লোহার কাঠামের উপরে দশ ফুট বাই ছ’ফুটের বিজ্ঞাপনটার দিকে চোখ যাবেই‘চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে আসুন’। কিন্তু সেই পরামর্শ মেনে পিছনেই থাকা ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ঢুকলে দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। কেননা, ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে পরিষেবায় শেষের সারিতে রয়েছে এই হাসপাতাল। পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ এবং চিকিৎসকের অভাবে হাসপাতালটাই ধুঁকছে। রোগীকে অন্যত্র ‘রেফার’ করে দেওয়াই যেন দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে জানা নেই রোগী বা তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের। পরিকাঠামো এবং পরিষেবার মেলবন্ধন ঘটাতে যে তিনি হিমশিম খান, তা মেনে নিয়েছেন সুপার স্বাগতেন্দ্রনারায়ণ বসু। উত্তর ২৪ পরগনার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্য জানিয়েছেন, ওই হাসপাতালের বেশ কিছু সমস্যার কথা ইতিমধ্যেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তবে, সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি।
কল-কারখানায় ঘেরা এই এলাকায় মূলত গরিব মানুষেরাই চিকিৎসার জন্য ভাটপাড়া স্টেট জেনারেলের দ্বারস্থ হন। তা ছাড়া, শ্যামনগর, নোয়াপাড়া এবং নৈহাটির বেশ কিছু এলাকার মানুষও এই হাসপাতালের উপরে নির্ভরশীল। স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ম অনুযায়ী, স্টেট জেনারেল মর্যাদার হাসপাতাল থেকে মাসে পাঁচ শতাংশ রোগীকে ‘রেফার’ করা যায়। তা-ও নির্দিষ্ট কোনও জটিল রোগ বা চিকিৎসার সরঞ্জাম না থাকলে তবেই। কিন্তু ভাটপাড়া স্টেট জেনারেলের তথ্যই বলছে, এখানে ‘রেফার’-এর পরিসংখ্যান কখনও কখন ৮০ শতাংশও ছাড়িয়ে যায়। চিকিৎসকদের অনেকেই পরিকাঠামোর দোহাই দিয়ে হাসপাতালে সময় দেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে রোগীদের।
কেন এমন হয়?
হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মীদের একাংশের মতে, এখানে ‘নেই’-এর তালিকাটা দীর্ঘ। শল্য চিকিৎসকের অভাবে বড় কোনও অস্ত্রোপচার তো হয়ই না, বন্ধ্যাকরণের জন্য আসা রোগীদেরও ‘রেফার’ করা হয়। দু’জন অ্যানাস্থেটিস্টের এক জন বদলির মুখে। একমাত্র স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞও সম্প্রতি স্বেচ্ছাবসরের আবেদন জানিয়েছিলেন। জরুরি চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদেরও চিকিৎসা হয় জোড়াতালি দিয়ে। নেই অর্থোপেডিক। ফলে, হাড়ের চিকিৎসা হয় না। হাত-পা ভেঙে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে কোনও রকমে ‘ড্রেসিং’ করেই তাঁকে ‘রেফার’ করে দেওয়া হয়। অন্তত এক জন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ থাকার কথা থাকলেও নেই। নেই মেডিসিনের চিকিৎসকও। প্যাথলজিস্ট মাত্র এক জন। ব্লাডব্যাঙ্ক নেই। রেডিওলজিস্টও নেই। ফলে, রেডিওলজি বিভাগের দামি যন্ত্র পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ৬৫ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর মধ্যে এখন আছেন মাত্র ১৫ জন। তাঁরাও নিয়মিত আসেন না।
রোগীদের অনেকেরই অভিযোগ, হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন বেশির ভাগ সময়েই মেলে না। ফলে, বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় বাইরে থেকে। মুনাফা লোটে হাসপাতাল সংলগ্ন কিছু ওষুধের দোকান। এমনকী, হাসপাতালের কোনও অ্যাম্বুল্যান্সও নেই। কাউকে ‘রেফার’ করা হলে বেশি ভাড়া দিয়ে বাইরের অ্যাম্বুল্যান্সের উপরেই ভরসা করতে হয় রোগীর আত্মীয়স্বজনকে।
এই পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালের সুপার বলেন, “প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করতে করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। নিজেও চিকিৎসা করছি। কিন্তু রোগীরা কি সে সব মানতে চান? স্বাস্থ্য দফতরকে সবই জানিয়েছি।” ব্যারাকপুরের মহকুমাশাসক পূর্ণেন্দু মাজি বলেন, “পরিকাঠামোগত সমস্যার রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। চেষ্টা করছি, স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে কথা বলে সেটা মেটানোর।”
কিন্তু যতটুকু পরিকাঠামো আছে, সেটুকুও কি ঠিকমতো ব্যবহার করা হয়? রোগীদের এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।