গত শতকের শেষ চার দশক জুড়ে বাংলা থিয়েটারে ব্রেখট চর্চা এমনই রমরমিয়ে চলেছিল যে, কোনও কোনও সমালোচক ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলেছিলেন, ‘বাংলায় এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় নাট্যকার বের্ট্রোল্ট ব্রেখট।’ সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বাংলা থিয়েটারে ব্রেখট সাহেব প্রায় অন্তর্হিত হয়েছেন। তবু তারই মধ্যে আজকের এই চূড়ান্ত বাম-বিকর্ষণের বাজারে যে দু’-একটি প্রযোজনা ব্রেখটকে নতুন প্রজন্মের নাট্য দর্শকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, তার অন্যতমটি অরুণ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত, মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটার প্রযোজিত ‘খড়ির গণ্ডী’। ব্রেখটের ‘ককেশিয়ান চক সার্কল’ এর আগে কলকাতায় অভিনীত হয়েছিল। তার মধ্যে জনপ্রিয় হয় নান্দীকার প্রযোজিত ‘খড়ির গণ্ডী’ এবং বাদল সরকারের শতাব্দী প্রযোজিত ‘গণ্ডী’। মিনার্ভা রেপার্টরির এই ‘খড়ির গণ্ডী’ অবশ্য নান্দীকারের করা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর অনুবাদের মতো মোটেও বঙ্গীকরণ নয়। শুভঙ্কর দাশশর্মা তাঁর অনুবাদে চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব মূলানুগ থাকতে। তিনি ঘটনা, চরিত্র ও পরিবেশ ককেশীয়ই রেখেছেন। নির্দেশকের সম্পাদনায় মূলের অনেক কিছুই বাদ গিয়েছে। বিশেষ করে কিছু গানের প্রয়োগ। সময়ানুগ প্রযোজনার স্বার্থে অবশ্য তা স্বাভাবিকই ছিল। ব্রেখটীয় অ্যালিয়েনেশন অনুসারে দর্শকের কাছে নাটকের ঘটনা ও চরিত্র বিশ্লেষণে প্রায়শই চরিত্ররা হয়ে ওঠে কথক। দলগত সঙ্গীতের পাশাপাশি আবৃত্তির প্রয়োগও নিখুঁত ব্রেখটীয় প্রযোজনার সুরটিকে ধরে রেখেছে সুন্দর ভাবে। অরুণ মুখোপাধ্যায় যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন মূল ব্রেখটীয় প্রযোজনার শর্তগুলি অক্ষুণ্ণ রাখতে এবং সে কাজে তিনি যে সফল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
পালা আসরের ভঙ্গিতে পরিবেশিত এই নাট্য প্রযোজনায় অবশ্য আড়ম্বর কিছু মাত্র কম ছিল না। হিরণ মিত্রের মঞ্চ ও দীপক মুখোপাধ্যায়ের আলো আপাত ভাবে ছিমছাম ব্যঞ্জনাময় হলেও বিভিন্ন দৃশ্যে মুখোশ, মৃতের কাটা মুণ্ডু-সহ অসংখ্য উপকরণ-বাহুল্য বুঝিয়ে দেয় যে, প্রযোজনার খরচের জন্য এক জন ‘গৌরী সেন’ আছেন। পোশাকের বৈচিত্র এবং আয়োজনও চোখে পড়ার মতো বেশি ও আড়ম্বরপূর্ণ। বাদল সরকার ‘গণ্ডী’ করেছিলেন সামান্য কিছু পোশাকের উপকরণে— জামা টুপি বদলে বদলে, মুহূর্তে চরিত্রগুলিকে বদল করে করে। তিন ঘণ্টার প্রযোজনা তিনি দেড় ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছিলেন সমস্ত ব্রেখটীয় এসেন্স বজায় রেখেই। অথচ মিনার্ভার প্রযোজনা সময়ের বিচারে দীর্ঘ তো বটেই। যদিও প্রয়োজন ছিল আজকের সময়োপযোগী সম্পাদনার। গ্রুশার বিবাহ-দৃশ্যের বাড়াবাড়ি রকম হাস্যরস কিংবা আজদাকের বিচারের বহু দৃশ্য, যেমন ধর্ষণের বিচার— বাদ যেতেই পারত। গানের দল-সহ প্রায় ৪০ জনের বেশি কাস্টিংয়ের চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি ও প্রোডাকশনের বিপুল জাঁকজমকে ব্রেখট সাহেব খুবই গৌণ হয়ে পড়েন। তবে এ সবের মধ্যেও গ্রুশা চরিত্রে সুপর্ণা মৈত্র এবং আজদাক চরিত্রে বুদ্ধদেব দাসের অভিনয় চোখে পড়ার মতো ভাল। দেবরাজ ভট্টাচার্যের অভিজাত গলার গানগুলি শ্রুতিমধুর হলেও নাট্যবিষয় ও ঘটনার জঙ্গমতার সঙ্গে ততটা মিশে যেতে পারেনি।