Art exhibition

নকশাকার রীতেন মজুমদারের সাতিশয় শিল্পমাধ্যম

ডিজ়াইন, নকশা, আলঙ্কারিকতার মধ্যে মনপ্রাণ ডুবিয়ে রাখা শিল্পী ছিলেন রীতেন মজুমদার। তাঁরই বেশ কিছু কাজ নিয়ে ইমামি আর্ট গ্যালারি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল।

Advertisement

অতনু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২২ ০৮:৪৫
Share:

নীরিক্ষামূলক: ইমামি আর্ট গ্যালারিতে রীতেন মজুমদারের কাজ।

ডিজ়াইন নকশা, আলঙ্কারিক বিভিন্ন স্টাইলের পরম্পরার ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে কমবেশি বিতর্ক আছে। ডিজ়াইন ব্যাপারটা শিল্পীদের এক বা একাধিক সৃষ্টির ধারাবাহিকতাকে চিনিয়ে এসেছে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রাক ইতিহাসের নিদর্শনে যার প্রমাণ প্রচুর। প্রাচীন বিশ্বের প্রাগৈতিহাসিকতা, অনেক রকম সভ্যতার নিদর্শনের মধ্যেই সময়ানুযায়ী সে সব খুঁজে পাওয়া গেছে। সেই সমাজের মনুষ্য ব্যবহার্য দৈনন্দিন জীবন-জীবিকার তাগিদে সৃষ্ট সেই সব ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ইতিহাস সংগ্রহশালার সম্পদ। বিস্তর দ্রব্যে ডিজ়াইন নকশার অজস্র উদাহরণ তার সাক্ষী। বহু শতাব্দী পরে বিশ্বজোড়া স্থাপত্য, গির্জা, মসজিদ, মন্দির, ধর্মীয় স্থান ছাড়াও বহু জায়গায় নানা রকম রিলিফ ডিজ়াইন, সমতলীয় নকশার ছড়াছড়ি। যা তৎকালীন শিল্পীরা (স্থপতি, কারিগর, মিস্ত্রি, ভাস্কর প্রমুখ) সেই স্থান বা কাজের অংশের প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছিলেন ও সব আলঙ্কারিকতা বা ডিজ়াইন। কোনও ঘটনা বা ধর্মীয় অনুশাসনের বিভিন্নতা ও আনুষ্ঠানিকতায় ধীরে ধীরে যা সমৃদ্ধ হয়েছে অনেক রকম ভাবে। স্থান নির্বিশেষে ডিজ়াইন, প্রতীক চিহ্ন, সিম্বলগুলির নেপথ্যে অনেক সত্য ও কল্পাশ্রিত কাহিনি বিদ্যমান।

Advertisement

ডিজ়াইন, নকশা, আলঙ্কারিকতার মধ্যে মনপ্রাণ ডুবিয়ে রাখা শিল্পী ছিলেন রীতেন মজুমদার। তাঁরই বেশ কিছু কাজ নিয়ে ইমামি আর্ট গ্যালারি একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। উপস্থাপক উস্মিতা সাহু। ‘ইমপ্রিন্ট রীতেন মজুমদার’ নামে প্রদর্শনীটিতে মুম্বইয়ের ‘চ্যাটার্জি অ্যান্ড লাল’-এর সংগ্রহের প্রচুর কাজ ছিল। প্রয়াত রীতেন মজুমদারের এই প্রদর্শনী যাঁরা দেখেননি, বড় মিস করেছেন তাঁরা।

ইমপ্রিন্ট, যা আভিধানিক অর্থে মুদ্রণ, বা মুদ্রিত করা, ছাপা। রীতেন সমগ্র সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ের স্মৃতিতেই ছাপ ফেলে গিয়েছেন। দেখিয়েছেন ডিজ়াইন বা নকশা কত রকম ভাবে কোথায়, কোন কোন ব্যবহার্য জিনিসপত্রে, সমস্ত কিছুতে একটা বিরাট জায়গা অধিকার করতে পারে। ফর্মের বিবর্তন শিল্পরূপকে কী ভাবে আরও আধুনিক করতে পারে, চেনা দ্রব্যের আকারকেও আরও কত রকম দিক থেকে ব্যবহার করা যায়, আরও নয়নাভিরাম করা যায়, একমাত্র এই নিবিড় প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ প্রদর্শিত সৃষ্টিগুলির মধ্যে যা দর্শক খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন।

Advertisement

কলাভবনের প্রাক্তনীর বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও বিবিধ দর্শন তাঁর সৃষ্ট শিল্পে মিশিয়েছেন আশ্চর্য সব নিরীক্ষায়। সেখানেই শিল্পীর ‘সেন্স অব বিউটি’ থেকে ‘সেন্স অব মেটেরিয়াল’ এবং তার ভ্যালুজ় সম্পর্কে এক প্রখর থেকে প্রখরতর বোধকেই নতুন করে উন্মোচন করে।

টেক্সটাইল, কুশন কভার, ফ্লোর রাগ, বেডশিট টাই অ্যান্ড ডাই যেন ডিজ়াইনের অনুপুঙ্খময়তার সার্চলাইট। এ ছাড়া উডেন ফার্নিচারের যে প্রোটোটাইপ, সেগুলিকে প্রথমে মেটালে ডিজ়াইন করে, তার পর কাস্টিং করেছেন। তাঁর কাজ দেখে, ওই নিখুঁত ক্রাফ্টসম্যানশিপকে সেলাম না করে পারা যায় না। বিভিন্ন রকম চেয়ার, সোফা টাইপ, বসার জায়গা বা টেবিলের নকশা, তার শেপের ফর্মেশনটাই যেন গোটা একটা কমপ্লিট কাজ!

পোশাক পরিচ্ছদের ডিজ়াইন, বিবিধ প্রিন্টের বৈচিত্র, যা নিজস্ব উদ্ভাবনী পদ্ধতির স্টাইলিস্টিক উদাহরণ। রবীন্দ্রকাব্যের ক্যালিগ্রাফি সিল্কের উপর নিজের মতো কম্পোজ় করে একটি ডিজ়াইনের মধ্যে এনে, প্রাচ্যের কোনও শিল্পধারার সঙ্গে আশ্চর্য ভাবে মিলিয়ে দেন। নিজের হাতে ছোট্ট কাঠের ব্লক তৈরি করে কেটেছেন, ওই সূক্ষ্মতার তল পাওয়াই আশ্চর্যের!

তাঁর ক্যালিগ্রাফি দৃষ্টান্তমূলক। স্পেসের আকারকে কম্পোজ়িশনের সঙ্গে সব সময়ে প্রাধান্য দিয়েছেন, সে রিলিফ ওয়র্ক বা পেন্টিং, যা-ই হোক। মুদ্রণের যে বিভিন্ন ধারা, মাধ্যমের প্রাচুর্যের সঙ্গে তাকে কী ভাবে সাদাকালো বা রঙিন পর্যায়ে ফেলে কত রকম পরীক্ষা করা যায়, তাঁর আগে এমন কেউ করেননি। এই নিরীক্ষামূলক বৈচিত্রের অনুসন্ধানের মধ্যে তিনি সর্বক্ষণ নতুনত্বের সন্ধান করতেন।

কাঠের পুতুল, টেরাকোটা, যে-কোনও ছাপচিত্র, সিল্ক, টেম্পারা, মেটাল ভাস্কর্য, আসবাব, ব্লক, ক্যালিগ্রাফি, পেন্টিং ইত্যাদিতে ডিজ়াইনে আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এমন এক তীব্রতায়, যেখানে ধ্রুপদী বিন্যাসের বাতাবরণকে নিজস্ব ভাষায় রূপ দিয়েছেন। বিমূর্তকেও আর এক তীব্রতায় ছন্দের অনুরণনের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করেছেন।

তাঁর শিল্পের গভীরে ওই ভারতীয় ধ্রুপদী ঐতিহ্যের শিকড় ও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের আধুনিক বিমূর্ততার শাখা-প্রশাখা বিন্যস্ত হয়েছিল সৃষ্টির অহর্নিশ কর্মকাণ্ডে। এক-একটি কাজে রীতেন মজুমদারের অনলস ক্রিয়ার ম্যাজিক প্রতিটি মানুষকে মোহিত করেছে। তিনি মেটেরিয়াল, দ্বিমাত্রিক-ত্রিমাত্রিক মাধ্যম, অর্থাৎ পট বা ভিত্তি, বর্ণমাধ্যম, সে ছাপচিত্র বা পেন্টিং যা-ই হোক, তার আয়তন ও আকার... এ সমস্ত খুঁটিনাটি নিয়ে যে ভাবে রূপ দিয়েছেন, রূপান্তরিত করেছেন, সেই ডিটেলিং ও ভাবনার অন্তর্নিহিত অধ্যায়গুলি সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন