কী সের সঙ্গে তুলনা চলে ‘ব্রাত্যজন’-এর নতুন এই নাটকের?
এতটুকু অস্বস্তিতে না পড়ে আখতারি বাঈ আর বব ডিলানের গান পর পর শুনতে পারার মতো মসৃণ কোনও মুহূর্তের?
নাকি, হিচককের সাসপেন্স মাখা বঙ্কিমচন্দ্রীয় ঘরানার কোনও উপন্যাস পড়ে আহ্লাদিত হওয়ার মতো কোনও অনুভূতির?
জানা ছিল, ‘অশালীন’, ‘কে’, ‘দুটো দিন’-এর মতো থিয়েটারের টি-টোয়েন্টিতে তিনি যেমন স্বচ্ছন্দ, ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’, ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর মতো টেস্ট ম্যাচেও তাই। বিনির্মাণের শৈলীটা তাঁর জানা। নির্মাণের ক্লাসিক স্টাইলও তাঁর রপ্ত। কিন্তু একই থিয়েটারে দুই বিপরীত স্বরের সহবাস ঘটালেন নাট্যকার-পরিচালক ব্রাত্য বসু এই প্রথম, তাঁর ‘বোমা’ নাটকে। তার সঙ্গে অভূতপূর্ব কিছু ‘এফেক্টস’-এর সংযোজনও প্রথম বার।
**************
শুরু থেকেই পিছনের সাদা পর্দায় পর পর চলতে থাকে অ্যানিমেশন...।
ডলবি এসআর-এ গোলাগুলি, হাতবোমার শব্দ...।
গোঁ গোঁ গোঁ গোঁ করে নিরন্তর বয়ে চলা আওয়াজে হেলিকপ্টার কিক...।
মঞ্চের সামনের দিকে গোটানো পর্দায় সাব টাইটেল...।
এক ধারে বৃষ্টি নামল এক বার...।
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে ঘটতে থাকা ‘প্রথম সব কিছু’।
এটাই কি থিয়েটারের নতুন ভাষা?
মহলায় দেবশঙ্কর হালদার ও পৌলমী বসু। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
মিনার্ভায় নাটকের মহলা দেখতে দেখতে দেখতে বারবার মনে হচ্ছিল, ‘বোমা’র কাণ্ডকারখানা দেখলে উৎপল দত্ত কী বলতেন? দৃশ্যায়নে মাঝে মাঝেই যিনি ‘গ্লোবাল’ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। মঞ্চে জাহাজ তুলেছেন, নদী দেখিয়েছেন, কলিয়ারির বীভৎস দুর্ঘটনা দেখিয়েছেন...। তবে ‘এফেক্টস’-এর গণ্ডিকে সময়ের কারণেই ঘোর বাস্তবোচিত করে তোলার সুযোগ পাননি।
নিজের দ্বিতীয় পিরিয়ড-পিস ‘বোমা’য় এসে সাহস করে সময়ের সেই সুযোগটাই নিয়েছেন ব্রাত্য। প্রথম শো, ২৭ এপ্রিল, সোমবার, সন্ধে সাড়ে ছ’টা, একাডেমি।
**************
পিরিয়ড-পিস। সময়কাল শুরু ২৯ জানুয়ারি, ১৯০৮। দেওঘরের দিঘিরিয়া পাহাড়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে চরমপন্থী আন্দোলনের যখন ভ্রূণাবস্থা। উল্লাসকর দত্ত যখন বোমা তৈরির ফর্মুলা জেনে ব্রিটিশ তাড়ানোর নতুন অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছেন।
এই ঘটনাক্রম কার্যত শেষ হচ্ছে ৬ মে, ১৯০৯। যে দিন আলিপুর বোমার মামলার রায় বেরচ্ছে। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও খুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হচ্ছেন। উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো সহ বহু বিপ্লবীকে দ্বীপান্তরে পাঠানো হচ্ছে। তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। প্রমাণাভাবে ছাড়া পাচ্ছেন অরবিন্দ ঘোষ সহ কয়েক জন।
কাহিনি এখান থেকে চলে যায় সেলুলার জেল, ২৮ অগস্ট, ১৯১৩। বিপ্লবীদের সেলে। তারপর আবার ন’বছর বাদে, ১৯২২। পণ্ডিচেরিতে। অরবিন্দর আশ্রম।
**************
১৯০৮। সালটিকে খেয়াল করুন, ব্রিটিশ দমননীতি তখন তুঙ্গে। চালু হয়েছে ‘রাজদ্রোহমূলক জনসভা আইন’, ‘বিস্ফোরক দ্রব্যআইন’, ‘প্রেস-আইন’-এর মতো কালাকানুন। ঠিক আগের বছর চরমপন্থীদের বিনা বিচারে আটক করার জন্য পুনঃপ্রবর্তিত হয়েছে কুখ্যাত ‘১৮১৮-র তিন নম্বর আইন’।
এ সব সত্ত্বেও বাঙালি মধ্যবিত্তদের একটা বড় অংশ যুক্ত হলেন চরমপন্থী দলে। যাকে কেউ বলেন, বেঙ্গল রেভলিউশনারি পার্টি, কেউ বলেন যুগান্তর সমিতি। যাঁদের এজেন্ডা একটাই— ব্রিটিশকে দেশ থেকে তাড়াতে গেলে খতম করতে হবে। পাল্টা মারের লড়াইয়ে নেমে তাদের মনে ভয় ধরাতে হবে। শাসকের কোনও রং হয় না। খতম ছাড়া পৃথিবীতে তাদের কিছু পাওয়ার নেই।
যে চিন্তা থেকে বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনার মূল মদতদাতা লেফটানান্ট এনড্রু ফ্রেজার, আটক-হওয়া স্বদেশীদের উপর অত্যাচার চালানোর পাণ্ডা চিফ প্রেসিডেন্সি-ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডের মতো ইংরেজরা তাঁদের খতম-তালিকায় পড়লেন।
মুরারিপুকুরে বোমা তৈরির কারখানা তৈরি হল। চলল খতম অভিযান। কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মধ্যে ‘যুগান্তর সমিতি’র পুরো ব্যাপারটাই ভেস্তে গেল। বোমার কারখানা নজরে চলে এল ইংরেজদের। একে একে ধরা পড়লেন নেতানেত্রী সহ প্রায় একশো জন।
আজও বলতে গেলে অনুদ্ঘাটিত, ঠিক কী করে পুরো পরিকল্পনাটি অত দ্রুত গোচরে আসে শাসক ইংরেজের। কৌশলের অসারতা? পদ্ধতির অপরিপক্কতা? আবেগসর্বস্ব অ্যাডভেঞ্চারিজেমের ফল? নাকি বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্তসুলভ লোভ? নাট্যকার ব্রাত্য এই প্রশ্নগুলো নিয়ে কাহিনি বুনেছেন। কাল্পনিক চরিত্র এনে তাঁর সন্দেহকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন।
পাশাপাশি চলেছে সহিংস বনাম অহিংস পথ নিয়ে ঐতিহাসিক বিতর্ক। বাঙালি প্রসঙ্গে মেকলের ভার্সানটি সামনে এনে এই জাতিকে বোঝার, ব্যাখ্যা করার কাটাছেঁড়া। মেকলের বিশ্বাস ছিল, শিক্ষিত হোক বা না হোক, বাঙালিরা গ্রুপ করবেই। নিজের ইগোর আর স্বার্থের কাঁটাতার এরা ভাঙতে পারে না কিছুতেই।
এই ভাবনাগুলোর সঙ্গে গোটা নাটকে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে নেতৃত্ব সম্পর্কিত নানা প্রশ্ন। আদর্শ নয়, নিষ্ঠা নয়, ব্যক্তির প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্যই কি নেতার কাম্য? ঈর্ষা, কুৎসা, ভয়, লোভ, অনিশ্চয়তা, অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা, ইতিহাস হয়ে ওঠার বাসনাই কি এক জন নেতাকে বেপথু করে তোলে?— প্রতিটি প্রশ্ন, আন্দোলনের বেড়ে ওঠা, তার চলন, ভাঙন, আবার জেগে ওঠার সম্ভাবনা— সব কিছুর আড়ালে অবধারিত ভাবে উঁকি দেয় সমকাল। জলজ্যান্ত হয়ে ধরা পড়ে যে কোনও রঙের রাজনৈতিক দল।
**************
সেটে বাহুল্য নেই, কিন্তু পরিপাটি। একটিই কাঠের মেঝে। দেওয়ালে হালকা ছবিতে ধরা পুরনো কলকাতার কোলাজ। পাশেই ছোট্ট একটা সিঁড়ি গিয়ে মিলেছে দেড় মানুষ সমান উঁচু আনুভূমিক পাটাতনে।
সিঁড়ির পাশে খড়খড়িওয়ালা পুরনো ধাঁচের চওড়া জানলা। মাঝে মাঝে গ্যাসবাতি, টেলিফোন, মা কালীর কাট-আউট ইত্যাদি এক-একটা প্রপ জুড়ে আর আলোআঁধারির খেলায় সবটা মিলে হয়ে যায় কখনও পুলিশ কমিশনারের ঘর, কখনও বাগানবাড়ি বা কখনও জেলখানা বা অন্য কিছু।
ছোট্ট, কিন্তু অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, অরবিন্দ ঘোষ করছেন দেবশঙ্কর হালদার। অতি সংক্ষিপ্ত একটি চরিত্রে ব্রাত্য নিজে (চিত্তরঞ্জন দাশ)। এঁদের পাশাপাশি এ-নাটকে নজরে পড়ার মতো কাজ করছেন বারীন ঘোষ, চার্লস টেগার্ট, কল্পনা, উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র, স্টিভেনসন মূরের চরিত্রাভিনেতারা।
বহু দৃশ্যের ফ্রেমিং সত্যিই ভোলার নয়। আদালতের রায় শুনে উল্লাসকর যখন গেয়ে ওঠেন ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’!— ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’র ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’ ঘাই মেরে যায়। ভোলার নয়, মুশমুশে কালো শাড়ি পরা, মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা ডাকাত-রানি কল্পনার বন্দুক উঁচিয়ে জানলা বেয়ে স্ফুলিঙ্গের মতো ঠিকরে ওঠা। ভোলার নয়, মহিলা সহযোদ্ধাকে কামনা করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বারীনের দুমড়ে মুচড়ে, কুঁকড়ে মাটিতে প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া...।
**************
বহুমুখী ধারায় বইতে থাকা ঘটনা, একের পর এক উঠে আসা ঐতিহাসিক সব বিতর্ক, টান টান অভিনয় আর ‘এফেক্টস’-এ ঠাসা প্যাকেজে এ-নাটক আবারও ব্রাত্যর ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ বা ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর মতো আলোড়ন ফেললে অবাক হওয়ার নেই।
তবে ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবিবরণীতে ইতিহাসের গ্রহণ, বর্জন, চলন, নির্মাণ-বিনির্মাণ নিয়ে মত-মতান্তর থাকতেই পারে। এ-নাটকেও হয়তো’বা তা থাকবে।
অ্যাপস-প্যাকস সর্বস্ব দুনিয়ায় আদ্যন্ত পিরিয়ড-পিস নিয়ে তেমন বিতর্ক নিশ্চয়ই অ-সুখের নয়।
সত্যমেব জয়তে।