মৃণালদা বলেছিলেন সুচ সুতো প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছিল

হঠাৎই চলে গেলেন গীতা সেন। স্মৃতিতে ফিরলেন মমতাশঙ্কর গীতা বৌদি। নামটা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোল টিপ। সরু জমাটি পাড়ের পাট ভাঙা শাড়ি। সদা ব্যস্ত এক মহিলা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

গীতা বৌদি। নামটা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোল টিপ। সরু জমাটি পাড়ের পাট ভাঙা শাড়ি। সদা ব্যস্ত এক মহিলা।

Advertisement

কাজ যেন তাঁকে একটুও ছুটি দেয়নি। সে মৃণালদার এক তাড়া কাগজ গোছানোর দায়িত্ব হোক, বা়ড়ির হেঁসেলের দায়িত্ব হোক বা ছবিতে চরিত্র বেছে দেওয়ার কাজই হোক— সবখানে ছড়িয়ে থাকতেন তিনি।

বেশ কিছু দিন ধরে মানুষটা বিছানায়। থেকে থেকেই মনে হয়েছে, যাই এক বার গিয়ে দেখা করে আসি। গল্প করে আসি। সেই ৭০ সাল থেকে আমাদের আলাপ। মৃণালদা আর গীতা বৌদির বাড়ি যাওয়া মানে দু থেকে তিন ঘণ্টা হাতে নিয়ে যেতে হয়। এই এক ঘণ্টার জন্য গেলাম— এ রকম কখনও হয়নি। কাপের পর কাপ চা, কখনও মুড়ি মাখা। কুণালের বন্ধুরা, আমি, মিঠুন (চক্রবর্তী), ইউনিটের লোকজনরা আড্ডা দিতাম। বৌদি আর মৃণালদা পুরনো দিনের গল্প করতেন। বিশেষ করে আইপিটিআই-এর সময়কার গল্প। উৎপল দত্ত। তাপস সেন। ঋত্বিক ঘটক। সলিল চৌধুরী। এঁদের নাম উঠে আসত।

Advertisement

কতটুকুই বা বাড়ি ছিল তখন। প্রিয়া সিনেমার পাশে থাকতেন। তাতে কী! আমি, আমার দাদা (আনন্দশঙ্কর), মা (অমলাশঙ্কর), বিয়ের পর বাপিদা (চন্দ্রোদয় ঘোষ), দেখ-না-দেখ হাজির হয়ে যেতাম বৌদির কাছে। যেন মৃণালদা বা বৌদির অন্য কাউকে সময় দেওয়ার নেই। আমাদের জন্যই ওঁরা বসে থাকবেন আর নানান সব গল্প হবে। এতটুকু বিরক্ত হতে দেখিনি বৌদিকে। বিরক্তি, রাগ, হিংসা কোনও কিছুই স্থিতধী উজ্জ্বল চোখকে, মধুর হাসিকে ম্লান করতে পারেনি।

একবার মনে আছে, মৃণালদা গল্প করেছিলেন আমাদের। তাপস সেন মজা করে মৃণালদাকে বলেছিলেন ‘‘তুই এত বিদেশ যাস কখনও একটু দুষ্টুমি-়টুষ্টুমি করতে পারিস তো!’’

তো সে বার যখন মৃণালদা বিদেশ যাচ্ছেন, ঠিক গাড়িতে ওঠার সময় বৌদি হঠাৎ ওঁর হাতে সুচ-সুতো ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যদি বোতাম ছিঁড়ে যায় তার জন্য এটা দিলাম। একটু কষ্ট করে সেলাই করে নিয়ো।’’ মৃণালদা তার পর মজা করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘ওই সুচ আর সুতো আমার সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছিল।’’

মৃণালদা হয়তো একেবারে গড়পড়তা, গেরস্থালি গল্প নিয়ে চিত্রনাট্য লিখছেন। বৌদি হয়তো রান্নাঘরে। মৃণালদা জানতে চাইলেন ‘‘ভাতের ফ্যানটা ঠিক কী ভাবে গালে গো?’’ কিংবা ‘‘ওমুক চরিত্রের জন্য নতুন মুখ খুঁজছি। তোমার কাউকে মনে পড়ছে?’’

