বাংলায় চিত্রিত শিবের উপাখ্যানের সাতকাহন

আর্লি বেঙ্গল, কালীঘাট পট, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায়, প্রাণকৃষ্ণ পাল-কৃত ২৯টি চিত্রকলা ছিল এই প্রদর্শনীর অঙ্গ।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

আখ্যান: ‘শিব ইন বেঙ্গল আর্ট’ প্রদর্শনীর কাজ

পুরাণে অজস্র কিংবদন্তি শুধু শিবকে নিয়েই। বাঙালির অন্যতম জনপ্রিয় উপাস্যই শুধু নন, শিব হলেন আসমুদ্রহিমাচল মানবজাতির কাছে অন্য দেবদেবীর তুলনায় সর্বোচ্চ স্থানটির অধিকারী। শিবের সৌম্যদর্শন রূপটি বাংলায় অতি প্রিয় ও পরিচিত। ‘শিব ইন বেঙ্গল আর্ট’ শিরোনামে সম্প্রতি এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল চিত্রকূট আর্ট গ্যালারি।

Advertisement

আর্লি বেঙ্গল, কালীঘাট পট, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায়, প্রাণকৃষ্ণ পাল-কৃত ২৯টি চিত্রকলা ছিল এই প্রদর্শনীর অঙ্গ।

প্রায় প্রতিটি ছবিতেই শিবকে জটাধারী সৌম্যদর্শন দেখানো হয়েছে। কখনও ধ্যানমগ্ন, কখনও দানগ্রহীতা, কোনওটিতে দেবীরূপী প্রায় নগ্ন নারীমূর্তিসম, কোনওটিতে দেবীর সম্মুখ ভাগে শায়িত, আবার কখনও বা ভিক্ষাপাত্র হাতে ত্রিশূলাশ্রিত এক মোহিনী রূপে।

Advertisement

আর্লি বেঙ্গল পর্যায়ের শিল্পীদের নামোল্লেখ না থাকলেও প্রায় সকলেই পুরাণের বিভিন্ন কাহিনির মুহূর্ত নিয়ে অতি যত্ন-সহ সংক্ষিপ্ত অথচ নিবিড় আলেখ্য রচনা করেছেন রং, রেখা, ছায়াতপ, আলো, অন্ধকার ও নানা আলঙ্কারিক প্যাটার্নে সমৃদ্ধ বৈচিত্রময় কম্পোজ়িশনে। পটভূমির ঘনান্ধকার নাটকীয়তায় শিবের উজ্জ্বল উপস্থিতি কাজগুলিকে বাঙ্ময় করে তুলেছে।

শিল্পীরা প্রায় সকলেই শিবকে একটি বিষয় হিসেবে দেখাতে গিয়েও বহু চরিত্রের সম্মিলন, দ্বৈত চরিত্রের সঙ্গে গভীর সমন্বয় এবং শান্ত-সমাহিত রূপের প্রাধান্যকেই জোর দিয়েছেন। ফলে নাটকীয় এক অনন্যসাধারণ পরিবেশ ছবিগুলিকে পরিয়ে দিয়েছে মহার্ঘ অলঙ্কার। তেমনই নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও প্রায়ান্ধকার প্রকৃতির মধ্যে সাদা পাহাড়ের বিরাজমান সৌন্দর্যকেও মিলিয়েছেন এক রোম্যান্টিক বর্ণ মিশ্রণের মায়াবী আলোয়।

একটি ছবিতে পিছনে সাদা পাহাড় বহু দূরে, সম্মুখ ভাগে অন্য পাহাড়ের নিম্নগামী প্রস্তর থেকে নেমে আসছে সাদা জলধারা— একেবারে সামনে বসে বৃহৎ জটাধারী, শ্মশ্রুগুম্ফপূর্ণ সাদা নধর দেহধারী শিব— ওই জলধারা যাঁর জটার পশ্চাতে দেখা যাচ্ছে, যাঁর বাঁ হাতে ত্রিশূল ও ডান হাতে লাল কোনও বস্তু, দু’পাশে ঘন আঁধার, ছবির নীচে বাঁ দিকে টকটকে লাল বর্ণে লেখা ‘রাগ ভৈরব’। ছবি হিসেবে অসাধারণ।

মকরবাহিনী গঙ্গা বা সিংহবাহিনী গৌরী— এ ভাবেও শিল্পীরা কল্পনা করেছিলেন তাঁদের ছবিতে। সদাশিব মূর্তিটিই যদিও বেশি প্রচলিত। এখানে একটি ছবিতে ডান দিকের দু’হাতে ডমরু ও ত্রিশূল, বাঁ দিকের একটি হাত উত্তোলিত, আর অন্য হাতে শিঙা, গলায় নৃমুণ্ডমালা, পরনে বাঘছাল। এই শিবের দীর্ঘ উড়ন্ত গুচ্ছ কেশদাম, কিন্তু তা রুদ্র রূপের ভয়াবহতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। বরং নৃত্যরত এই শিবের টানা দুই চোখ প্রতিফলিত করছে তাঁর শান্ত রূপকেই। অসামান্য একটি পেন্টিং।

অতি পরিচ্ছন্ন ভাবে কোথাও সন্ধ্যার আঁধার বা দিনের আলোর পরিবেশকে শিল্পীরা আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানে স্থাপত্য, নিসর্গ, পাহাড়শ্রেণি, গাছপালা বা আকাশ যে ভাবে বর্ণিত হয়েছে, ঠিক ততোধিক নৈপুণ্যেই চরিত্রগুলিকে ব্রাশিংয়ের ফিনিশিংয়ে বা আলঙ্কারিক বাহুল্যে উজ্জ্বলতর করেছেন।

বর্ণ অনুত্তেজক, কিন্তু মিহি একটি টোনে তাকে দৃষ্টিনন্দন করার চেষ্টা রয়েছে। কম্পোজ়িশন কোথাও যেন অণুচিত্রের ভারতীয়ত্ব প্রকাশ করে। আর্লি বেঙ্গলের কাজগুলিতে রবি বর্মার পেন্টিং ও কিছু ক্ষেত্রে ইউরোপীয় রেনেসাঁর স্টাইল ও টেকনিক প্রতিভাত হয়। কিন্তু কম্পোজ়িশন ও চরিত্র বর্ণনায় ভারতীয় ও বাঙালি মেজাজ পরিপূর্ণ।

নন্দলালের কালো তুলির কাব্যময় ছন্দের মতো শিবের পার্শ্বমুখটি বড় মায়াময়। যামিনী রায় তাঁর প্রথাগত রেখার পৌত্তলিক স্টাইলেই এঁকেছেন গণেশকে ক্রোড়ে ও স্কন্ধে নিয়ে যথাক্রমে বসা ও দাