ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর পেরিয়ে একটা-দুটো... বছর ষোলোর মেয়েটির চোখে ঘুম নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় সে স্ক্রল করেই চলেছে। পড়ার ফাঁকে দশ বার মোবাইলে চোখে চলে যাচ্ছে। কে মেসেজ করল, কে নতুন পোস্ট করল... পড়াশোনা, ঘুম সব শিকেয়।
বয়স আঠেরো হয়নি, এ দিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাকাউন্ট আছে, এমন উদাহরণ আকছার মেলে। যে সব ছেলেমেয়ে স্কুল, টিউশনের বাইরে আর কোথাও যায় না, ভার্চুয়াল জগতে তার হাজার দেড়েক বন্ধু! সোশ্যাল মিডিয়ায় কার কত বেশি বন্ধু, কার ফলোয়ার বেশি বা কার পোস্টে কত লাইক... এই সব নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। সংখ্যা যার দিকে বেশি, স্কুলে সে তত কুল!
ছোট থেকেই হাতে স্মার্ট ফোন। উপসর্গস্বরূপ জুটছে প়ড়াশোনায় অমনোযোগ, ঘুমের সাইকল নষ্ট, তিরিক্ষে মেজাজ, বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্ক করার প্রবণতা, অন্যকে অনুকরণের আপ্রাণ চেষ্টা এবং লোভ। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছিলেন, ‘‘এই সব ক’টা পয়েন্ট ভীষণ ভাবে দেখা যাচ্ছে এখনকার টিনএজারদের মধ্যে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের পোস্ট দেখে তাদের অনুকরণ করার ইচ্ছে জন্মাচ্ছে। অন্যদের মতো লেট নাইট পার্টি, একাধিক বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে অসুরক্ষিত যৌনজীবনে জড়িয়ে পড়ছে বা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে বহু কিশোর-কিশোরী।’’
এখান থেকে বেরোনোর উপায় কী?
• বয়ঃসন্ধির সময়টা সামলানো সবচেয়ে কঠিন। এই সময়ে শরীর-মনের পরিবর্তন হয় বলে এমনিতেই অনেক রকম জটিলতা তৈরি হয়। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, নিরাপদে আছে কি না... এই সব জানার জন্যই অভিভাবকেরা তাদের হাতে ফোন তুলে দেন। সেটাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে ছেলেমেয়ের হাতে স্মার্ট ফোনের বদলে সাধারণ ফোন দিন। নয়তো ফোনে ইন্টারনেট কানেকশন দেবেন না। এতেও না হলে ডেটা প্যাকের নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিন। ইউটিউবের কনটেন্টেও বিধিনিষেধ আরোপ করুন। বাবা-মায়েদের চেয়ে এখনকার বাচ্চারা অনেক অ্যাডভান্সড। তাই স্মার্ট ফোনের কারিকুরি আপনার চেয়ে তারা বেশি জানে। সুতরাং আপনাকেও অনেক সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে।
• নিজের মোবাইল ছেলেমেয়ের হাতে একেবারেই দেবেন না। বাচ্চাদের ভোলানোর জন্য হাতে মোবাইল তুলে দেওয়াই বাবা-মায়েদের আসল ভুল। আপনার মোবাইলে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট থাকতে পারে। ইন্টারনেট কিছু দেখার প্রয়োজন হলে বাড়ির ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে তা করতে বলুন। তাতে সকলের চোখের সামনে থাকবে বিষয়টা।
• সন্তানের মোবাইলের নেশা তাড়ানোর জন্য বাবা-মাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কঠোর হলে অবশ্য হিতে বিপরীত হতে পারে। সন্তানকে ভাল করে বোঝাতে হবে, সারাক্ষণ মোবাইল ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি আসক্তি তাকে কোন পথে নিয়ে যেতে পারে।
• নিজেরা বাচ্চার সঙ্গে সময় কাটান বেশি। একসঙ্গে সিনেমা হলে যান, কফিশপে গিয়ে আড্ডা দিন। কেরিয়ার তৈরির জন্য এই বয়সটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওদের কেরিয়ার গ়়ড়ার দিকে আগ্রহী করে তুলুন। সন্তানের কোনও বিষয়ে প্যাশন থাকলে সেই দিকটা এক্সপ্লোর করার সুযোগ করে দিন। এতে যদি পড়াশোনার সময় একটু কম হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। মোবাইলে মুখ গুঁজে রাখার চেয়ে তা অন্তত ভাল। বন্ধুদের বাড়িতে এনে গল্পগুজব করতে বলুন। বই, খবরের কাগজ পড়ায় উৎসাহ দিন। ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ক্রিকেট, সাঁতার, ফিটনেসের প্রতি উৎসাহ বাড়াতে পারেন। এগুলি সন্তানকে মোবাইল থেকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে।
• সন্তানকে হোমওয়র্ক করানোর সময়ে মোবাইল ঘাঁটবেন না। আপনার মনে হতে পারে, ও তো পড়াশোনা করছে, সেই ফাঁকে আপনি একটু গল্পগুজব করে নিলে ক্ষতি কী! এতে বাচ্চার মনে হয়, তার হোমওয়র্কটা বোধহয় জরুরি কিছু নয়। তাই মা-বাবা নজর দিচ্ছে না। পায়েল বলছিলেন, ‘‘খেয়াল করবেন, এখনকার বহু ছেলেমেয়ে আই কনট্যাক্ট করে না। এটাও অভিভাবকদের কাছেই শেখা। বাচ্চা কিছু জিজ্ঞেস করছে আর আপনি মোবাইল দেখতে দেখতে ‘হুঁ-হ্যাঁ’ করে বলে দিলেন। এটা থেকেও ওরা শেখে।’’
আই কনট্যাক্টের মতো সামনাসামনি বসে আড্ডাও দিতে ভুলে যাচ্ছে এখনকার প্রজন্ম। চ্যাটবক্সেই কথা সেরে নিচ্ছে তারা। এতে সামাজিক হতে শিখছে না টিনএজাররা। ফলস্বরূপ বাড়ছে একাকিত্ব। যতই সোশ্যাল মিডিয়ায় সারাক্ষণ থাকুক, মনের কথা কাউকে বলতে পারে না। কারণ, ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সবটাই মেকি।
সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্ট বলছে, একদম ছোট বাচ্চারাও মোবাইলে আসক্ত হয়ে প়়ড়ছে। ফলে তারা কথা কম বলছে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না। অনেক সময়ে তারা কথা শিখতেও সময় নিচ্ছে। ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মাকে দেখেই শেখে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, মোবাইল হাতে ধরিয়ে খাওয়াবেন না। নিজের ব্যস্ত সময়ে ওদের হাতে মোবাইল তুলে দেবেন না। টিনএজে গিয়ে কোনও কিছু বদলানো অনেকটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই রাশ টানুন একদম ছোট বয়স থেকেই।
মডেল: শিবাঙ্গী
ছবি: অমিত দাস
মেকআপ: অভিজিৎ পাল