কৃষ্ণনগর জেলা সদর হাসপাতাল

মামলা-বন্দি মাতৃযান, বিপাকে প্রসূতিরা

কনকনে শীতের সন্ধ্যা নেমে আসছে তাড়াতাড়ি। সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে কাঁথা কাপড়ে জড়িয়ে হাসপাতাল চত্বরে একটা গাছের নীচে বসে কাঁপছিলেন সোমা মণ্ডল। নবজাত সন্তানকে নিয়ে ফিরবেন করিমপুরে। কৃষ্ণনগর জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলেছিল সকাল ১১ টায়। কিন্তু মেলেনি মাতৃযানের দেখা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০১
Share:

জেলা সদর হাসপাতালে মাতৃযানের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় মায়েরা।—নিজস্ব চিত্র।

কনকনে শীতের সন্ধ্যা নেমে আসছে তাড়াতাড়ি। সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে কাঁথা কাপড়ে জড়িয়ে হাসপাতাল চত্বরে একটা গাছের নীচে বসে কাঁপছিলেন সোমা মণ্ডল। নবজাত সন্তানকে নিয়ে ফিরবেন করিমপুরে। কৃষ্ণনগর জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ছুটি মিলেছিল সকাল ১১ টায়। কিন্তু মেলেনি মাতৃযানের দেখা।

Advertisement

সোমাদেবী একা নন। গোটা সদর হাসপাতালের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, একই ভাবে বাচ্চা কোলে নিয়ে মাতৃযানের অপেক্ষা করছেন নতুন মায়েরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁদের কেউ যাবেন তেহট্টের গেপীনাথপুর আবার কেউ ফিরবেন হোগলবেড়িয়া তো আবার কেউ কালীগঞ্জ-দেবগ্রাম তো কেউ কৃষ্ণনগরের কাছেই ভীমপুরের জলকর-মথুরাপুরে।

কেউ অপেক্ষা করছেন মাতৃযান আসার, আবার কেউ অপেক্ষা করছেন তাঁর এলাকার কোনও প্রসূতির যদি ছুটি হয়, সেই জন্য। কারণ মাতৃযান একই এলাকার প্রসূতিদের একসঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। সংখ্যা যে পর্যাপ্ত নয়।

Advertisement

২০১১ সাল থেকে প্রসূতিদের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার বদলে মাতৃযানের ব্যবস্থা করে রাজ্য সরকার। প্রসূতিদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ও প্রসবের পরে তাঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মাতৃযান প্রকল্পের সূচনা। যার সমস্ত ব্যয় বহন করে স্বাস্থ্য দফতর। সেই মতো জেলা সদর হাসপাতালে ছ’টি মাতৃযান রয়েছে। কিন্তু ওই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন প্রসূতিকে রিলিজ করা হয়। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় মাতৃযান অপ্রতুল হয়ে পড়ে।

বিশেষ করে দূরের প্রসূতিদের ক্ষেত্রে সমস্যা প্রবল। কোন প্রসূতিকে কলকাতার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজন হলে মাতৃযানের ফিরতে অনেকটা সময় লেগে যায়। অথবা জেলার প্রত্যন্ত করিমপুর বা ওই রকম কোনও দূর এলাকায় প্রসূতিকে পৌঁছে দেওয়ার দরকার হলে পরিস্থিতি আরও করুণ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে বসে থাকা অন্য রোগীরা সেদিনের মতো মাতৃযানের আশা ত্যাগ করেন। তখন বাধ্য হয়েই অনেকে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফেরেন। শনিবারই তেমনটা করতে বাধ্য হলেন দেবগ্রামের বাসিন্দা ফুলটুসি বিবির পরিবার।

সকালে ছুটি পেয়ে বিকেল ৪ টে পর্যন্ত অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ৮৫০ টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করলেন ফুলটুসির স্বামী হরফ শেখ। হরফ বলেন, “বহুবার ১০২ নম্বরে ফোন করেছি। প্রতিবারই বলা হয়েছে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। কিন্তু পাঁচ ঘণ্টা পরেও গাড়ি পাইনি।” সাধ্যের বাইরে গিয়ে গাড়ি ভাড়া করেছেন হরফ শেখ। তিনি বলেন, “আমি দিন মজুর, এত টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করা প্রায় অসম্ভব। তবু ছেলেটার কথা ভেবে করতেই হল।”

কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? হাসপাতালের কর্মী, নার্স, চিকিত্‌সক থেকে সুপার পর্যন্ত সকলেই মেনে নিচ্ছেন গাফিলতির কথা। তাঁরা সকলেই স্বীকার করছেন মাত্র ছ’টি মাতৃযানে এত রোগী সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। সেই সঙ্গে রয়েছে মামলা। উঠে আসছে মাতৃযান চালকদের বিরুদ্ধে নান অভিযোগের কথাও।