এতটাই ভরসা ছিল গীতা বৌদির ওপর। হবে নাই বা কেন! উনি নিজেও ছিলেন যে অসম্ভব ডাকসাইটে অভিনেত্রী। আজও মনে পড়ে ‘একদিন প্রতিদিন’-এর সেই দৃশ্য। ওই ছবিতে আমার মা হয়েছিলেন গীতা বৌদি। ছবিতে একটা দৃশ্য ছিল, আঙুল দেখিয়ে তিনি তাঁর স্বামীকে চিৎকার করে বলছেন, ‘ওই লোকটাকে বল যে সারাজীবন চুপ করে রইল।’

মৃণালদা প্রায়ই বলতেন, ‘‘এক সোম আমাকে জীবন দিয়েছেন। আরেক সোম প্রতিষ্ঠা।’’

কথাটা যে কত বড় সত্যি! বলে দিতে লাগে না, ‘প্রতিষ্ঠা’ অর্থাৎ ওঁর ‘ভুবন সোম’ ছবি। ‘জীবন’ অর্থাৎ ‘গীতা সোম’। বিয়ের আগে বৌদি ‘সোম’ ছিলেন।

মৃণালদার জন্মদিনে গেছি। গিফট নিয়ে। বিজয়ার পর গেছি ওদের দু’জনের জন্য মিষ্টি নিয়ে। শুধু বৌদির জন্য আমার কোনও দিনই কিছু কেনা হয়নি। বৌদিকে কিছু একটা দিতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল। আমি ফোনে বললাম, ‘‘আপনাকে তো কোনও দিন কিছু দিইনি। খুব দিতে ইচ্ছে করছে। আপনার দরকারি কোনও জিনিস বলুন, যা আপনার কাজে লাগবে।’’ বললেন, ‘‘কী দেবে মম। আমার সবই আছে।’’

ইদানীং অসুস্থতার জন্য বৌদি বাড়িতে হাউসকোট পরতেন। আর গায়ে থাকত একটা সুন্দর চাদর। তাই ভাবলাম হাউসকোট আর চাদর দিই। সেটা বলতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন।

কেনা তো হল। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মধ্যে কিছুতেই ওদের বাড়িতে যেতে পারছিলাম না। হঠাৎ ভিতর থেকে একটা তাগিদ অনুভব করলাম। সব কাজ ফেলে ছুটলাম বৌদির বাড়ি। সোজা ঢুকলাম তাঁর ঘরে।

উপহারগুলো হাতে দিতেই ভীষণ খুশি। বিছানার চারপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে হিসেবের কাগজপত্র। সে দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘বৌদি এখনও হিসেব সামলাতে হচ্ছে!’’

ঠোটের কোণে আলতো হাসি। বললেন, ‘‘এই অফিস থেকে ছুটি নেই।’’ তার ঠিক দু’দিন পরেই সেরিব্রাল অ্যাটাকে কোমায় চলে গেলেন বৌদি! আর জ্ঞান ফিরল না। খবরটা পেয়েই বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সে দিন যদি না যেতাম নিজেকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারতাম না।

কে জানত, এমন অবেলাতেই হঠাৎ ছুটি নিয়ে নেবেন গীতা বৌদি...

ওকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন দেখলাম, আমার দেওয়া চাদরটাই ওঁর গায়ে। মনে হল, শেয মুহূর্ত পর্যন্ত আমি যেন গীতা বৌদিকে ছুঁয়ে থাকতে পারলাম!

(সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখা)

ছবি: সৌজন্যে কুণাল সেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন