সংমেল: রং-রাখাল আয়োজিত প্রদর্শনী। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে
রং-রাখাল যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক একটি সংস্থা, তা-ই জানানো হয়েছে আমন্ত্রণপত্রে। এই দলের এক জন ভাস্কর ও পাঁচ জন চিত্রকরের প্রদর্শনী শেষ হল অ্যাকাডেমিতে। মোট ৩৬টি কাজ ছিল।
ভাস্কর শঙ্কর ঘোষের ভাস্কর্য সম্পর্কে বিস্তারিত বলার কিছু নেই। তাঁর বিপুল সংখ্যক কাজ মানুষ দেখেছেন ও জানেন। নতুন করে বলতে গেলে পুনরাবৃত্তি হবে। তা সত্ত্বেও যে দিকগুলো অবশ্যই আলোচনার যোগ্য তা হল, সলিড ফর্ম বা ভলিউম-সর্বস্ব কাজের পাশাপাশি ব্রোঞ্জেই একটু সরে এসে, তাকে সমতল পাতে আপাত হালকা ও অপেক্ষাকৃত পুরু চাদরে কিছু আলঙ্কারিক স্টাইল ও প্যাটার্নকে সমগ্র ভাস্কর্যের ভাবনায় মিশিয়ে তৈরি করেছেন বিবিধ ছন্দের বাতাবরণ। কখনও তাতে স্থাপত্যময় দণ্ডায়মান দেওয়াল বা ঘরবাড়ির আংশিক চরিত্রকে মূর্ত করেছেন ফাঁকফোকর তৈরি করে। কখনও বা কিছু মানুষের নানা ভঙ্গির নড়াচড়াকে প্রবল বাঙ্ময় করে তুলেছেন। দেওয়াল কিংবা দরজা-জানালার জালির ড্রয়িং সামগ্রিকতার সঙ্গে মিলেমিশে অনবদ্য স্টাইলে উপস্থিত। কিন্তু যখন ওই পাতকেই মুড়ে, ভিতরের শূন্যতা ও বড় বড় ফাঁক তৈরি করে দাঁড় করিয়েছেন কোনও ভাস্কর্য— মানুষের মূর্ত উচ্ছ্বাস যেন ছন্দোময় এক কাহিনি তৈরি করেছে। সেখানে ড্রয়িংয়ের প্যাটার্নে এসেছে আলিম্পনময় শৈলী। বহু মানব-মানবীর সংগঠন যেন কী এক উল্লম্ব স্বকীয়তায় নিজেই হয়ে উঠেছে ভাস্কর্যের অনন্য নিদর্শন! সলিড ফর্মেও ধ্রুপদী প্রত্নভাস্কর্যের সঙ্গে আধুনিকতার টেকনিক মিশিয়ে, ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ নিজের মতো করে রক্ষা করেছেন।
প্রবীণ পরমেন্দ্র গজ্জর বরোদার শিল্পী। সূক্ষ্ম লিনেন ক্যানভাসে ইনি অ্যাক্রিলিকে প্রজাপতি, পত্রপল্লব গুচ্ছ, উড়ে যাওয়া শুকনো পাতা...এই সব রূপবন্ধ নিয়ে অল্প রঙে কাজ করেছেন। হঠাৎ প্রজাপতির পাখার মধ্যে প্রোফাইলে সবুজ নারীমুখ এঁকে কী বোঝাতে চাইলেন? এ সব পেন্টিং আসলে ফলিতকলার মেজাজকেই প্রতিফলিত করে। তাই এ ধরনের কাজগুলিতে মুনশিয়ানা সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
ব্রাশে অ্যাক্রিলিক নিয়ে পটে লাগিয়েছেন বুবুন দাস। ফর্ম, ডাইমেনশন, স্টাইল, টেকনিক প্রতিষ্ঠা পায়নি ছবিতে। দাঁড়ানো বকের আদল বা আদিবাসী মুখ বা মুখোশের মতো কাজটিতে অভিব্যক্তি নজরে এল না। রঙের যথেচ্ছ ব্যবহারেও বিমূর্ততাকে ধরা যায়, যদি ছবি তৈরির প্রকরণকে ঠিক ভাবে আয়ত্ত করা যায়।
ভিত্তিচিত্রের টুকরো টুকরো কিছু রূপবন্ধের মতো সমস্ত পট জুড়ে খুব পরিশ্রমী কাজ করেছেন মিলন দাস। সবটাই জলরং। পরতের পর পরত রং লাগিয়ে, ধরে ধরে এক একটি কৌণিক ক্ষুদ্র ফর্মকে অন্যের থেকে আলাদা করেছেন। উপরে-নীচে বা পাশাপাশি প্রতিটি ছোট ঘনকবাদী রূপ একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, মাঝেমাঝেই সরু পটভূমির হালকা রেখাসদৃশ ভাগে অ্যান্টিলাইন তৈরি করে, গোটা ছবির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন এক প্যাটার্ন তৈরি করছে। এর মধ্যেই সাধু, বৃষ, মনুষ্য, ত্রিশূল ইত্যাদিকে প্রাধান্য দিয়েছে কম্পোজ়িশন। সঙ্গে আলো-আঁধারির দ্বৈত সহাবস্থানের মাঝেও জলরঙের দৃষ্টিনন্দন স্বচ্ছতাকে আশ্চর্য রকম আলোকিত করা হয়েছে। জলরঙের আস্তরণের এই পরম্পরায় মিলনের ছবি হয়ে উঠেছে মহার্ঘ!
অতিরিক্ত রঙের বিচ্ছুরণ ও তার গড়িয়ে পড়ার ধর্মকে একটি স্টাইলে বাঁধতে গিয়ে প্রবীর দাসের অনেকটা সচিত্রকরণধর্মী কম্পোজ়িশন হারিয়ে গিয়েছে। শরশয্যার ছবিতে দুর্বলতাই তাই প্রকট ওঁর লম্বা অ্যাক্রিলিকের ক্যানভাসে। স্কেচ পেনও ব্যবহার করেছেন প্রবীর। অসাধারণ পেন্টিং রানা দাসের। তাঁর ব্রাশিং, বর্ণজ্ঞান ও বর্ণ চাপানো দক্ষতার পরিচায়ক। বিমূর্তায়নের নির্দিষ্ট পাশ্চাত্য স্টাইলে বাড়িঘরের স্থাপত্যকে খুব মুনশিয়ানার সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন। আলোর ব্যবহার দেখার মতো। যখন বহু বিভক্ত ফর্মেশনে পটের গাঢ় ও হালকা রঙের জ্যামিতিকে প্রাধান্য দিয়ে, টকটকে লাল রঙে বিভাজিত করেন রচনার অসীম সৌকর্য, তখন কম্পোজ়িশনে দারুণ প্যাশন আর রিদম ঢুকে ছবিকে বড় প্রাণিত করে!
অতনু বসু