মধুর নয় মধুমেহ

ডায়াবেটিসকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগও নিয়ন্ত্রণে থাকে ডায়াবেটিসকে বলা হয় সাইলেন্ট কিলার। কিন্তু কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগও নিয়ন্ত্রণে থাকে

Advertisement

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share:

এডস, কলেরা, ডেঙ্গি, পোলিও...না, এর কোনওটাই নয়, ভারতে এখন মহামারীর আকার ধারণ করেছে ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ। প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর ওয়ার্ল্ড ডায়াবেটিক ডে-তে গোটা বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান।

Advertisement

বিশ্বের মধ্যে চিনে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত, আর তার পরেই ভারত! কিন্তু ভারতে যে দ্রুততার সঙ্গে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে ভারত চিনকে পিছনে ফেলে দেবে।

একটা প্রচলিত ধারণা ছিল ৬০-৭০ বয়সে গিয়ে মানুষের এই রোগ হতে পারে। কিন্তু এখন মধুমেহ বয়সের ধার ধারছে না। ২৫-৩০ বয়সে কিংবা তার আগেও এই রোগ হতে পারে। এতে শুধু একজন ব্যক্তির ক্ষতি নয়, একটা দেশের যুব সমাজ যদি এই রোগে ক্রমশ আক্রান্ত হয়, তা হলে সেটা দেশের পক্ষে বড় ক্ষতি। বেশ কিছু রোগের মতো ডায়াবেটিস একেবারে নির্মূল করা যায় না ঠিকই, কিন্তু রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায় অবশ্যই।

Advertisement

ডায়াবেটিস কেন হয়? এর নির্দিষ্ট কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারতে কিছুটা জিন ঘটিত কারণে এবং কিছুটা বর্তমান জীবনযাত্রার ধরনই এর কারণ। অনেক সময় খুব ছোট বয়সে অর্থাৎ সাবালক হওয়ার আগেই ডায়াবেটিক হয়ে পড়ে বাচ্চারা। এই ধরনকে জুভেনাইল বা টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস বলে। পরিণত বয়সের সমস্যাকে বলে টাইপ টু। অবশ্য বিশ্বজুড়ে জুভেনাইল ডায়াবেটিসের রেশিও বেশ কম, বড়জোর পাঁচ শতাংশ। সাধারণত অগ্ন্যাশয়ের সমস্যা থেকে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস হয়, এ ক্ষেত্রে সুস্থ থাকার জন্য ইনসুলিন প্রধান অস্ত্র। বেশি চিন্তা টাইপ টু নিয়ে। টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার পিছনে জিন অন্যতম প্রধান কারণ। বাবা-মা’র ডায়াবেটিস থাকলে সন্তানের তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই। এমনকী সাত পুরুষের মধ্যে কারও এই সমস্যা না থাকলেও একমাত্র ভারতীয় হওয়ার জন্যই ডায়াবেটিস হওয়ার ২০ শতাংশ সম্ভাবনা থেকেই যায়! দ্বিতীয় কারণ অসংযমী জীবন যাপন। ওজন বৃদ্ধি ডায়াবেটিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। অধিকাংশ ভারতীয় মায়েরা মনে করেন, সন্তান মোটা হলেই তার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। ফলে সন্তানদের ছোট থেকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করেন। যা পরবর্তী কালে অনেকের ক্ষেত্রে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মীরা ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন, এমনকী সারা রাতও কাজ করতে হয়। এই সময়ই খিদে মেটানোর জন্য জাঙ্ক ফুড একমাত্র সম্বল। কিছুটা বাধ্য হয়েই জাঙ্ক ফুড খাওয়ার অভ্যেস হয়ে যায়। তৃতীয়, কর্মক্ষেত্রে অসম্ভব স্ট্রেস ও টেনশন। যা ডায়াবেটিক হওয়ার পথটা মজবুত করে।

ডায়াবেটিসকে সাইলেন্ট কিলার বলে। এই রোগ ধীরে-ধীরে শরীরকে কাবু করে ফেলে আরও অনেক রোগের প্রকোপ নিয়ে এসে। যেমন, ডায়াবেটিকদের বারবার ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে। কিডনির সমস্যা হয়, এ ছাড়া ক্ষত সারতে সময় লাগে। যাঁরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত ইনসুলিন নেন, তাঁদের হঠাৎ করে ব্লাড সুগারের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে। হঠাৎ মাথা ঝিমঝিম, বুক ধড়ফড় বা অতিরিক্ত ঘাম হলেই বুঝবেন, রক্তে সুগারের মাত্রা কমে গিয়েছে। সে সময় অবিলম্বে গ্লুকোজ, চিনির শরবত খেয়ে নেওয়া উচিত।

তবে এত কিছুর পরও জোর দিয়েই বলা যায়, ডায়বেটিস হওয়া মানেই কিন্তু জীবন থেমে যাওয়া নয়। আর-পাঁচটা মানুষের মতো একজন ডায়াবেটিক পেশেন্টও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবেন। এমনকী উপযুক্ত সতর্কতা নিয়ে মা হওয়াতেও বাধা নেই। ডায়াবেটিকদের জীবনে ডায়েট একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট ও প্রোটিনের রেশিও ৬০:২০:২০ থাকা দরকার। করোলা, মেথি শাক, পাট শাক, নিম পাতা, পালং শাক, ছাতু, ওটস, আপেল, গাজর, বিনস, ডাল, দুধ, কড়াইশুঁটি, আখরোট, ছোট মাছ, মুরগির মাংস ইত্যাদি এই ডায়েটে থাকা দরকার। ভাজা ও মিষ্টি জাতীয় খাবার, কোল্ড ড্রিঙ্ক যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভাল। সুগার-ফ্রি মিষ্টি খাওয়া যেতে পারে তবে বেশি নয়। অনেকে বলেন, মিষ্টি খেলেই ডায়াবেটিস হয়। কথাটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অতিরিক্ত মিষ্টি ওজন বৃদ্ধি করে আর ওজন বৃদ্ধি ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ। ডায়েটের পাশাপাশি অবশ্যই দরকার সঠিক এক্সারসাইজ। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে জোরে হাঁটা দরকার। যাঁদের হাঁটুতে ব্যথা, তাঁরা হাঁটতে না পারলে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যোগ ব্যায়াম করুন। ডায়াবেটিকরা অবশ্যই নিয়মিত ব্লাড সুগার চেক করাবেন ও চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। ফাস্টিংয়ে ৭০ থেকে ৯০ এবং পি.পি অর্থাৎ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তে শর্করার মাত্রা ১১০ থেকে ১২০ থাকা মানেই বিপদসীমার বাইরে থাকা। নিয়ম করে চললেই একজন ডায়াবেটিক স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবেন।

এই মুহূর্তে প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত স্নান খাওয়ার মতো সন্তানদের মধ্যে পুষ্টিকর ডায়েট ও এক্সারসাইজের অভ্যেস করিয়ে দেওয়া। এতে পরের প্রজন্ম হয়তো এই রোগের হাত থেকে অনেকটা দূরে থাকতে পারবে, অন্তত কম বয়সে ডায়াবেটিক হয়ে পড়াটা আটকানো যাবে।

তথ্য সহায়তা:ডা. বিশ্বজিৎ ঘোষ দস্তিদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন