এখন প্রায় অধিকাংশ পরিবারেই মা-বাবা চাকুরিরত। ফলে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে সারা দিনে মা-বাবার দেখা হওয়ার সময় সীমিত। তার মধ্যেই নিজের সন্তানকে নিজের মূল্যবোধ ও চিন্তাধারায় বড় করবেন কী ভাবে, সেটাই বড় চিন্তার কারণ বই কী। বাচ্চাকে সঠিক পথে গাইড করার জন্য সারা দিন তার সামনে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং নিজের চিন্তাধারা একটু একটু করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারাটাই আসল।
কী করবেন
• সারা সপ্তাহের একটা রুটিন করে রাখুন। ধরুন, আপনার সন্তান স্কুল থেকে তিনটের সময়ে বাড়ি ফেরে। তার পরে কত ঘণ্টা সে ঘুমোবে, কখন খাবে, কতক্ষণ পড়বে... তার একটা রুটিন করুন। বাচ্চার ঘরে এই রুটিন সেঁটে দিন। এই রুটিন আপনার সন্তান সঠিক ভাবে ফলো করলে সপ্তাহের শেষে কখনওসখনও তাকে উপহার দিন। তবে সব সপ্তাহের শেষে নয়। তা হলে সে সেই জিনিসটার জন্যই অপেক্ষা করে থাকবে। তখন আপনি যদি তা দিতে না পারেন, তা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
• সন্তানের টিফিন বক্সে, ব্যাগে, বাড়িতে তার ঘরে ছোট ছোট চিরকুট লিখে রাখুন। কখনও কখনও তার জন্য একটা বা দুটো চিঠিও লিখে যান। তাতে আপনার সঙ্গে ওর বন্ডিংয়ের কথাই লিখুন। এতে সন্তান মায়ের ভালবাসার স্পর্শ পাবে। আপনাকে মিস করলে, চিঠি তাকে সঙ্গ দেবে। সন্তানকেও উত্তরে চিঠি লিখতে বলুন। এতে ওর লেখার ক্ষমতা, চিন্তাশক্তি, ধৈর্য... সবই বাড়বে।
• সারা দিনে ফোনে অন্তত দু’বার ওর সঙ্গে কথা বলুন। যত কম সময়ই হাতে থাকুক না কেন, তার মধ্য থেকেই বাচ্চার জন্য কিছুটা সময় ধার্য করুন। সেই সময়টুকু তাকে কোনও কারণে বকাবকি করে বা নির্দেশ দিয়ে নষ্ট করবেন না। বরং তার সঙ্গে তার মতো করে গল্প করুন। সারা দিনে তারও আপনাকে অনেক কিছু বলার থাকতে পারে, তা শোনার চেষ্টা করুন।
• আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পরে বাচ্চা যদি খুব কান্নাকাটি করে, তা হলে আপনার ব্যবহার করা কোনও জিনিস সন্তানের কাছে রাখতে দিন। ধরুন, আপনার টি-শার্ট বা গায়ে দেওয়ার চাদর। সেটাই ওদের নিরাপত্তা দেবে। আপনি যখন বাইরে, তখন হয়তো ওর আপনাকে জড়িয়ে ধরতে খুব ইচ্ছে করছে। তখন ওকে বোঝান, ওই পোশাকের মধ্য দিয়েই ও আপনার স্পর্শ পাবে। ও সেটাকে কাছে নিয়েই নিরাপদ বোধ করবে।
• বাড়িতে যে সদস্যের কাছে সবচেয়ে বেশি সময় আপনার নয়নের মণি থাকে, তাঁকে নিজের চিন্তাধারা বোঝানোর চেষ্টা করুন। ছোটবেলায় বাচ্চারা ঠাকুরদা-ঠাকুমার বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। ফলে তাঁদের মানসিকতা বা চিন্তাধারার প্রভাবই সন্তানদের উপরে বেশি হয়। অনেক সময়েই বাড়ির বয়স্করা যে চিন্তাধারায় তাঁদের নাতি-নাতনিকে বড় করতে চান, তা হয়তো আপনার ভাবনার অনুসারী নয়। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাকে অহেতুক শাসন না করে, বাড়ির সেই সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করুন। তাঁকেই বোঝানোর চেষ্টা করুন, সন্তানকে কী ধরনের ভাবধারায় বড় করতে চান।
• মাসে অন্তত এক বার সন্তানের স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করুন। তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আলাপ করুন, তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। তা হলে আপনিও বুঝবেন, সন্তান ঠিক কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠছে। মাঝেমাঝে আপনার ছোট্ট সোনার বন্ধুদেরও বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে পারেন। তা হলে তাদেরও কাছ থেকে দেখতে পারবেন।
কী করবেন না
• দিনের অনেকটা সময় সে আপনাদের পায় না। তাই বাড়ি ফিরে সে কী করেছে বা করেনি, তাই নিয়ে প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করবেন না।
• বাড়ি ফিরে যদি জানতে পারেন, সে অন্যায় কিছু করেছে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে শাসন করতে বসবেন না। বরং পরে সময় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলুন। সে কেন অমন কাজ করেছে তা জানার চেষ্টা করুন। তার কাজটা যে ভুল, সেটা বোঝান।
• সারা দিন সময় দিতে পারেননি বলে সন্তানের সামনেই অনুশোচনা করবেন না। বরং তাকে বোঝান যে, আপনি পড়াশোনা করে চাকরি করার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আপনি নানা দায়িত্ব সামলান বলেই দিনের অনেকটা সময় আপনাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। আপনার সন্তানকেও বড় হয়ে যোগ্য হতে হবে।
একটা সময় ছিল যখন পরিবারের সদস্যসংখ্যা ছিল বেশি। কাকা-পিসি, ঠাকুরদা, ঠাকুমার গায়ের গন্ধেই বড় হয়েছে আগের প্রজন্ম। কিন্তু এখন নিউক্লিয়ার পরিবারে সে সুযোগ নেই। তবে দু’জনে সংসার শুরু করলেও সন্তানের স্বার্থে শ্বশুর-শাশুড়ি বা মা-বাবার শরণাপন্ন হচ্ছেন এ যুগের মা-বাবারা। খুব হালকা ভাবে হলেও ‘একান্নবর্তী’ পরিবারের ধারা কিন্তু আবার ফিরছে। এটাই আশার কথা। পরিবারের সদস্যরাই কিন্তু আপনার আদরের সন্তানকে মানসিক ভাবে নিরাপত্তা জোগান। আর যেটুকু সময় পাবেন, তা ওকে দিন। দেখবেন, সন্তান আপনার কথাই শুনছে।
মডেল: দীপ্তার্ক; ছবি: অমিত দাস; লোকেশন: লাহাবাড়ি