মানসিক চাপও এখন বন্ধ্যত্বের বড় কারণ

দুশ্চিন্তাও কাটাতে হবে। বলছেন সুপ্রজননবিদ ডা. গৌতম খাস্তগীর ও মনোচিকিৎসক অয়নাংশু নায়ক। কথা বললেন রুমি গঙ্গোপাধ্যায়।বহু চেষ্টার পরও সন্তান আসছে না। অগত্যা চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। এবং শেষে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুরু। আর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে একরাশ উৎকণ্ঠা ও অবসাদ। বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছেন এমন অভিজ্ঞতা অনেক দম্পতির।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৪১
Share:

বহু চেষ্টার পরও সন্তান আসছে না। অগত্যা চিকিৎসকের কাছে যাওয়া। এবং শেষে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা শুরু। আর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে একরাশ উৎকণ্ঠা ও অবসাদ।

Advertisement

বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছেন এমন অভিজ্ঞতা অনেক দম্পতির। সুপ্রজননবিদ ডা গৌতম খাস্তগীর জানালেন, ‘‘ভাল ফলের আশা নিয়ে দম্পতিরা যেমন আসেন, সঙ্গে করে নিয়ে আসেন একরাশ উৎকণ্ঠা। শুধু ওষুধে কাজ হবে? না কি আইভিএফ-এর সাহায্য নিতে হবে? প্রথম চেষ্টায় সন্তান আসবে? না কি বার বার চেষ্টা করে যেতে হবে? ব্যথা লাগবে না তো— এমন হাজারো চিন্তা। সে সব ভয়-দুশ্চিন্তা পুষে রাখতে রাখতে এক সময় মানসিক সমস্যা হয়ে যায়।’’

উদ্বেগের ফল কেমন, তারই একটা নমুনা দিলেন ডা. খাস্তগীর। প্রতিষ্ঠিত এক ভদ্রলোক স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন আইভিএফ চিকিৎসার জন্য। প্রথম দিন তিনি ছিলেন হাসিখুশি, আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু যত দিন এগোতে থাকল, ভদ্রলোক ক্রমশ উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকলেন। প্রথম বারের চেষ্টায় স্ত্রী’র প্রেগন্যান্সি এল না। এর পর আরও দু’বার তাঁরা আইভিএফ করান। মুষড়ে পড়েন ভদ্রলোক। দাড়ি কামাতেন না। পরিষ্কার পোশাক পরাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। চেম্বারে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতেন। তিন বার চেষ্টার পর তাঁদের সন্তান হয়। যে দিন জানতে পারলেন, স্ত্রী কনসিভ করেছেন, সে মুখে আবার হাসি দেখা গেল।

Advertisement

মনোচিকিৎসক অয়নাংশু নায়কের কথায়, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে প্রথমেই স্ট্রেসকে প্রশ্রয় দিলে মুশকিল। স্ট্রেস শুরু হলে ক্রমে তা বাড়তেই থাকে। এমনকী অনেকের নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হতে থাকে।’’ আসলে প্রেগন্যান্সি আসার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, এমনটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেন না। তাই বাস্তবে যখন এ ধরনের সমস্যা হয়, তখন অনেকেই রীতিমতো ধাক্কা খান। বিশ্বাসই করতে পারেন না তাঁদেরও সমস্যা হয়েছে। বাচ্চা জন্মালোই না, তার আগেই না পাওয়ার দুঃখ। আমার সঙ্গে এমনটা কেন হল! এই প্রশ্নই মাথায় ঘুরতে থাকে।

এক ভদ্রমহিলা বন্ধ্যত্বের সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। তিনি জীবনে সব পরীক্ষায় সফল হয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কনসিভ করতে পারছেন না। বার বারই নিজের কেরিয়ারের সঙ্গে প্রেগন্যান্সির ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলছেন। জীবনে সব কিছুতেই এগিয়ে থেকেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি হেরে যাবেন, সেটাই মেনে নিতে পারছেন না। এটাই আলাদা করে চাপ তৈরি করছে। ফলে ডিপ্রেশন।

অথচ বন্ধ্যত্বের সমস্যা যে কারও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১২-১৫% দম্পতি এই সমস্যায় ভোগেন। এক বছর ধরে নিয়মিত সহবাস করার পরও যখন বাচ্চা আসছে না, তখন ধরা হয় বন্ধ্যত্বের সমস্যা রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ৮৬% দম্পতি যদি প্রতি এক দিন অন্তর অসুরক্ষিত যৌনজীবন করে থাকেন, তবে তাঁদের প্রেগন্যান্সি চলে আসে। দুই বছরে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯২%। ৫০ বছর আগে ধারণা ছিল মানসিক সমস্যার জন্যই মেয়েরা বন্ধ্যত্বে ভোগেন। বাস্তবে ৮০-৮৫% ক্ষেত্রে সমস্যাটা শারীরিক। নানা রকম চিকিৎসা রয়েছে এই সমস্যার। যার সাহায্যে বহু দম্পতি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন। বাকিরা সাফল্য পান অত্যাধুনিক চিকিৎসায়।

