইনি। সবে ছ’-সাত মাস হল দায়িত্বে এসেছি। এখন ফাঁকগুলি বুঝে তা পূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
এ দিন স্বাস্থ্য ভবনের বৈঠকে সব মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষেরা হাজির ছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা কী ভাবে করা সম্ভব, সেই বিষয়ে তাঁদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। অধিকাংশই প্রায় এক বাক্যে জানান, পরিকাঠামোগত সাহায্য না-পেলে তাঁদের পক্ষে এই দায় বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। বহু ক্ষেত্রেই তাঁরা অসহায়। কারণ, একটা কলেজ সুষ্ঠু ভাবে চালাতে গেলে ঠিক কী কী তাঁদের প্রয়োজন, সেটা জানানো সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ কান দেননি। পরিস্থিতি একটা সময়ে উত্তপ্তও হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্যকর্তারা তাঁদের ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতির মোকাবিলা করার পরামর্শ দেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, পরিকাঠামো নির্মাণে তাঁরা এ বার সব রকম সাহায্য পাবেন। যে-ভাবেই হোক, চলতি বছরের মধ্যে নিজেদের ১০০ শতাংশ প্রস্তুত করে ফেলতে হবে।
কী ভাবে তা সম্ভব?
রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কর্মী-সমস্যার বিষয়টি দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে প্রয়োজনীয় নিয়োগের কাজ শুরু হচ্ছে। এমসিআই-এর মূল আপত্তি ছিল নির্মাণকাজ নিয়ে। যেখানে দ্রুত তা করা সম্ভব নয়, সেখানে ‘প্রি-ফেব্রিকেটেড স্ট্রাকচার’ (তৈরি কাঠামো) বসিয়ে দেওয়া হবে।”
সেটা কী রকম?
সুশান্তবাবু জানান, কোথাও লেকচার থিয়েটার ছোট। সেটা প্রায় দ্বিগুণ বড় করতে হবে। কোথাও পুরনো গ্রন্থাগার ভেঙে নতুন গ্রন্থাগার তৈরির ফরমান জারি করেছে এমসিআই। রাতারাতি তো এ-সব গড়ে তোলা যাবে না। তাই ‘প্রি-ফেব্রিকেটেড স্ট্রাকচার’-এর ব্যবস্থা।
মালদহ, মুর্শিদাবাদ, সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে নির্মাণ নিয়ে বড় সমস্যা ছিল। সুশান্তবাবুর কথায়, “পুরনো ঠিকাদার সংস্থা তিন বছর ধরে আমাদের ঝুলিয়ে রেখে সর্বনাশ করে গিয়েছে। এ বার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নতুন সংস্থাকে। ডিসেম্বরের মধ্যে তারা কাজ শেষ করে দেবে।”
স্বাস্থ্যকর্তাদেরই একাংশ অবশ্য এই নিয়ে আত্মসমালোচনা শুরু করেছেন। এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “আরও আগে থেকে সাবধান হলে এমন পরিস্থিতি তৈরিই হতো না।”
সুশান্তবাবু অবশ্য এই অনুযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “আমরা ধাপে ধাপে পরিকাঠামো গড়ার কথা জানিয়েছিলাম। সেটাই হচ্ছিল। কোনও পরিকাঠামোই এমন ছিল না, যার জন্য ছাত্র ভর্তি বন্ধ করে দিতে হবে। এখন অন্যান্য কাজ বাকি রেখে তড়িঘড়ি শুধু এ দিকেই মন দিতে হচ্ছে। এটাও কিন্তু কাম্য নয়।”
এই অবস্থায় প্রথম কাউন্সেলিংয়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও এমসিআই যদি আরও কিছু আসন ফেরত না-দেয়, কেন্দ্র ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে বলে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন। সে-ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী এমসিআই-কে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য ফের সংশ্লিষ্ট কলেজগুলিতে পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বলতে পারেন। আবার কেন্দ্র নিজেরাই এমসিআই-এর ওই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আসন ফেরত দিতে পারে বা এমসিআই-কে আসন ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে রাজি করাতে পারে।
সবই সম্ভাবনার কথা। এই মুহূর্তে কিন্তু সবটাই অনিশ্চিত।