চোখে সংক্রমণের অভিযোগ

বিনামূল্যে ছানি কাটিয়ে বিপাকে ১০ দিনমজুর, সংক্রমণের নালিশ

মাস দু’য়েক আগে ঝাড়গ্রামের এক বেসরকারি শিবিরে বিনামূল্যে চোখের ছানি কাটিয়ে বিপাকে পড়েছেন দশ দরিদ্র দিনমজুর। অপারেশনের পরে তাঁদের সকলেরই চোখে সংক্রমণ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের নামে রোগীদের থেকে টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ। টাকা না দিতে পারায় এক রোগীর সরকারি হেল্থ কার্ড আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০২:১০
Share:

মাস দু’য়েক আগে ঝাড়গ্রামের এক বেসরকারি শিবিরে বিনামূল্যে চোখের ছানি কাটিয়ে বিপাকে পড়েছেন দশ দরিদ্র দিনমজুর। অপারেশনের পরে তাঁদের সকলেরই চোখে সংক্রমণ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের নামে রোগীদের থেকে টাকাও নিয়েছেন বলে অভিযোগ।

Advertisement

টাকা না দিতে পারায় এক রোগীর সরকারি হেল্থ কার্ড আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ। রোগীদের দাবি, তাঁরা অস্ত্রোপচার করানো চোখে কার্যত কিছুই দেখতে পারছেন না। ওই শিবিরের আয়োজকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি, উপযুক্ত চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন মহলে লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই রোগীরা। জঙ্গলমহলে গরিব মানুষজনকে পরিষেবা দেওয়ার নামে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।

অভিযোগকারীরা পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুর-২ ব্লকের বেলিয়াবেড়া থানার চোরচিতা গ্রামের বাসিন্দা। তাঁদের বয়স পঞ্চাশ থেকে সত্তরোর্ধ্ব। অভিযোগ পেয়ে এই ঘটনার বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। দশ জনের মধ্যে নয় জনের চোখের গুরুতর সমস্যা রয়েছে বলে স্বীকার করে নিয়েছেন ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসকেরা। সোমবার ওই ১০ জন ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে দেখাতে আসেন। হাসপাতালের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রদীপকুমার ভূঁইয়া বলেন, “বেশির ভাগেরই চোখে সংক্রমণ রয়েছে। অবস্থা ভাল নয়। বিশেষজ্ঞের মতামতের জন্য ওদের মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে রেফার করেছি।” আজ, বুধবার ওই রোগীরা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে যাবেন।

Advertisement

বিষয়টি জানেন রাজ্যের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (চক্ষু) সিদ্ধার্থ নিয়োগীও। এ দিন তিনি বলেন, “ঘটনাটি শুনেছি। তবে পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি চলে যাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। কখনও কখনও অস্ত্রোপচারের পর স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে সময় লাগে।” তবে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে বলে তিনি জানান।

ষাটোর্ধ্ব মন্দাকিনী জানা, গেলমণি প্রামাণিক, বাণেশ্বর ঘোড়ই, মন্দাকিনী জানা, সুখদা দত্ত, সত্তরোর্ধ্ব অনিল শীট-দের অভিযোগ, “বিনামূল্যে শিবিরে অপারেশনের সুযোগ নিয়ে গিয়ে এখন পথে বসার জোগাড়। ঝাড়গ্রামের বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে চিকিৎসার প্রতিশ্রুতি দিয়েও পরবর্তী চিকিৎসার জন্য আমাদের কাছ থেকে নগদ কয়েক হাজার টাকা নিয়েছেন।” প্রবোধ নায়েক বলেন, “আমি টাকা দিতে না পারায় আমার সরকারি হেল্থ কার্ডটি ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আটকে রেখেছেন।”

পশ্চিম মেদিনীপুরের উপ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ প্রধান বলেন, “ওই রোগীদের চোখের অস্ত্রোপচারে গোলমাল হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। স্বাস্থ্য ভবনও বিষয়টি জানে। বিশেজ্ঞের মতামত নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে কলকাতায় বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হবে।”

বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালের চেয়ারম্যান ভবতোষ মণ্ডল বলেন, ‘‘১৯৯৭ সালে হাসপাতালটি চালু হয়। তার অনেক আগে থেকেই চক্ষুশিবিরের আয়োজন করে আসছি। গত চার দশকে প্রায় ৫০ হাজার জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। ব্যর্থতার ভাগ অতি সামান্য। হঠাৎ কেন এমন হল তা আমরাও খতিয়ে দেখছি।” রোগীদের থেকে কেন টাকা নেওয়া হয়েছে? আমতা আমতা করে ভবতোষবাবুর দাবি, “রোগীদের সম্মতি সাপেক্ষে দামি লেন্স লাগানোর জন্য কিছু টাকা নেওয়া হয়েছে।” যদিও সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, এমন শিবিরে সরকারি আনুদানে লেন্সের দামও ধরা থাকে বলে জানা গিয়েছে।

ঝাড়গ্রাম শহরের গাইঘাটা এলাকার ওই বেসরকারি চক্ষু হাসপাতালে মাঝে মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থানুকুল্যে শিবির করে চোখের অস্ত্রোপচার করা হয়। নিখরচায় অস্ত্রোপচারের জন্য আয়োজকেরা রোগী পিছু কেন্দ্রীয় প্রকল্পে টাকা পান। গত বছরের অক্টোবরে এমনই এক শিবিরে জেলার বিভিন্ন এলাকার ৩৭ জনের চক্ষু অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এর মধ্যে চোরচিতা গ্রামের দশজন-সহ ১৪ জন রোগীর অপারেশনের পরে চোখ ফুলে যায়। শুরু হয় তীব্র যন্ত্রণা। রোগীদের পরিজনেরা জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে লোক পাঠিয়ে নিখরচায় অস্ত্রোপচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২৭ অক্টোবর রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

অস্ত্রোপচারের পরে রোগীদের চোখে সমস্যা শুরু হয়। কিন্তু ওই অবস্থাতেই ২৯ অক্টোবর রোগীদের চোরচিতা গ্রামে পৌঁছে দেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অভিযোগ, রোগী পিছু রসিদে দেড় হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর পরিজনেরা যোগাযোগ করলে প্রথমে বিষয়টি লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। পরে অবশ্য ঝাড়গ্রামের ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই ওই রোগীদের কলকাতায় এক চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তত দিনে নয় রোগীর অস্ত্রোপচার করানো ডান অথবা বাম চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন বলে রোগীদের দাবি। কলকাতার হাসপাতালে ফের অস্ত্রোপচার করে তিন দিন চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

এরপর তাঁদের পর্যবেক্ষণের জন্য ফের ঝাড়গ্রাম চক্ষু হাসপাতালে সপ্তাহখানেক ভর্তি রাখেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু পরিস্থিতির কোনও উন্নতি না হওয়ায় গত ২২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য দফতরের বিভিন্ন মহলে ওই ৯ জন রোগীর তরফে অভিযোগ করেন স্থানীয় তেঁতুলিয়া গ্রামের যুবক তথা ‘চোরচিতা নদী ভাঙন বাঁচাও কমিটি’র সংগঠক পূর্ণেন্দুবিকাশ দত্ত। পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “নিরক্ষর ও অসহায় মানুষগুলি এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন দেখে এগিয়ে আসি। সরকারি হাসপাতালে গেলে হয়তো মানুষগুলিকে এভাবে সর্বস্বান্ত হতে হতো না। ওঁদের অজ্ঞতার সুযোগে বিনামূল্যে চিকিৎসার নামে টাকাও নিয়েছেন বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টির যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন