প্রশাসক যখন চিকিৎসক। রামপুহাট হাসপাতালে তোলা নিজস্ব চিত্র।
ঘড়িতে তখন সকাল ৯টা ১৫। রামপুরহাট হাসপাতালে এক অবাঙালি ভদ্রলোক প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকের স্টেথো চেয়ে নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন জরুরি বিভাগে। সাধারণ মেডিসিন বিভাগে এক চিকিৎসকের সামনে খালি চেয়ার দেখে বসে পড়লেন। একের পর এক ডেকে নিলেন বর্হিবিভাগে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের।
সোমবার এ ভাবে হাসপাতাল যাঁকে চিকিৎসকের ভূমিকায় দেখে সবাই অবাক হলেন, তিনি আর কেউ নন— খোদ মহকুমাশাসক।
এ দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চিকিৎসক সঙ্কটে জর্জরিত রামপুরহাট হাসপাতালের রোগী দেখে এলেন ডাক্তারি পাশ করে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়া দক্ষিণ ভারতীয় উমাশঙ্কর এস। অবশ্য আগেই তিনি কথা দিয়েছিলেন, সুযোগ পেলে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে রোগীদের তিনি পরিষেবা দেবেন। এ দিন আক্ষরিক অর্থেই তিনি সেই কথা রাখলেন।
হাসপাতালে পা রেখেই মহকুমাশাসক চলে যান জরুরি বিভাগে। অস্পষ্ট বাংলায় রোগীদের ডেকে নেন। বাধা গ্রামের জীবন লেট ছিলেন লাইনের প্রথমে। মহকুমাশাসক তাঁকে পরীক্ষা করে বললেন, “এত দিন জ্বরে ভুগছেন, ডাক্তার দেখাননি কেন?” এর পরেই এক স্বাস্থ্যকর্মীকে ডেকে জীবনবাবুর রক্ত পরীক্ষা করানোর নির্দেশ দিয়ে পরের রোগীকে ডেকে নিলেন। পুরুষদের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ময়ূরেশ্বর থানার বেগুনিয়া গ্রামের সুশীল লেট। চোখের সামনে এ সব দেখে বলেই ফেললেন, “এসডিও রোগী দেখছেন, এমন কথা জন্মেও শুনিনি। ভগবান ওঁর মঙ্গল করুণ।” তাঁর আশা, আগামী দিনেও নিশ্চয় এসডিও এই হাসপাতালের রোগীদের পাশে এ ভাবেই দাঁড়াবেন। বস্তুত, যাঁরা উমাশঙ্করবাবুকে চেনেন না বা জানেন না, তাঁরা হাসপাতালে নতুন একজন চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন ভেবেছেন এ দিন। আর যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁরা স্টেথো গলায় আইএএস মহকুমাশাসককে চিকিৎসকের ভুমিকায় দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছেন!
হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসক যাঁরা, মহকুমাশাসকের পাশে বসে রোগী দেখলেন তাঁদেরও অভিজ্ঞতা, “কোনও মহকুমাশাসক বা প্রশাসনিক কর্তাকে চিকিৎসকের ভূমিকায় কখনও দেখিনি।” কী বলছেন উমাশঙ্করবাবু? তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর, “অধিগত শিক্ষাটা ভুলে যাব, সেই জন্য চর্চা রাখতে এই ভাবেই মাঝে মধ্যে সময় কাটাতে চাই।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, গত ১১ জুলাই রামপুরহাট মহকুমাশাসকের দায়িত্ব নেন উমাশঙ্করবাবু। এর আগে তিনি কোচবিহার জেলা প্রশাসনিক দফতরে কাজ করেছেন। তামিলনাডুর সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করার পরে এক সময় বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চিকিৎসক হিসাবে কাজে না করে নিজেকে একজন প্রশাসক হিসাবে তৈরি করেন। তাঁর নিজের ব্যাখ্যা, “আমি যদি চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতাম, তা হলে একমাত্র ওই কাজে ব্যস্ত থাকতে হত। এতে সমাজের অন্য কাজ করা থেকে বঞ্চিত থাকতাম। সেই জন্য আইএএস দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।”
মহকুমাশাসক হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে রামপুরহাটের সুপার স্পেশিলিটি হাসপাতালের ভিত পুজোর দিনই বিধায়ক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি জানিয়ে দেন, এক জন চিকিৎসক হিসাবে তিনি এলাকার মানুষের সেবার কাজ করতে চান। রামপুরহাট হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির সভায় উমাশঙ্করবাবু হাসপাতালের চিকিৎসক সঙ্কটের কথা জেনে সুপারের কাছেও ইচ্ছে প্রকাশ করেন, সপ্তাহে তিন দিন বর্হিবিভাগে চিকিৎসা করবেন।
এরপরই তাঁকে দেখা যায় রামপুরহাট হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শনে প্রশাসকের ভূমিকায়। হাসপাতালের ভিতর দালাল রাজ বন্ধ করতে, জরুরি বিভাগের সামনে অবৈধ ভাবে দাঁড় করানো গাড়ি সরাতে উদ্যোগ নেন। বেসরকারি অ্যাম্বুল্যান্সগুলিকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে হাসপাতালের রোগী সহায়তা কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও তিনি করেছেন।
হাসপাতালের শিশু রোগের চিকিৎসক কাজলকান্তি দাস বলেন, “উনি (মহকুমাশাসক) আমার সঙ্গে এআরএস ইঞ্জেকশন কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তাই নিয়ে আলোচনা করে সেই মতো প্রেসক্রিপশন করেছেন।” চিকিৎসক গৌতম ঘোষ জানান, চিকিৎসক জীবনে এক জন প্রশাসককে এই ভাবে কোনও দিন দেখেননি।
ঘড়িতে ১০ টা ৫০। জনা পঞ্চাশ রোগী দেখার পরে মহকুমাশাসক হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। যাওয়ার সময় বলে যান, “এখানেই নয়, সময় বের করে ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে গিয়েও রোগী দেখব।”