হাসপাতালের এক কর্তা বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনও রোগী হয়ত করিমপুরে যাবেন, তাঁকে হয়ত সকালেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ওই এলাকার আরও প্রসূতি না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ সেই প্রসূতিকে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। চোখের সামনে এসব দেখেও কিছু বলতে পারছি না। কারণ গাড়ির সংখ্যাটা একেবারেই কম। বেশ কয়েকজনকে একসঙ্গে নিয়ে যাওয়া না হলে অনেক প্রসূতি যে বাড়িতেই পৌঁছাতে পারবেন না।”

অথচ সরকারি নিয়ম কিন্তু একবারে একজন প্রসূতিকেই বহন করার। কিন্তু রোগীর পরিবারের অভিযোগ পৌঁছে দেওয়ার পর বখশিসের নাম করে মোটা টাকা আদায় করে নেন মাতৃযান চালকেরা। আবার ফাঁকা গাড়ি নিয়ে বসে থেকেও ‘দূরে রোগী নিয়ে এসেছি’ এড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগও উঠেছে। শুধু যে রোগীর পরিবারের অভিযোগ তা নয়। অভিযোগ করছেন খোদ হাসপাতালের চিকিত্‌সকরাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাসপাতাল কর্তা বলেন, “কোনও মাতৃযান যদি একসঙ্গে চার জন প্রসূতিকে বহন করে তাহলেও তারা চারবার ‘ভাউচার’ কাটিয়ে নেয়। এক জায়গায় একবার গিয়ে চার জন রোগীর নাম করে চারবার টাকা নেয়। এই ভাবে প্রতিদিন বিরাট পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে সরকারের। আবার পরিষেবা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।”

হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রী হালদারও একই কথা বলেন, “আসলে মাতৃযানের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আর সেই কারনেই একদিনে একটু বেশি সংখ্যক প্রসূতিকে ছুটি দিলে মাতৃযানের অভাব দেখা দেয়।’’

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন মাতৃযানের অভাব দেখা দেবে? মাতৃযানের সংখ্যার কোনও ঊর্দ্ধসীমা নেই। তার উপরে হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে ৩০টি পর্যন্ত মাতৃযান রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাহলে কেন ছ’টির বেশি মাতৃযান রাখা হচ্ছে না জেলা সদর হাসপাতালে?

হিমাদ্রীবাবু জানান মাতৃযানের জন্য গাড়ির নোটিশ দেওয়া হয়েছিল আগেই। সেই মতো চারটি গাড়ির মালিক আবেদন করে নাম নথিভূক্তও করেছিলেন। কিন্তু এখন যে সব মাতৃযান চলছে, তার মালিকরা আদালতে মামলা করেছেন। ফলে নিয়োগ পদ্ধতি বন্ধ রাখতে হয়েছে।

জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন ঠিক উল্টো কথা, “আমরা বারবার করে চেয়েছি মাতৃযানের সংখ্যা বাড়াতে। কিন্তু গাড়ি পাচ্ছি না।” তবে তিনি স্বীকার করে নেন, “মাতৃযান নিয়ে আমরাও নানান অভিযোগ পেয়েছে। কড়া ব্যবস্থাও নিতে শুরু করেছি। বিশেষ করে একবার গাড়ি চালিয়ে একাধিক ভাউচারে টাকা তোলার বিষয়টি বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ সেই মাতৃযান মালিকরা কী বলছেন? সদর হাসপাতালের এক মাতৃযানের মালিক সমীর ঘোষ বলেন, “আমারা কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করি সঠিক পরিষেবা দিতে। হয়ত কখনও কখনও সামান্য সমস্যা হয়। কিন্তু আমাদের আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি নেই।”

কিন্তু তারা কেন মাতৃযানের সংখ্যা বাড়তে দিচ্ছেন না? ঠিক কী কারণে আদালতের দারস্থ হয়েছেন? সমীরবাবুর উত্তর, “আসলে আমরাও তো ব্যবসা করতে এসেছি। যদি মাতৃযানের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে তো আমাদের পেটে টান পড়বে। এমনিতেই আমরা খুব সামান্য লাভে গাড়ি চালাই।”

তবে বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। জেলাশাসক পিবি সালিম বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি সদর হাসপাতালে মাতৃযানের সংখ্যা বাড়াতে। আশা করছি কিছু দিনের মধ্যে এই সমস্যা আর থাকবে না। প্রযোজনে মাতৃযানে জিপিএস সিস্টেম লাগিয়ে দেওয়া হবে। তাহলেই বেশ কিছুটা কম করা যাবে অহেতুক রোগী ফেরানোর প্রবণতা।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন