K. G. Subramanyan

শতবর্ষের শুভারম্ভে সুব্রহ্মণ্যন

কজন চিত্রকর, ছাপাইচিত্রী, ভাস্কর, নকশাকার, শৈল্পিক বই ও খেলনা রচনাকারেরও অধিক ছিলেন। তাঁর নাম কে জি সুব্রহ্মণ্যন। ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কে জি সুব্রহ্মণ্যনের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে।

Advertisement

শমিতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৪৯
Share:

রূপ ও রেখা: কে জি সুব্রহ্মণ্যনের চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

স্বাধীনতার প্রথম সাত দশকব্যাপী ছিল তাঁর কাজের পরিধি। এই সময়পর্বে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারতের অগ্রগণ্য শিল্পী। একজন চিত্রকর, ছাপাইচিত্রী, ভাস্কর, নকশাকার, শৈল্পিক বই ও খেলনা রচনাকারেরও অধিক ছিলেন। তাঁর নাম কে জি সুব্রহ্মণ্যন। ২০২৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কে জি সুব্রহ্মণ্যনের জন্মশতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে।

Advertisement

যেহেতু দেবভাষা বই ও শিল্পের আবাস, ২০১৭ সাল থেকেই বই ও শিল্পকেন্দ্রটির পথচলা শুরু হয়। কিন্তু শিল্পকলা সংক্রান্ত বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে কে জি সুব্রহ্মণ্যনের ‘সাক্ষাৎকার’ বইটির মধ্য দিয়েই দেবভাষার বই প্রকাশনার সূচনা। শিল্পীর জন্মশতবর্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। এখানে কিছু কাজ দেবভাষার নিজস্ব সংগ্রহ থেকে আর বাকি কাজ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত। শিল্পীর একটি গ্রন্থের শিরোনাম ‘লিভিং ট্র্যাডিশন’। তাই এখানেও প্রদর্শনীর নাম রাখা হয়েছিল ‘লিভিং ট্র্যাডিশন’।

এই প্রদর্শনীতে মূলত শিল্পীর ড্রয়িংভিত্তিক কাজই দেখতে পাওয়া যায়। মোটামুটি দশ থেকে বারোখানা কাজ ছিল। তাঁর শেষবেলার পাঁচটি ড্রয়িং যেগুলো ‘সাক্ষাৎকার’-এ মুদ্রিত হয়েছিল কিন্তু কখনও প্রদর্শিত হয়নি, সেই ড্রয়িং এখানে দর্শক দেখতে পেলেন। এই পাঁচটি ড্রয়িং শিল্পী দেবভাষার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার ভিতরে কে জি সুব্রহ্মণ্যনের ষাটের দশকে করা একটিমাত্র এচিং দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। আর ছিল একটি মাটির সরার উপরে কাজ।

Advertisement

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

শিল্পী সম্পর্কে কিছু কথা বলা দরকার। শান্তিনিকেতনে গিয়ে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর তিনজন গুরুকে, যাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ শিল্পী। তাঁরা তাঁকে শুধু কৌশল-ই শেখাননি, সাহায্য করেছিলেন এক দার্শনিকতা আর নীতিবোধ গড়তে, যা সুব্রহ্মণ্যনকে গড়ে তুলেছিল একজন দুর্দান্ত শিক্ষক, দার্শনিক এবং এক সম্পদশালী শিল্পী হিসেবে। নন্দলাল, বিনোদবিহারী আর রামকিঙ্করের আশীর্বাদ-‌ধন্য ছিল তাঁর শিল্পজীবন। কে জি সুব্রহ্মণ্যনের জীবনাবসানের পর শিল্পের এক যুগ যেন শেষ হয়ে গেল।

এই প্রদর্শনীতে কাগজের উপরে তাঁর পেন অ‌্যান্ড ইঙ্কের কাজ, প্যাস্টেল ড্রয়িং, মিক্সড মিডিয়ায় করা কাজ সবই ড্রয়িং-ধর্মী। এগুলো দেখলে বোঝা যায়, তাঁর গুরু নন্দলালের মতো শিল্প আর কারিগরির পার্থক্য তিনি মুছে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছিলেন। নিয়ম মেনে বৈচিত্রের চর্চা করেছিলেন। শিল্পচর্চার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডিজ়াইন শিক্ষার কাজও করেছিলেন। এখানে যে ড্রয়িংগুলো দেখা গেল, তাতে ফর্ম ভেঙে ডিজ়াইন সৃষ্টি করার ব্যাপারটা ধরা পড়ে।

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

ড্রয়িংগুলোয় টুকরো টুকরো ছবি আছে। রয়েছে একটি মেয়ের মুখ, কোথাও একটা পাখি, কোথাও পশু... এ ভাবে আঁকতে আঁকতে মনে হয় তিনি তাঁর চূড়ান্ত আকার বা ফর্মটিকে পেয়ে যেতেন। ওটাই তার পূর্ণতা। শিল্পীর নিজের ভাষায় বলতে গেলে- “কিছু কিছু চিন্তা সবসময়ই আমাদের মনের ভেতর ঘুরতে থাকে যা হয়তো আমরা নিজেরাই জানি না। আবার নিজের কিছু কথা বলা বা সংলাপ মনের মধ্যে ধারণ করা আছে। কাজটি করার সঙ্গে সঙ্গেও কিছু সংলাপ তৈরি হচ্ছে। দর্শকের মনে দেখবার সময়ে যে সংলাপ তৈরি হচ্ছে সেটি শিল্পীর সংলাপের সঙ্গে এক নাও হতে পারে। এই দুই সংলাপের মধ্যবর্তী অবস্থানে রয়েছে শিল্পকর্মটি।” এতটা জানলেই বোঝা যায় শিল্পীর বুদ্ধিমত্তা কতখানি উন্নত ছিল। হয়তো এই কারণেই তিনি দারুণ শিক্ষক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

প্রদর্শনীতে একটি কাগজে করা জলরং দেখা গেল। পাশাপাশি দু’টি সাধারণ খেজুর গাছের ছবি। জলরঙের উপর অসম্ভব দখল না থাকলে এত সহজে এক টানে এ রকম ছবি করা সম্ভব নয়। আর-একটি তুলির দুই টানে শুধু একটি মুরগির ছবি। এটি একটি পেন অ্যান্ড ইঙ্ক কাজ। এই দু’টি কাজ থেকেই বোঝা যায় যে খুব সামান্য কিছু উপকরণ থেকেই শিল্পী ছবিকে সর্বোচ্চ অভিব্যক্তিতে প্রকাশ করতে পারতেন।

কে জি সুব্রহ্মণ্যনের চিত্রকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।

এখানে দর্শক সাদাকালোর ড্রয়িং বেশি দেখতে পেলেন। শুধু কালোসাদায় কাজ করতে পছন্দ করতেন সেটা বোঝা যায়। কলাভবনে মুরাল করার সময়েও সাদা কালো বেছে নিয়েছিলেন শিল্পী। এখানে ড্রয়িং-এর মধ্যে রিভার্স ইমেজও আছে। এগুলো দেখলে মনে হয় সুদূর প্রাচ্যের কোনও শিল্পীর থেকে ওই সাদা-কালোর প্রভাব হয়তো শিল্পীর কাজে পড়েছিল। প্রাচ্যের কিছু শিল্পী যে রকম বিশ্বাস করতেন যে সব কিছু খুব স্পষ্ট ভাবে সিলুয়েটের মধ্য দিয়ে দেখা যায়। তখন জগৎ নিজেকে সাদাকালোয় প্রকাশ করে। সূর্যের আলো পড়া মাত্র সব রং ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে।

শিল্পী সুব্রহ্মণ্যনের কাজে সাদাকালোর ড্রয়িংগুলোয় কালোর প্রখর ক্ষমতা প্রকাশ পায়। প্রদর্শনীতে একটি মিশ্র মাধ্যমের ড্রয়িং উপর দেখা যায়, যেখানে আপাতদৃষ্টিতে একটি নারকেল গাছ– তার উপরে একাধিক পাখির বিচরণ, শেয়াল জাতীয় কোনও পশু উপরে উঠছে হয়তো পাখি শিকার করার জন্য, আবার ছবির অন্য দিক দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে– নানা মুহূর্তের সমন্বয়ে খুব আকর্ষক ছবি। সম্পূর্ণ বিমূর্তকরণ দেখা যায়। ইমেজগুলোকে সাজিয়ে সাজিয়ে একটা ডিজ়াইন তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু তারও ভিতরে বইছে এক গভীর চিন্তাধারা। এই সব মিলিয়েই অনবদ্য এক একটি ড্রয়িং।

অপর একটি পেন অ্যান্ড ইঙ্ক ড্রয়িং কাগজে। সেখানেও রিভার্স ব্যাপার। গাছের আশপাশে বাঘ ও পাখির একত্রে বিচরণ। সেখানে শিকারি ও শিকারের ভিতরের যে নাটক চলছে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে অনুভব করা যায়। আবার একটা শিশুসুলভ সারল্য আছে বলে মনে হয়। কিন্তু ঠিকভাবে দেখলে এখানে সত্যের আরও অনেক স্তর রয়েছে। সত্যকে বলার অনেক উপায় তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন। শিল্পী সুব্রহ্মণ্যন-এর ১৯৬৮ সালে করা এচিং-টি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। তাঁর সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে আলাদা। এখানে জ্যামিতিক আকারের স্পেস ডিভিশন বা জায়গা-বিভাজন করেছেন, শুধু রেখার সাহায্যে, মোটা, সরু, খুব সরু, সমান্তরাল, খাড়া, ক্রিসক্রস নানা ভাবে রেখা টেনে টেনে বিমূর্ত একটি ছবি। এটি করার সময়ে তাঁর কোনও বাস্তবধর্মী চিন্তাও মনের মধ্যে ছিল বলে মনে হয় না। এ এক আশ্চর্য এচিং।

ছবি এঁকে চলার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন পথের অনুসন্ধান এবং চিন্তন শিল্পী কে জি সুব্রহ্মণ্যনকে ভারতের অন্যতম চিত্রশিল্পী ও শিল্প দার্শনিক হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন