দোষটা এত দিন চাপানো হচ্ছিল প্রধানত মশার ঘাড়েই। তার পরে বিজ্ঞানীদের একাংশ বললেন, শুয়োর এবং কাক-চড়ুইয়ের মতো পাখির শরীরেও এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু বাসা বাঁধে। আর এ বার দিল্লি ও পুণের জীবাণুবিজ্ঞানীদের মনে হচ্ছে, দূষিত জলে থাকা ‘এন্টেরো ভাইরাস’ শরীরে ঢুকে মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও যে-সব রোগীর রক্তে কোনও জীবাণুর সন্ধান মেলেনি, তাঁদের রোগটা যে আসলে কী, নিশ্চিত ভাবে তা জানাতে পারেননি ভিন্ রাজ্যের ওই জীবাণুবিজ্ঞানীরা। উত্তরবঙ্গ ঘুরে তাঁদের ধারণা, জলও ওই রোগের অন্যতম বাহক। বৃহস্পতিবার জলপাইগুড়ি ছাড়ার আগে তাঁরা জেলা স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের পরামর্শ দেন, সংক্রমিত এলাকা থেকে জলের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পুণের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে পাঠান। সেখানে জল পরীক্ষা করে দেখা হবে, তাতে সত্যিই কোনও জীবাণু আছে কি না।
এ বার যে-রোগটি দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে প্রথমে জ্বর হচ্ছে। তার পরে হাতে-পায়ে ব্যথা। আর খুব তাড়াতাড়ি অবস্থার অবনতি হয়ে শুরু হচ্ছে খিঁচুনি। এক বার খিঁচুনি ধরলে রোগীর অবস্থা চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মৃত্যুও হচ্ছে। এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ মূলত এগুলোই। অথচ ওই সব রোগীর বেশির ভাগের রক্তের নমুনায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মেলেনি। ফলে রোগ শনাক্তই হয়নি। আর জীবাণু শনাক্ত না-হওয়া রোগীর সংখ্যাই তুলনায় বেশি। জটিলতা তৈরি হচ্ছে তাঁদের নিয়েই। দিল্লি ও পুণের বিজ্ঞানীরা তিন দিন ধরে সংক্রমিত এলাকা ঘুরেও সেই জটিলতা খুব একটা কাটাতে পারেননি। তাঁরা আপাতত আক্রান্ত এলাকায় পরিস্রুত জল সরবরাহের উপরে জোর দিতে বলেছেন জেলা প্রশাসনকে। তাঁদের আরও পরামর্শ, যেখানে পরিস্রুত জল পাওয়া যাবে না, জল ফুটিয়ে পান করার জন্য সেই সব এলাকায় লাগাতার প্রচার চালাতে হবে।
পুণে-দিল্লির বিজ্ঞানীদের পরামর্শ দ্রুত রূপায়ণের জন্য এ দিন দুপুরেই উদ্যোগী হয়েছে জেলা প্রশাসন। বিজ্ঞানীরা জেলা ছাড়ার পরেই জেলার স্বাস্থ্য আধিকারিকেরা জনস্বাস্থ্য কারিগরি, কৃষি ও সেচ দফতর, চা-বণিকসভা, সর্বশিক্ষা মিশন এবং ব্লক স্বাস্থ্য অফিসারদের নিয়ে সদর হাসপাতালে আলোচনায় বসেন। বিজ্ঞানীদের পরামর্শ কী ভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, বৈঠকে তা নিয়ে আলোচনা হয়। জলপাইগুড়ি থেকে বিজ্ঞানীরা যান শিলিগুড়িতে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগ, শিশু বিভাগ ঘুরে দেখেন তাঁরা। রক্তের নমুনা, সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ) সংগ্রহ করেন। দলের অন্যতম বিজ্ঞানী যোগেশ গৌরব বলেন, “জলবাহিত জীবাণু, নাকি মশাবাহিত ভাইরাস এই উপদ্রবের মূলে, সেটা আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। জলবাহিত জীবাণুও দায়ী হতে পারে। সেই জন্যই মলমূত্রের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।”
দিল্লি ও পুণের বিজ্ঞানীরা রাজ্যের প্রতিনিধিদের কী কী জানালেন?
জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ সরকার জানান, জীবাণুবিজ্ঞানীরা বলেছেন, দূষিত জলে থাকা এন্টেরো ভাইরাস সংক্রমণের ফলে ‘অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম’ দেখা দিচ্ছে। তাঁরা সংক্রমিত এলাকার জলের নমুনা সংগ্রহ করে মুম্বইয়ে ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির পরীক্ষাগারে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন। “তাড়াতাড়ি জলের নমুনা পাঠানো হবে,” বললেন জগন্নাথবাবু।
‘অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম’ নিয়ে যে-সব রোগী আসছেন, তাঁরা মূলত প্রাপ্তবয়স্ক বলে জানান জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই রোগ প্রতিরোধের টিকা রয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তেমন কিছুই নেই। তাঁদের ক্ষেত্রে কী করণীয়, জীবাণুবিজ্ঞানীদের কাছে চিকিৎসকেরা তা জানতে চান। জগন্নাথবাবু বলেন, “বিজ্ঞানীরা ফিরে গিয়ে আলোচনা করে এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা পাঠাবেন।” স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য কলকাতায় বলেন, “জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের রোগী ছাড়াও যাঁদের এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে জলবাহিত ভাইরাস দায়ী বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। অন্য কোনও ভাইরাস আছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
রোগের উৎস ও নিদান নিয়ে জল্পনার মধ্যে মৃত্যুস্রোত অব্যাহত। বুধবার বিকেল থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে জানুয়ারি থেকে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে এখনও পর্যন্ত ১১৯ জনের মৃত্যু হল। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মারা গিয়েছেন অন্তত ২৩ জন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া। তাঁর অভিযোগ, উত্তরবঙ্গে ওই রোগের চিকিৎসা-পরিকাঠামোর অভাব গুরুতর। কলকাতার স্বাস্থ্য ভবনেও সংশ্লিষ্ট বিভাগে লোকজন এত কম যে, পরিস্থিতির উপরে নজরদারি শিথিল হয়ে পড়েছে। চিকিৎসক মানসবাবুর অভিযোগ, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এখনও সংক্রমিত এলাকায় গিয়ে উঠতে পারেননি। স্বাস্থ্য অধিকর্তাও কাজের কাজ কিছু করতে পারেননি। মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই স্বাস্থ্য দফতর। তিনি প্রায়ই উত্তরবঙ্গ যান। “এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজে সেখানে যান এবং স্বাস্থ্য দফতরকে নির্দেশ দেন, চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ দু’টো দিকই উপকৃত হবে,” আশা মানসবাবুর।