ট্রলির অভাবে বাইরের হাসপাতাল থেকে আসা রোগীদের হেঁটে যেতে হচ্ছে ওয়ার্ডে, শিলিগুড়িতে।
বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েই রবিবার সকালে বাসে চেপে জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে চলে আসেন দুলু সরকার। চিকিত্সকদের সঙ্গে কথা বলে ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রামে দেহ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা শুরু করেন। সে সময়ে মোবাইল ফোনে একটি ‘নির্দেশ’ পান দুলুবাবু। তাঁর অভিযোগ, গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা ‘নির্দেশে’ জানিয়ে দেন, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে মৃতের দেহে গ্রামে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাঁদের ধারণা, ‘গ্রামে সত্কার হলে দেহ থেকে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে’।
সেই ‘নির্দেশ’ পেয়ে আতঙ্কিত পেশায় দিনমজুর জলপাইগুড়ির কচুয়া বোয়ালমারি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান পাড়ার বাসিন্দা দুলুবাবু। আত্মীয়দের থেকে ধার করে জলপাইগুড়ি মাসকলাইবাড়ি শ্মশানে বাবার দেহ সত্কার করে গ্রামে ফিরে যান তিনি। শনিবার রাত দশটা নাগাদ জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে তাঁর বাবা শচীমোহন সরকারের (৭৫) মৃত্যু হয়। তার রক্তের পরীক্ষায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ধরা পড়ে। এর পরেই ওই ‘নির্দেশ’ দেওয়া হয় তাঁর ছেলে দুলুবাবুকে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, শচীমোহনবাবুও দিনমজুরের কাজ করতেন। গত ১২ দিন ধরে তিনি জ্বরে আক্রান্ত। প্রথমে তাঁকে হলদিবাড়ি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তাঁর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে পাঠানো হয়। তাতে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস জীবাণু মেলে। এর পরে গত ৩১ জুলাই জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে ‘রেফার’ করে দেওয়া শচীবাবুকে। শনিবার রাতে তাঁর মৃত্যু হলেও, পরিবার খবর পায় এ দিন সকালে।
জলপাইগুড়িতে জ্বরে আক্রান্ত শিশু।
দুলুবাবু বলেন, “কয়েকজন পড়শি গ্রামে দেহ নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে ফোনে নির্দেশ দেন। বাবার দেহ গ্রামে নিয়ে গেলে নাকি এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ ছড়াবে। কিন্তু ও ভাবে যে রোগ ছড়ায় না, তা বললেও তাঁরা মানেননি।” কে বা কারা ফোন করেন তা জানাতে চাননি দুলুবাবু। তাঁর স্ত্রী কান্তরানি দেবী বলেন, “অনেকে ফোন করেছে। ওঁদের নির্দেশ শোনার পরে কয়েক জন প্রতিবেশীকে ডেকে কিছু টাকা ধার করে জলপাইগুড়ি শ্মশানে শ্বশুরের দেহ দাহ করানো হয়।”
এনসেফ্যালাইটিস রোগ সংক্রমণ নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর সহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ব্যাপক প্রচার চালানোর নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু এ দিনের ঘটনা সত্যিই সেই প্রচার কতটা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল। জলপাইগুড়ির জেলা শাসক পৃথা সরকারের বক্তব্য, “ঘটনাটি শুনেছি। আর কোনও মন্তব্য করব না।”
সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রশাসনের সঙ্গে পুরসভা এবং গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির সচেতনতামূলক প্রচার করার কথা। যদিও এ দিনের বিষয়টি জানা নেই বলে এড়িয়ে গিয়েছেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তিরাও। সিপিএমের দখলে থাকা কচুয়া বোয়ালমারি পঞ্চায়েতের প্রধান মুক্তি সরকার দাবি করেন, “শচীমোহনবাবু কবে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, তাঁর কী রোগ হয়েছিল, তার কিছুই আমরা জানি না।” শচীমোহনবাবুর পাড়া প্রধানপাড়ার তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য অঞ্জলি রায় বলেন, “এমন কোনও ঘটনা জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।”
এলাকার এক বাসিন্দার রক্ত নমুনা পরীক্ষায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু মিলেছে জানার পরে কচুয়া বোয়ালমারি গ্রামের প্রধানপাড়ায় কোনও সরকারি প্রচার হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শাসক দলের কয়েকজন নেতাও। তৃণমূলের জেলা সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “প্রচার ঠিক মতো হলে এমন ঘটনা ঘটত না। মানুষ এখনও জানল না এনসেফ্যালাইটিস ছোঁয়াচে নয়।” তাঁর প্রশ্ন, “ভয়ে মৃতদেহ গ্রামে নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, এর পরেও বলতে হবে প্রচার চলছে? এটা চলতে পারে না। অনেক ফাঁক রয়েছে।” পরিস্থিতির কথা সবিস্তারে মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবেন বলে সৌরভবাবু জানিয়েছেন।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি নির্মল ঘোষ দস্তিদার বলেন, “যথেষ্ট সরকারি প্রচার যে হচ্ছে না, তা নিয়ে আগেই অভিযোগ জানানো হয়েছিল। রোগ প্রতিরোধে কোথাও যে কাজ হচ্ছে না, সেটা স্পষ্ট হল।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রকাশ মৃধা অবশ্য এ দিন দাবি করেন, “প্রচার চলছে। সোমবার ওই গ্রামে মেডিক্যাল টিম পাঠিয়ে বিশেষ প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে।” বামেদের দখলে থাকা জেলা পরিষদের সভাধিপতি সিপিএমের নুরজাহান বেগমের যুক্তি, “এদিনের ঘটনার পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” দুলুবাবুর আক্ষেপ, “মৃত্যুর পরে বাবার দেহ নিয়ে যেতে পারলাম না। এ দুঃখ কি মিটবে?”