স্তন ক্যানসারের আরোগ্যে নয়া দিশা এসএসকেএম-এ

‘স্নেহ’ শুধু অতি বিষম বস্তু নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও! স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় হাতেকলমে তার প্রমাণ দিলেন কলকাতার চিকিৎসকেরা। বহুদিন পর্যন্ত স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার অন্যতম ধাপ হিসেবে গোটা স্তনটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হত। ইদানীং তা না করে শুধু স্তনের টিউমারটি বাদ দেওয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকছেন চিকিৎসকেরা।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৪ ০২:৪৫
Share:

‘স্নেহ’ শুধু অতি বিষম বস্তু নয়, অত্যন্ত প্রয়োজনীয়ও! স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় হাতেকলমে তার প্রমাণ দিলেন কলকাতার চিকিৎসকেরা।

Advertisement

বহুদিন পর্যন্ত স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার অন্যতম ধাপ হিসেবে গোটা স্তনটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হত। ইদানীং তা না করে শুধু স্তনের টিউমারটি বাদ দেওয়ার দিকেই বেশি ঝুঁকছেন চিকিৎসকেরা। তাতে স্তনের একটা অংশ বাদ যায়, কিন্তু বাকিটা থাকে। শরীরের অন্য কোনও অংশ থেকে টিস্যু নিয়ে স্তনটিকে ফের পুরনো চেহারায় দেওয়ার ব্যবস্থা চলে। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এই প্রচলিত পদ্ধতি থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন। পেটের ভিতরে কোলনের গায়ে যে ফ্যাট থাকে (যার পোশাকি নাম ওমেন্টাম), তারই সাহায্য নিলেন স্তন পুনর্গঠনে।

স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা বছর চল্লিশের এক মহিলার স্তন পুনর্গঠিত হল ওই ওমেন্টামেরই সাহায্যে। আপাতত ওই মহিলা সম্পূর্ণ সুস্থ। এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন শহরের ক্যানসার চিকিৎসকেরা। তাঁদের বক্তব্য, এই বিকল্প পদ্ধতির আশ্রয় নিলে স্তনের পুনর্গঠন এবং তার পরে সংশ্লিষ্ট মহিলার সুস্থতা দুটোই যথেষ্ট দ্রুত হওয়া সম্ভব।

Advertisement

এসএসকেএম হাসপাতালের ব্রেস্ট ইউনিট বিভাগের চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকার এবং শুভ্র গঙ্গোপাধ্যায় এই অস্ত্রোপচারটি করেছেন। জেনারেল সার্জারি বিভাগের অধীনে হাসপাতালের বিশেষ ‘ব্রেস্ট ইউনিট’ গত কয়েক বছর ধরেই স্তনের ‘কনজার্ভেশন সার্জারি’ অর্থাৎ স্তন বাদ না দিয়ে ক্যানসার অস্ত্রোপচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওমেন্টামের ব্যবহার এই প্রথম। দীপ্তেন্দ্রবাবু বলেন, “জাপানে এই ধরনের কিছু অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেটা জানার পর থেকেই আমরা উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম।”

কী ভাবে হয়েছে ওই অস্ত্রোপচার? দীপ্তেন্দ্রবাবু জানান, প্রথমে ল্যাপারোস্কোপি করে কোলনের গায়ের ওই ফ্যাটের খানিকটা অংশ তুলে নেওয়া হয়েছে। তার পরে চামড়ার নীচ দিয়ে টানেল করে স্তনের যে অংশটি বাদ গিয়েছে, সেই অংশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। স্তনের টিউমার বাদ দেওয়ার অব্যবহিত পরেই এই অস্ত্রোপচারটি করা হয়েছে। তিনি জানান, অস্ত্রোপচারের চার ঘণ্টা পরে রোগিণী হাঁটতে পেরেছেন। আর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন।

চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শরীরের অন্য অংশ থেকে টিস্যু নিয়ে স্তন পুনর্গঠন করলে সেই অংশটি খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। ক্ষত সারতেও অনেকটা সময় লাগে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ওমেন্টাম ব্যবহার করলে সেই ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। চিকিৎসকদের বক্তব্য, সাধারণ ভাবে পিঠ বা পেটের মাসল নেওয়া হয় স্তন পুনর্গঠনে। পিঠ বা পেট থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা ও চওড়া করে কাটতে হয়। পিঠ থেকে কাটলে পিঠের মাসল দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আর পেট থেকে কাটলে হার্নিয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। প্রচণ্ড ব্যথাও হয়। সেরে উঠতে বহু দিন সময় লাগে।

আর এ ক্ষেত্রে? দীপ্তেন্দ্রবাবুর দাবি, “এটা তো মাইক্রোসার্জারি। প্রচলিত পদ্ধতির ক্ষেত্রে যতটা কাটতে হয়, এ ক্ষেত্রে তার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র কাটতে হয়েছে। স্তনের গ্রন্থির সঙ্গে ওই ফ্যাটটা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ওখানেই রক্তজালিকা তৈরি হবে এবং ওই ফ্যাট স্তনেরই একটা অংশ হয়ে উঠবে।”

ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “নকল স্তন অর্থাৎ প্রস্থেসিস-এর যা দাম, তাতে বহু মহিলারই তা নাগালের বাইরে। অন্য দিকে, পেট বা পিঠ থেকে মাসল কেটে নিয়ে স্তন তৈরি করলে ক্ষত অনেক বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে এই বিকল্প পদ্ধতিকে স্বাগত জানাচ্ছি। এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে যত বেশি অস্ত্রোপচার হবে, তত বিষয়টি ত্রুটিহীন হতে পারবে।”

সব ক্ষেত্রে কি এই পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়? ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েও বলেছেন, “সব ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সম্ভব নয়।” কেন? তাঁর ব্যাখ্যা, “ওমেন্টামে চামড়া থাকে না, শুধুই নরম টিস্যু। স্তনের টিউমার অস্ত্রোপচারের সময়ে বহু ক্ষেত্রে অনেক চামড়া বাদ যায়। সে ক্ষেত্রে স্তন পুনর্গঠনের সময়ে চামড়াও প্রয়োজন হয়। সেই ক্ষেত্রগুলিতে ওমেন্টাম দিয়ে স্তন পুনর্গঠন করা যাবে না। কিন্তু যে সব ক্ষেত্রে স্তন অস্ত্রোপচারের সময়ে চামড়ার কম অংশ বাদ যায়, সে সব ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া খুবই কার্যকরী।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন