লুপাসের সচেতনতায় এসএসকেএম-এর প্রয়াস

সাধারণ জ্বর আর র্যাশ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ভুগছিল ছ’বছরের সুকান্ত দাস। প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে যান সুকান্তর বাবা-মা। অসুখ তো কমলই না উপরন্তু নতুন নতুন সমস্যা হতে শুরু করল। চার বার মৃত সন্তান প্রসব করেন সৌমিত্রীদেবী। স্ত্রীরোগের চিকিৎসাতেও ফল মিলছিল না। বছর ৪১-এর সৌমিত্রীদেবীর হঠাৎই এক দিন চোখেও থ্রম্বোসিস হয়।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৪ ০২:৩৬
Share:

সাধারণ জ্বর আর র্যাশ নিয়ে কয়েক দিন ধরেই ভুগছিল ছ’বছরের সুকান্ত দাস। প্রথমে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে তাকে নিয়ে যান সুকান্তর বাবা-মা। অসুখ তো কমলই না উপরন্তু নতুন নতুন সমস্যা হতে শুরু করল।

Advertisement

চার বার মৃত সন্তান প্রসব করেন সৌমিত্রীদেবী। স্ত্রীরোগের চিকিৎসাতেও ফল মিলছিল না। বছর ৪১-এর সৌমিত্রীদেবীর হঠাৎই এক দিন চোখেও থ্রম্বোসিস হয়।

এঁরা আসলে সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমেটোসাস (এস এল ই) নামক এক ধরনের বাতের শিকার। ‘লুপাস’-এর সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব নয়। তবে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে সময়ে চিকিৎসা না হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে জানান চিকিৎসকেরা। সম্প্রতি বিশ্ব লুপাস দিবস উপলক্ষে এসএসকেএম-এর রিউম্যাটোলজি বিভাগে আয়োজিত এক আলোচনায় এ কথা শোনা গেল। প্রতি মঙ্গলবার এখানেই বসে লুপাস ক্লিনিক। ৬০ থেকে ৮০ জন রোগী আসেন ক্লিনিকে। গত সাত বছর ধরে প্রায় ৫০০ জন লুপাস রোগী ক্লিনিকে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে আসছেন। তাঁদের অনেকেই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন।

Advertisement

কোনও সংক্রমণ থেকে অথবা বংশগত কারণে এই রোগ হতে পারে। সাধারণ জ্বর দিয়েই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। জ্বর যদি না সারে এবং রক্ত পরীক্ষায় যদি লোহিত কণিকা কমে আসে তা হলে মূত্র পরীক্ষা করা হয়। যদি দেখা যায় মূত্রে প্রোটিন এবং লোহিত কণিকা বেশি তখন অ্যান্টি নিউক্লিয়ার ফ্যাক্টর (এএনএফ) পরীক্ষা করা হয়। এটিই অ্যান্টি নিউক্লিয়ার অ্যান্টিবডির পরীক্ষা। এই পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হলে অ্যান্টি ডবল স্ট্রান্ডেড ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। সেটি যদি বাড়ে তা হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে সি-থ্রি সি-ফোর পরীক্ষা হয়। এটি কম হলে শুরু হয় লুপাসের যাবতীয় চিকিৎসা।

চিকিৎসকরা জানালেন, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি। ১০-৫০ বছরের মধ্যে সাধারণত এই রোগ হানা দেয়। এই অসুখে শরীরের অ্যান্টিবডি বাইরের শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা ভুলে ধ্বংস করতে থাকে দেহ কোষের নিউক্লিয়াসকে। রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে সাধারণ জ্বর, র্যাশ, নানা গাঁটে ব্যথা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে লোপ পায় কর্মক্ষমতা। হাঁটা-চলা, কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়। চুল উঠে যায়। বিবাহিতাদের ক্ষেত্রে সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে সমস্যা হয়। মস্তিষ্কে সংক্রমণ হলে খিঁচুনি, কিডনিতে সংক্রমণ হলে পা ফুলে ওঠে, রক্তচাপ বেড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট এবং করোনারি আর্টারি ডিজিজ হয়। ফুসফুসে আক্রমণ হলে বুকে জল জমে যায়। চোখেও থ্রম্বোসিস হয়।

রোগী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে রোগীর মনের জোর বাড়ানোর জন্য সাত বছর আগে লুপাস ইনিসিয়েটিভ-এর জন্ম হয়। সম্প্রতি এর কাজের পরিধি আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। লুপাসের যাবতীয় রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে এসএসকেএম-এ। কিন্তু হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষার দীর্ঘ তালিকায় আটকে দেরি হয়ে যায় চিকিৎসায়। অনেকেই তাই বাইরের থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিতে বাধ্য হন। সেই সব ব্যয়বহুল রক্ত পরীক্ষা ও ওষুধ যাতে রোগীর সাধ্যের মধ্যে আনা যায় সেই জন্য কিছু পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনিসিয়েটিভ। এ ছাড়াও জেলাস্তরে এক জন আগ্রহী চিকিৎসককে রোগী ও লুপাস ক্লিনিকের যোগাযোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। যিনি রোগীর প্রয়োজনে লুপাস ইনিসিয়েটিভ গ্রুপের চিকিৎসদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে পারবেন। ফলে জেলাস্তরে রোগী প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শের সুযোগ পাবেন।

বিভাগের প্রধান চিকিৎসক অলোকেন্দু ঘোষ বলেন, “রোগ ধরা পড়ার পর থেকে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওষুধ খাওয়া ও কিছু রক্তপরীক্ষা করে যেতে হয়। তবেই প্রেশার, সুগার, বাতের মতো দীর্ঘমেয়াদী এই অসুখকে নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। রোগ যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় তখন কেমোথেরাপি এবং স্টেরয়েডের যথাযথ মাত্রা প্রয়োগ করে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় রোগীকে।” তিনি জানান, ঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে রোগী চূড়ান্ত অবস্থা থেকেও সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন