মারণ রোগে স্বর স্তব্ধ, সাড় উধাও হাতে-পায়ে

বিএসসি পাশ করে বছর দেড়েক বসেই ছিলেন। তার পরে মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি পান পিন্টু সেন। কিন্তু জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের ধাক্কায় দিনহাটার প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকা কোরেশারহাটের বাসিন্দা পিন্টুর পেশাগত জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ওই ব্যাধি তাঁর গলার স্বর কেড়ে নিয়েছে। ১৬ জুলাই খিঁচুনি আর জ্বর নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাঁর কথা বলা বন্ধ। এক মাসের চিকিৎসায় প্রাণটুকু রক্ষা পেলেও স্বর ফেরেনি ওই শিক্ষকের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৩৩
Share:

কথা বলতে পারছে না ইটাহারের রবিউল ইসলাম।

বিএসসি পাশ করে বছর দেড়েক বসেই ছিলেন। তার পরে মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকরি পান পিন্টু সেন। কিন্তু জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের ধাক্কায় দিনহাটার প্রত্যন্ত সীমান্ত এলাকা কোরেশারহাটের বাসিন্দা পিন্টুর পেশাগত জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ওই ব্যাধি তাঁর গলার স্বর কেড়ে নিয়েছে। ১৬ জুলাই খিঁচুনি আর জ্বর নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাঁর কথা বলা বন্ধ। এক মাসের চিকিৎসায় প্রাণটুকু রক্ষা পেলেও স্বর ফেরেনি ওই শিক্ষকের।

Advertisement

গলার স্বর নয়, দু’পায়ের সাড় হারিয়েছে কালচিনির মেচপাড়া টি গার্ডেনের কিশোরী খুশবু মঙ্গর। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত ১২ বছরের মেয়েটিকে ১৫ দিন আইসিইউ-এ রাখার পরে জুলাইয়ের শেষ দিকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয়। কিন্তু তার দু’টি পা এখনও অসাড়। বাড়ির লোকেরা বুঝে উঠতে পারছেন না, মেয়ে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না।

১৬ বছরের ভিক্টর রায়ের গলার স্বর এবং হাত-পায়ের সাড় দু’টোই হরণ করেছে ওই মারণ রোগ। এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছে ওই কিশোর। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে পিন্টুর মতো ভিক্টরও কথা বলতে পারছে না। অসাড় হয়ে গিয়েছে তার হাত-পা। বাড়িতেই শুয়ে থাকতে হচ্ছে আমবাড়ি ফালাকাটা হাইস্কুলের ওই ছাত্রকে। আর-পাঁচটা ছেলেমেয়ের মতো ভিক্টর আর কোনও দিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে কি? স্পষ্ট উত্তর জানা নেই উত্তরবঙ্গ মেডিক্যল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। সেখানে আট দিন চিকিৎসা করার পরে ওই কিশোরকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। ভিক্টরের বাবা ভবেশ্বর রায় চাষ-আবাদ করেন। “চিকিৎসকেরা বললেন, তাঁদের যেটুকু চিকিৎসা করার করে দিয়েছেন। এ বার যা করার বাড়িতেই করতে হবে,” বললেন ভবেশ্বরবাবু।

Advertisement

জটেশ্বরের-১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা প্রভাতচন্দ্র রায়ের বাঁ হাত এবং পা অসাড় হয়ে গিয়েছে ওই রোগের থাবায়। ৬৭ বছর বয়সেও তিনি বাড়ির গাছে উঠে সুপুরি পাড়তেন। চাষ-আবাদ করতেন। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস তাঁকে কর্মহীন করে দিয়েছে।

জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের কবলে পড়ে ইটাহারের শিশু রবিউলেরও মুখের কথা হারিয়ে গিয়েছে। চিকিৎসায় জীবন ফিরে পেলেও তার বাক্-প্রতিবন্ধকতা কোনও দিন নিরাময় হবে কি না, বলতে পারছেন না চিকিৎসকেরা।

শুধু প্রাণহানি নয়। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই), অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম (এইএস) রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু মানুষের জীবনে প্রতিবন্ধকতা ডেকে এনেছে এ ভাবেই। ওই রোগে আক্রান্ত অনেকে নানা ভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন কেন?

পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী জানান, এনসেফ্যালাইটিসে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই পঙ্গুত্বের ভয় থাকে। বিভিন্ন স্নায়ু নষ্ট হয়ে যায়। তার অনেকটাই আর পরে ঠিক হয় না। “ওই রোগে শরীরের যে-কোনও প্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে। কথা বলা বা শোনার ক্ষমতাও চলে যেতে পারে,” বলছেন অমিতাভবাবু।

কিন্তু এই কালান্তক ব্যাধিতে যাঁরা প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ভাবে এখনও কোনও ব্যবস্থাই চালু হয়নি। ফলে রোগী হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেও তাঁদের নিয়ে বিপাকে পড়ছেন পরিবারের লোকেরা। ওই রোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার দাবি তুলেছেন দার্জিলিঙের সাংসদ সুরিন্দর সিংহ অহলুওয়ালিয়া। তাঁর যুক্তি, ওই রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে স্বাস্থ্য আধিকারিকদের গাফিলতি ছিল বলে তাঁদের সাসপেন্ড করা হয়েছে। আর খোদ সরকারের গাফিলতিতে ওই রোগে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। “প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে যাঁরা বাড়ি যাচ্ছেন, রাজ্য সরকারের উচিত তাঁদের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, ক্ষতিপূরণ দেওয়া,” বলছেন অহলুওয়ালিয়া।

কী বলছে রাজ্য সরকার? মেডিক্যাল কলেজে ওই সব রোগীকে রেখে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব। তিনি বলেন, “দ্রুত ওই কেন্দ্র খোলার চেষ্টা চলছে। সেখানে চিকিৎসার পরে যাঁদের সমস্যা থেকে যাবে, তাঁদের বিষয়টিও ভাবা হবে।” সেই ভাবনাটা কী রকম, পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসার পরেও প্রতিবন্ধকতা থেকে গেলে কী ভাবে সেই সব রোগীকে সাহায্য করা হবে, তা অবশ্য জানাননি মন্ত্রী।

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর আশ্বাস, উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ চিকিৎসা কেন্দ্র না-খোলা পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ এবং মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের ফিজিওথেরাপি বিভাগে রোগীদের চিকিৎসা হবে। সেই জন্য ওই দুই মেডিক্যালেই ফিজিওথেরাপি বিভাগকে আরও জোরদার করা হচ্ছে। নিয়োগ করা হচ্ছে নতুন ফিজিওথেরাপিস্টও। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালের বিশেষজ্ঞেরা জানান, এই রোগের চিকিৎসা নেই। আক্রান্তদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উপসর্গ-ভিত্তিক চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে মাত্র। সোমবারেও মালদহের কালিয়াচক এবং পুরুলিয়ায় দু’জনের এইএস ধরা পড়েছে। তবে মৃত্যুর খবর নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন