এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত ছেলে। কান্না মায়ের। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
• মৃত্যুর আগে পরিজনদের ১৬ দিন সময় দিয়েছিলেন মালবাজারের গজলডোবার ১৮ বছরের কমল দেবনাথ। ৪ জুলাই মাঠ থেকে ফেরার পরে তাঁর জ্বর হয়েছিল। পরের দিন জলপাইগুড়ির রায়কতপাড়ার নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। জ্বর না-কমায় ৯ জুলাই পাঠানো হয় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ২০ তারিখে সেখানেই মারা যান কমল। হাসপাতাল বলছে, তিনি অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিনড্রোম নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন।
• ধূপগুড়ির টামটিমারি গ্রামের ৬০ বছরের কৃষ্ণকান্ত অধিকারী জ্বর হওয়ার পরে পাঁচ দিন সময় দিয়েছিলেন চিকিৎসকদের। ১১ জুলাই রাতে তাঁর জ্বর হয়। পরের দিন শুরু হয় খিঁচুনি ও বমি। হাতুড়ে চিকিৎসকের ওষুধ খাওয়ানো হয়। ১৩ জুলাই জ্বর কিছুটা কমে। ১৪ জুলাই ফের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। ১৬ জলাই তাঁকে উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্তপরীক্ষা হয় বেসরকারি ক্লিনিকে। মালেরিয়ার জীবাণু মেলেনি। রাতে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। যথাযথ রক্তপরীক্ষা না-হওয়ায় কীসে মৃত্যু হল, জানতে পারেনি তাঁর পরিবার।
• ২৭ বছরের দিনমজুর বিনোদ রায়ের বাড়ি মালবাজারের দক্ষিণ হাঁসখালি গ্রামে। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাঁর গা ম্যাজম্যাজের উপসর্গ দেখা দেয়। ২০ জুলাই জ্বর বাড়ায় ক্রান্তির উত্তর সারিপাকুড়ি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে প্যারাসিটামল পেয়েছিলেন। রক্ত পরীক্ষা করাতে জলপাইগুড়ি কিংবা মেডিক্যালে যেতে বলা হয়। কিন্তু সেখান থেকে মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না তাঁর। রাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বিনোদবাবু। ২১ জুলাই মারা যান। মালবাজার হাসপাতাল জানায়, বিনোদবাবুরও এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ ছিল।
কমল, কৃষ্ণকান্ত, বিনোদের মতো মেটেলির সোমা ওরাওঁ, ধূপগুড়ির রাজকান্ত রায়, কালচিনির প্রবীণ টোপ্পোরও মৃত্যু হয়েছে জ্বর এবং খিঁচুনির উপসর্গ নিয়ে। কিন্তু ওঁদেরও মৃত্যু হয়েছে যথাযথ চিকিৎসা না-পেয়ে। কারণ, ঠিক সময়ে রক্তপরীক্ষা না-হওয়ায় রোগটা কী, চিকিৎসকেরা তা বুঝতেই পারেননি। কমলের পরিজনদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, জ্বরে আক্রান্ত ওই রোগীর জন্য সব মিলিয়ে ৮০ টাকা হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দাদা বাদল দেবনাথের আক্ষেপ, “রোগটা ধরা পড়তেই অনেক দেরি হয়ে গেল। ভাইটাকে বাঁচাতে পারলাম না।” বিনোদবাবুর স্ত্রী পার্বতী, মা নতুবালারা বলেন, “আমরা কোনও দিন এনসেফ্যালাইটিসের নাম শুনিনি। কেউ আমাদের বলেওনি।” বিনোদবাবুর রক্তের নমুনা মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে। কবে রিপোর্ট মিলবে, জানেন না বাড়ির লোকেরা।
ধূপগুড়ির বাসিন্দা পিন্টু অধিকারী বুঝতেই পারেননি, সামান্য জ্বরে তাঁর বাবা নরেন্দ্রনাথ অধিকারীর মৃত্যু হবে। পিন্টুবাবু বলেন, “জ্বর হলে আমরা সাধারণত স্থানীয় চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে ভাল হয়ে যাই। তবে বাবার যে এনসেফ্যালাইটিস হয়েছিল, সেটা তাঁর মৃত্যুর আগে বুঝিনি। রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা জলপাইগুড়িতে থাকলে হয়তো বাবাকে বাঁচানো যেত।”
জাপানি এনসেফ্যালাইটিস এবং এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-যুক্ত জ্বরে উত্তরবঙ্গের মৃত্যু-মিছিলের জন্য দিল্লি ও পুণের বিজ্ঞানীরা রক্তপরীক্ষার পরিকাঠামোর অভাবের কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তার সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গ সফরের পরে সল্টলেকের স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারাও এখন ওই বিজ্ঞানীদের অভিযোগ অস্বীকার করতে পারছেন না।
পুণে ও দিল্লির বিজ্ঞানীরা আরও একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন উত্তরবঙ্গের স্বাস্থ্যকর্তাদের। তিন বছর ধরে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস উত্তরবঙ্গে হানা দিলেও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্বাস্থ্য দফতর যথাযথ ভাবে সচেতনতার প্রচার করেনি। যাঁরা জাপানি এনসেফ্যালাইটিস বা এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-যুক্ত রোগে মারা গিয়েছেন, তাঁদের অনেকের পরিবারই রোগটার কথাই যে শোনেননি, তা জানতে পেরে ভিন্ রাজ্যের বিজ্ঞানীরা হতবাক। রোগ সম্পর্কে সচেতনতা থাকলে এমনটা কখনওই হতো না বলে মন্তব্য করেছেন ওই দলের এক বিজ্ঞানী।
চোখের সামনে রোজই শিশু, কিশোর, যুবকদের মরতে দেখে ক্ষোভ সামলাতে পারছিলেন না জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের এক স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁর আক্ষেপ, মুখ্যমন্ত্রী জেলায় জেলায় সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলার কথা বলছেন। ওই টাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা জেলা হাসপাতালগুলিতে রোগ নির্ণয়ের যথাযথ পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে অনেকের প্রাণ বেঁচে যেত। “আমরা জানি, আমাদের এলাকা এনসেফ্যালাইটিস-প্রবণ। তার পরেও পরিকাঠানো তৈরি না-হওয়াটা সত্যিই দুঃখের,” বলেন ওই স্বাস্থ্যকর্মী।
উত্তরবঙ্গে মাত্র একটি জায়গায় এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে পাঁচ জেলার রক্তের নমুনা আসছে রোজই। নমুনার লাইন পড়ে গিয়েছে। রিপোর্ট পেতে লাগছে অন্তত তিন দিন। পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির এক বিজ্ঞানী বলেন, “এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে ওই তিন দিনেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে।”