পরিদর্শনে এসে পরিকাঠামোর হাল দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মেডিক্যাল কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়ার (এমসিআই) প্রতিনিধিরা। কিন্তু খোলনলচে বদলানোর মতো সময় নেই হাতে। এ বছরই এমসিআই-এর অনুমোদন পেতে তাই নজিরবিহীন ভাবে একটি মহকুমা হাসপাতালকে তড়িঘড়ি একটি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হিসেবে ঘোষণা করে দেওয়া হল।
সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো দেখে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এমসিআই-এর প্রতিনিধিরা। অ্যাকাডেমিক ভবন হয়নি, হয়নি নিজস্ব হাসপাতাল। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, মর্গ নেই, ফলে ছাত্রছাত্রীরা ময়না-তদন্ত শিখতে পারছে না। ফিরে গিয়ে তাঁরা চিঠি দিয়ে ওই মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষে ছাত্রভর্তি বন্ধের সুপারিশ করেন।
তাতেই দিশেহারা দশা হয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের। স্বাস্থ্যকর্তারা নিজেরাই স্বীকার করেন, ১০০ আসনের এই মেডিক্যাল কলেজে এত কাজ বাকি যে সব সম্পূর্ণ করতে গেলে অন্তত এ বছর আর এমসিআই-এর অনুমোদন পাওয়া যাবে না। তখনই বিকল্প পথ অনুসন্ধান শুরু হয়। শেষে গত ২১ এপ্রিল রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর থেকে একটি নির্দেশ জারি করে ব্যারাকপুর বি এন বসু মহকুমা হাসপাতালকে কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস করার কথা জানানো হয়। বি এন বসু হাসপাতালকে তা হলে এ বার থেকে মেডিক্যাল কলেজ হিসেবেই গণ্য করা হবে কি না, বা সেখানে মেডিক্যাল কলেজের মতো পরিষেবাই পাওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে অবশ্য স্বাস্থ্যকর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। অথচ তাঁরা জানিয়েছেন, ওই মহকুমা হাসপাতালের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মেডিক্যাল অফিসারদের এ বার থেকে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের পূর্ণ সময়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর হিসেবে কাজ করতে হবে। সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও পঠনপাঠনের কাজে ওই মহকুমা হাসপাতাল ও তার মর্গ ব্যবহার করবেন।
কিন্তু এই ঘোষণা এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যার উত্তর স্বাস্থ্যকর্তারা দিতে পারছেন না। যেমন, মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা হেলথ্ সার্ভিস অর্থাৎ স্বাস্থ্য অধিকর্তার অধীন আর মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা মেডিক্যাল এডুকেশন অর্থাৎ স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার অধীন। তা হলে,বি এন বসু হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরেরা এ বার থেকে কার অধীনে চাকরি করবেন? মেডিক্যাল কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসর এবং অন্য হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরদের বেতন ভিন্ন। তাঁরা কি এ বার থেকে সমান বেতন পাবেন? বি এন বসুর অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোফেসরেরা কি মেডিক্যাল কলেজের নিয়মানুযায়ী চার বছর বাদে অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর হয়ে যাবেন?
এই সব প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “কিছুই ঠিক হয়নি। সকলের আগে এমসিআই-এর থেকে সাগর দত্তে ছাত্রভর্তির অনুমোদন আদায় করতে হবে, তার পরে বাকি সব ভাবব।” তাঁর আরও বক্তব্য, “সকলেই স্বাস্থ্য দফতরের অন্তর্গত চিকিৎসক। যাঁকে যেখানে দরকার, সে ভাবে আমরা ব্যবহার করব। ডিসেম্বরের মধ্যে সাগর দত্তের পরিকাঠামো তৈরি হয়ে যাবে, তখন আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।” তখন কি তা হলে এই দ্বিতীয় ক্যাম্পাস আর থাকবে না? এ ব্যাপারে অবশ্য নিরুত্তর থেকেছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।
সবচেয়ে বেশি সমস্যা তৈরি হয়েছে বি এন বসুর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মেডিক্যাল অফিসারদের নিয়ে। ২৫২ শয্যার এই মহকুমা হাসপাতালে বরাবরই রোগীর বিপুল চাপ। সাকুল্যে ৩০ জন চিকিৎসক আউটডোর ও ইনডোর সামলাতে হিমসিম খান। এর পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি রয়েছে এমন প্রায় ১০ জন মেডিক্যাল অফিসারকে যদি সাগর দত্তের পূর্ণ সময়ের শিক্ষক হিসেবে তুলে নেওয়া হয়, তা হলে পরিষেবা কী ভাবে চলবে বুঝতে পারছেন না হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। অন্য দিকে, যাঁদের ছাত্র পড়ানোর কোনও অভিজ্ঞতাই নেই, তাঁরা কী ভাবে পড়াবেন, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে।
যা শুনে সুশান্তবাবু বলেছেন, “সাগর দত্তে এখন ৯৮ জন ডাক্তার আছেন। দরকার ১১৩ জন। বি এন বসু থেকে ১০ জনকে নিয়ে আসতে পারলে সমস্যা প্রায় মিটে যাবে। সেটাই আমাদের কাছে এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ। বি এন বসুর পরিষেবা চালানো নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। সব সামলে দেওয়া হবে।”