প্রগতিশীল: ‘দ্য স্টোরি ইজ় আস’ প্রদর্শনীর কয়েকটি কাজ
প্রদর্শনীর দু’টি উদ্দেশ্য। স্বনামধন্য দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী ছিলেন মাদ্রাজ আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ এবং তাঁর ছাত্ররাই মাদ্রাজ প্রগতিশীল শিল্প আন্দোলন গড়ে তোলেন। যা এই ২০১৮-১৯ সময়পর্বে ৭০ বছরে পড়ল। এ ছাড়া দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হল, চোলামণ্ডলমের ৫০ বছর। যার সঙ্গে জুড়ে আছে ‘আ ট্রিবিউট টু এস. নন্দগোপাল’। ঘটনাক্রমে এটি মাদ্রাজ প্রগতিশীল শিল্প আন্দোলনের প্রধান এস ধনপালেরও জন্মশতবর্ষ। ওঁর কাজ ও বিস্তর লেখালিখি দক্ষিণের শিল্পকলাকে ঋদ্ধ করেছে। প্রদর্শনীতে পানিক্কর-পুত্র নন্দগোপালের কাজের সঙ্গেই ছিল কে এম আদিমুলম-পুত্র অপরাজিথান আদিমুলমের কাজ।
দক্ষিণের শিল্পকলার এক সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও মহান ইতিহাস ভারতের শিল্পকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছে, সেই তথ্য নতুন করে দেওয়ার নয়। মাদ্রাজ শিল্প আন্দোলন কী ভাবে পশ্চিমের বম্বে প্রগতিশীল সোসাইটিকে ছাপিয়ে গিয়েছে— ধনপাল প্রমুখ তাঁদের সৃষ্টি ও রচনায় তা সুস্পষ্ট ভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। এই সমগ্র ভাবনা থেকেই কিউরেটর পর্ণব মুখোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর কথা বিড়লা অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেন এবং সেই অনুসারে তাঁরা এটি উপস্থাপনার কথা জানান। সদ্য শেষ হল ‘দ্য স্টোরি ইজ় আস’ নামের সেই প্রদর্শনী। দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী-সহ দক্ষিণের ১৫ জন শিল্পীর চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য রয়েছে এতে এবং রয়েছে শিল্পী প্রদোষ দাশগুপ্তের একটি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য।
অ্যাক্রিলিকে করা শৈলেশের ক্যানভাসে এক রঙের সমতল পর্বের মাঝখানে বিচ্ছুরিত রঙিন ছন্দোবদ্ধ আবহে মানব-মানবীকে শরীরী বিভঙ্গ ও জিমন্যাস্টিকের আদলে ফেলা এক ডিজ়াইনসদৃশ পেন্টিংয়ের তুলনায় পাইনকাঠ ও গোল্ড ফয়েলে করা প্রায় বর্তুলাকার মৎস্যকন্যার বিভঙ্গে এবং পদ্মাকৃতি রূপবন্ধে ঈষৎ পৃথুলা শরীর থেকে ক্রমশ সরু হয়ে আসা ভাস্কর্যটি অসাধারণ! অন্যটি দু’পাশে ছড়ানো লম্বা সরু পদযুগল, বাঁ হাত পুষ্পগুচ্ছ নিয়ে ঊর্ধ্বে ও ডান হাতে বর্তুলাকার পদ্মাকৃতি ফল। ভাস্কর্যটি গোলাকার দর্পণের উপরে বসানোর ফলে বিম্বিত রূপটির এক মায়াময় বিভ্রম তৈরি হয়ে সমগ্র কাজটিতে এক ছন্দের অনুরণন হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয়টি ঝুলন্ত ভাস্কর্য। শৈলেশের ‘লাইট অব দ্য মিস্টিক ফায়ার’ অসামান্য পেন্টিং।
এস নন্দগোপালের ‘গণেশ’ কপার শিট ব্রাশকাস্টে করা। কিছু জায়গায় টুকটুকে লাল কুন্দনের বিভ্রম জাগায়। সম্পূর্ণ লৌকিক আলঙ্কারিক ভাস্কর্য। জানকীরামের ‘গণেশ’ অবশ্য তামা ও মিশ্রমাধ্যমে করা। শরীরময় মোটা ও পাতলা পাত ভাস্কর্যসুলভ রূপবন্ধে এনে এবং পিছনে শূন্যতা রেখে, সরু রঙের বিভিন্ন বাঁক আর রেখাঙ্কনের ফর্মে গড়েছেন অসামান্য ভাস্কর্যটি। আলঙ্কারিক প্যাটার্ন, চোখ ও মোটা শুঁড় যেন অভিব্যক্তিই বদলে দেয়। সঙ্গে হলদে কুন্দনের বিভ্রম।
অচুথন খুল্লারের নীলাভ তেলরঙা পেন্টিংটি স্বপ্নের মতো। গোটা পট জুড়ে বিভিন্ন রূপবন্ধের ভেসে থাকা ও উড়ে বেড়ানো যেন রঙিন ফিতের ঢঙে! আর কাব্যিক সংগঠনের মধ্যে ছন্দে আঁটা রূপগুলিকে খোপে খোপে কোথাও মৃদু বসিয়ে দেওয়ার মতো। কে এম আদিমুলমের ‘দ্য ল্যান্ড ওয়ান চেজ় টেন’ এক দুরন্ত রচনা! অনেকটা বিক্ষিপ্ত সাদার পাশে ঘন লাল রঙের ব্যবহার সমেত একটি চমকে দেওয়া নিসর্গ। শিল্পীর ঝোড়ো ব্রাশিং যেন নিঃসীম প্রকৃতিকে দিয়ে কথা বলায়!
গুকণরাজের বিমূর্ত ভাস্কর্যের ছন্দ ও সেরামিকসের আশ্চর্য গঠন শরীরে কী এক শিহরন আনে। দুঃসাহসী পরীক্ষা পি এস নন্দনের গ্র্যানাইটে করা বিমূর্ত পাখি। মসৃণতা ও রুক্ষতা এখানে অদ্ভুত এক বৈপরীত্যের মাঝে অনন্য।
গণেশ সেলভারাজের মিশ্রমাধ্যম ত্রিমাত্রিক রিলিফ ভাস্কর্যের মতো, যেন ভিক্টর ভাসারেলির পেন্টিংয়ের বিভ্রম আনে। কী এক অপটিক্যাল ইলিউশন— অসাধারণ! টুকরো ম্যুরালের বিভ্রমও জাগায় দু’টি দ্বিমাত্রিক কাজ। দেবীপ্রসাদের প্লাস্টারে করা কালো ‘শ্রীমতী চারুলতা’ ও শীতে জবুথবু বসা বৃদ্ধ খুবই সংবেদনশীল। যেমন কিনা প্রদোষ দাশগুপ্তের ব্রোঞ্জটি এক চুঁইয়ে পড়া ছন্দ ও লাবণ্যে ভরপুর!
ভি ভীষ্মনাদমের কাজটি আকাশি নীল ও ভিন্ন লালের রূপবন্ধের একত্র অবস্থান। টেক্সটাইল কোয়ালিটিকে যা পূর্ণ প্রতিপন্ন করে। রেড্ডাপ্পা নায়ডুর তেলরঙের ‘মিউজ়িশিয়ানস’ শুকনো আবহে অত্যল্প রঙের ব্যবহারে এবং ব্রাশের ড্রয়িংয়ে যন্ত্রসঙ্গীতের দলের সংগঠিত সঙ্গীত নিবেদনকে সুনিপুণ মুনশিয়ানায় বেঁধেছেন।
অপরাজিথন আদিমুলমের ড্রয়িং-সদৃশ পেন্টিং যথেষ্ট কৌতূহল উদ্রেক করে। এ ছাড়া দক্ষিণামূর্তির গ্র্যানাইটে করা ‘উয়োম্যান’ এক অসামান্য ভাস্কর্য! সি ডগলাস এবং জে সুলতান আলির কাজও সমান প্রাণবন্ত।