রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশ দিয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমের নতুন অনুমোদন কিংবা লাইসেন্স নবীকরণ এ বার অনলাইনে করতে হবে। নতুন বছরের চলতি মাস থেকে তা কার্যকর করতে হবে বলেও নির্দেশ এসেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। এমন নির্দেশ জেনে কার্যত দিশাহারা নার্সিংহোম মালিকেরা। তাঁরা বলছেন, এ বার না নার্সিংহোমের ঝাঁপ ফেলতে হয়! জেলা স্বাস্থ্য দফতরের অবশ্য বক্তব্য, স্বাস্থ্য পরিষেবায় দুর্নীতি দূর করে স্বচ্ছ করতেই এই উদ্যোগ।
নার্সিংহোম মালিক সংগঠনের পক্ষে ঘাটালের অনুপ চক্রবর্তী, প্রদীপ বেরাদের বক্তব্য, সরকারের বিভিন্ন অফিসে ছুটে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে জুতোর সুখতলা উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়! নির্ধারিত ফি, প্রয়োজনীয় নথি দিলেও কোনও না কোনও ত্রুটি দেখিয়ে শংসাপত্র না দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অনলাইনের জন্য প্রয়োজনীয় নানা নথি এত দ্রুত জোগার হবে কী ভাবে, প্রশ্ন তাঁদের।
নতুন নিয়মে নার্সিংহোমের অনুমোদন পেতে গেলে এক জন আরএমও (রেসিডেন্সিয়াল মেডিক্যাল অফিসার), পাঁচ শয্যা পিছু এক জন করে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নার্স (পশ্চিমবঙ্গ নার্সিং কাউন্সিলে নাম নথিভুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক), ওটি রুমে সব রকমের প্রয়োজনীয় জিনিস ও পর্যাপ্ত জায়গা, পরিবেশ, দমকল এবং পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ছাড়পত্র সংক্রান্ত একাধিক নথি সংগ্রহ করে অনলাইনে জমা দিতে হবে। আর সেখানেই তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, নতুন নিয়মে যত চিকিত্সক, নার্স প্রয়োজন তত সংখ্যক লোক কি জেলার আদৌ আছেন!
ফলে তাঁদের সংশয়, সব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানতে গেলে ছোট, মাঝারি অধিকাংশ নার্সিংহোমই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাতে সাধারণ মানুষের চিকিত্সা পরিষেবা পেতে বিড়ম্বনা বাড়বে। প্রদীপবাবুর কথায়, “সরকারি নিয়ম অবশ্যই মানব। কিন্তু লাইসেন্সের জন্য সরকারের বিভিন্ন দফতর থেকে যে কাগজপত্র প্রয়োজন, তা পেতে যেন অযথা হয়রানির শিকার না হতে হয়। অন্য দিকগুলিও যেন বিবেচনা করা হয়।”
স্বাস্থ্য দফতরের অবশ্য বক্তব্য, এই নিয়ম চালু হলে সকলেই ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিস্টমেন্ট অ্যাক্ট’ মানতে বাধ্য হবেন। আইনের তোয়াক্কা না করে কেউ অবৈধ ভাবে ব্যবসা করতে পারবেন না। নিয়ম মেনে হাসপাতাল চললে আখেরে লাভ হবে সাধারণ মানুষেরই।
তবে নার্সিংহোমগুলির বিরুদ্ধেও পাল্টা বহু অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের। কেমন? দফতরেরই কিছু কর্মী একান্তে মানছেন, জেলা স্বাস্থ্য দফতরেরই একাংশের মদতে সরকারি বহু নিয়মের তোয়াক্কা না করেই দিব্য চলছে কিছু নার্সিংহোম। জেলায় মোট ১১৩টি নার্সিংহোম ও হাসপাতাল রয়েছে। তার অধিকাংশই যার মধ্যে পড়ে বলে অভিযোগ। কেমন ভাবে চলে ফাঁকি?
ওই সূত্রের দাবি, ব্যাপারটা অনেকটা একই কুমির ছানাকে বারবার তুলে দেখানোর মতো। কেমন? খাতায় কলমে আরএমও, নার্স প্রভৃতি যথাযথই থাকে। কিন্তু, তাঁদের দেখা মেলে না নার্সিংহোমে। অভিযোগ, একাংশ চিকিত্সক কিংবা নার্স অর্থের বিনিময়ে একাধিক নাসির্ংহোমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। আরও অভিযোগ, বিপুল টাকার বিনিময়ে এ সব দেখেও দেখে না স্বাস্থ্য দফতর। মাঝে মধ্যে অভিযানে বের হলেও আগাম খবর দিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
ফলে ওই দিন হাসপাতাল বা নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক কিংবা নার্সদের খবর দিয়ে আনিয়ে নেন। আর ‘রুটিন’ কর্তব্য সেরে ফিরে যায় স্বাস্থ্য দফতরও! এমনটাই রীতি বলে মানছেন জেলা স্বাস্থ্য দফতরের একাংশ কর্মীই। অভিযোগ মানতে চাননি জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক। তাঁর দাবি, “অভিযানে ত্রুটি ধরা পড়লেই সংশ্লিষ্ট নার্সিংহোম মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, নজিরও রয়েছে।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরিশচন্দ্র বেরা জানান, নতুন বছরের চলতি মাস থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতেও নতুন নিয়ম জারি হচ্ছে। লাইসেন্স, নবীকরণের মতো বিষয়গুলি শুধুমাত্র অনলাইনের মাধ্যমেই গ্রাহ্য হবে। প্রয়োজনীয় কোনও তথ্য বাদ পড়লে অনুমতি আটকে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, “নতুন নির্দেশ প্রসঙ্গে বেসরকারি হাসপাতাল, নার্সিংহোমের মালিকদের নিয়ে একটি ওয়ার্কশপও করা হয়েছে। সেখানে সব নিয়ম স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।”
অনলাইন ব্যবস্থা চালু হলে এক জন চিকিত্সক একটি নার্সিংহোমের সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ হতে পারবেন। সেই নথি রাখা থাকবে কম্পিউটারে। স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা থেকে সচিব সকলেই তা দেখতে পারবেন। ফলে কেউ অন্যায় করলেই ধরা পড়ে যাবেন। একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে প্রশিক্ষিত নার্সদের ক্ষেত্রেও।
তবে অনলাইন পরিষেবা চালু হওয়ার পর গ্যাস, কর আদায়-সহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি আটকানো গিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। তাঁদের আশা, বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমের নতুন অনুমোদন কিংবা লাইসেন্স নবীকরণে এমনটা চালু হলে দুর্নীতি রোধের পাশাপাশি পরিষেবার হালও ফিরবে।