শুধুমাত্র মেয়েদের দোষ নয়

• বন্ধ্যত্ব শুধুমাত্র মেয়েদের দোষেই হয় না। ৩৩% ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের কারণ পুরুষদের শারীরিক সমস্যা। ৩৩% ক্ষেত্রে মেয়েদের শারীরিক সমস্যা। ১০-১৫% ক্ষেত্রে দু’জনেরই শারীরিক সমস্যা। ১৫-২০% ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের পেছনে কোনও কারণই খুঁজে পাওয়া যায় না।

• মেয়েদের মানসিক সমস্যার জন্য সাধারণত বন্ধ্যত্ব আসে না। ৮৫% ক্ষেত্রে এর পেছনে থাকে পুরুষ বা মহিলার শারীরিক কোনও সমস্যা।

• বন্ধ্যত্বের সমস্যায় আপনি একা ভুগছেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১২-১৪% দম্পতি বন্ধ্যত্বে ভোগেন।

• অনেকেই মনে করেন দত্তক নিলে বন্ধ্যত্বের সমস্যা মিটে যায়। প্রেগন্যান্সি চলে আসে। কিন্তু সবারই যে হবে তা নয়।

তবু ভয়!

আমি কেন পারব না! এই অতিরিক্ত চাপ পিট্যুইটারি গ্ল্যান্ডে ও হাইপোথ্যালামাস গ্ল্যান্ডগুলোতে চাপ ফেলে হরমোনের গন্ডগোল তৈরি করে। যা ক্ষতিই করে।

ডাক্তার-রোগীর দূরত্বও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সন্তানের আশায় এলাম, তার সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট না হলেই একটা ভয় গ্রাস করে। যেমন কাউকে হয়তো বলা হল ইন্ট্রা ইউটেরাইন ইনসেমিনেশন করতে হবে। এতে একটি বিশেষ সময়ে স্বামীর শুক্রাণু স্ত্রী’র শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপারটি ভালভাবে জানা না থাকলে প্রথমেই মনে হয়, এতে বুঝি খুব ব্যথা লাগবে। আবার স্বামী ভদ্রলোকটি উৎকণ্ঠায় থাকেন, ভুল করে যদি অন্য কারও শুক্রাণু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়!

ডা. খাস্তগীরের কথায়, ‘‘ভাল করে না বোঝালে নানা রকম মনগড়া ধারণা তৈরি হয়। আর তা থেকেই ভয়, দুশ্চিন্তা।’’ অর্থাৎ এক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের চিকিৎসার উন্নতি রোগীকে সাহায্য করার বদলে উল্টে তাঁদের মানসিক উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। তখন বন্ধ্যত্বের চিকিৎসাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

উৎকণ্ঠার পেছনে রয়েছে খরচের ধাক্কাও। তার ওপর চিকিৎসা সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা। ডা. খাস্তগীরের কথায়, ‘‘প্রতি বারে আইভিএফ চিকিৎসায় সাফল্য ৩০-৪০%। ৩ থেকে ৬ বার চেষ্টা করলে ৯৫% দম্পতি সাফল্য পাবেন।’’ সুতরাং প্রথম বারেই যে সন্তান আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। এ ক্ষেত্রে ফলাফল হতে পারে হয় হ্যাঁ, নয় না। মাঝামাঝি কিছু নয়। এত চেষ্টা, কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করে যে নিশ্চিত ভাবে বাচ্চা মিলবে, তা তো নয়। সেটাই প্রথম থেকেই দম্পতিকে টেনশনে রাখে। যারা খালি হাতে ফেরেন, তারাই গভীর হতাশার কবলে ঢুকে পড়েন।

বন্ধ্যত্ব নিয়ে মেয়েদের দোষারোপ করার ব্যাপারটা আজও রয়েছে। অনেক পরিবার এখনও বন্ধ্যত্বের জন্য মেয়েদেরকে দায়ী করে, পুরুষকে নয়। সন্তান আসছে না বলে ভেতরে ভেতরে টানাপড়েন, মুষড়ে পড়া। যা থেকে অবসাদ গ্রাস করে মানুষকে।

(বন্ধ্যত্বের বাকিটা পরের সপ্তাহে)

ডা. গৌতম খাস্তগীর: যোগাযোগ-৯৮৩০৬৬৬৬০৬

অয়নাংশু নায়ক: যোগাযোগ-৯৮৩০০৫৭৩২৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন