গত বছর খিঁচুনি-জ্বরের দাপটের সময় গোলমাল বেধেছিল তথ্য নিয়েই। আর সেই তথ্য-বিভ্রাটের জেরেই অন্তত তিন স্বাস্থ্যকর্তার ঘাড়ে নেমে এসেছিল শাস্তির খাঁড়া। কিন্তু তা থেকে প্রশাসন যে কোনও শিক্ষা নেয়নি, তার প্রমাণ মিলছে এ বারেও।
উত্তরবঙ্গের যে-সব এলাকায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল, সেখানে এ বার ওই রোগ ফের সংক্রমিত হচ্ছে কি না, সেই ব্যাপারে কোনও তথ্যই এত দিন সংগ্রহ করেনি স্বাস্থ্য দফতর। কিছু কিছু এলাকায় সম্প্রতি বয়স্কদের এনসেফ্যালাইটিস প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল। (টিকা-ভ্যাকসিন, বডি-ট্যাবলেট দু’ভাবেই এই প্রতিষেধক দেওয়া হয়ে থাকে।) তা সত্ত্বেও সেখানে এ বার খিঁচুনি-জ্বর হানা দেওয়ায় এই গাফিলতির বিষয়টি চিকিৎসকদের একাংশের নজরে এসেছে। এই ব্যাপারে স্বাস্থ্য দফতরের কাছে কোনও তথ্য না-থাকায় সেই সব প্রতিষেধকে আদৌ কাজ হচ্ছে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর বৃহস্পতিবার নির্দেশিকা জারি করে জানিয়ে দিয়েছে, যেখানে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে কেউ আসবেন, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীর প্রথম কাজ হবে, সেই ব্যক্তি প্রতিষেধক নিয়েছেন কি না, তা নথিভুক্ত করা। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার নির্মল বেরা জানান, এ ব্যাপারে সরকারি তরফে এত দিন কোনও নির্দেশিকা ছিল না। এ দিন এনসেফ্যালাইটিসের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে চিকিৎসক, গবেষক এবং চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে আলোচনায় জানা যায়, যে-সব এলাকায় প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকেও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছেন। ‘‘কিন্তু কে কে প্রতিষেধক নিয়েছেন, সেই নথি সংগ্রহ করা হচ্ছে না। তার পরেই ঠিক হয়েছে, এনসেফ্যালাইটিস রোগে আক্রান্ত বা ওই জ্বরের উপসর্গ নিয়ে কেউ হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে এলেই তিনি প্রতিষেধক নিয়েছিলেন কি না, সেই নথি রাখতে হবে,’’ বললেন নির্মলবাবু।
অল্পবয়সিদের মধ্যে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই)-এর প্রতিষেধক দেওয়ার কর্মসূচি চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। তবে এ বারেই প্রথম বয়স্কদের প্রতিষেধক দেওয়া হয়। উত্তরবঙ্গের আটটি ব্লকে ১০ লক্ষ বয়স্ক বাসিন্দাকে এই প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে আলিপুরদুয়ার এক ও দু’নম্বর ব্লক, কালচিনি ও ফালাকাটা, জলপাইগুড়ির মালবাজার ও নাগরাকাটা, শিলিগুড়ির মাটিগাড়া ও নকশালবাড়ি ব্লক। প্রতিষেধক দেওয়া সত্ত্বেও আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, নাগরাকাটা, নকশালবাড়ির মতো ব্লক থেকে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছেন। কেউ কেউ মারাও গিয়েছেন। তাঁরা প্রতিষেধক নিয়েছিলেন কি না, জানানো হয়নি।
উত্তরবঙ্গে জেই-র সংক্রমণ কিন্তু থেমে নেই। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সূত্রের খবর, বুধবার ২৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল তার মধ্যে আটটিতে জেই-র জীবাণু মিলেছে। এবং সেই আটটির মধ্যে চারটি নমুনা জলপাইগুড়ির বাসিন্দাদের। বাকিগুলির মধ্যে কোচবিহার, অসম, আলিপুরদুয়ার ও বাগডোগরার এক জন করে রোগী আছেন। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সমীর ঘোষরায় রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে বিষয়টি জানিয়েছেন। রোগীরা প্রতিষেধক নিয়েছিলেন কি না, তা নথিভুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত বছর উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ আকার নিয়েছিল জেই এবং অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম বা এইএসের সংক্রমণ। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৬০ জন মারা যান উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালেই। তাঁদের মধ্যে জেই-তে মৃত্যু হয় ৩৬ জনের। বাকিদের রোগের জীবাণু চিহ্নিতই করা যায়নি। ওই রোগের নাম দেওয়া হয়েছিল এইএস। এ বছর জেই এবং এইএস ফের হানা দিয়েছে। মে থেকে ৮ জুলাই দুপুর পর্যন্ত মারা গিয়েছেন ন’জন। তাঁদের মধ্যে তিন জন জেই-তে আক্রান্ত। এইএস নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ভর্তি আছেন অন্তত ১৪ জন। শিলিগুড়ির কলেজপাড়ার একটি নার্সিংহোম থেকে জেই-আক্রান্ত এক মহিলাকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে নিয়ে আসেন পরিবারের লোকেরা। রাজগঞ্জের বাসিন্দা ওই মহিলার নাম জ্যোৎস্না রায়। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরির রিপোর্টে তাঁর জেই হয়েছে বলে লেখা থাকলেও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে আবার ওই মহিলার রক্ত পরীক্ষা করে তা যাচাই করা হবে।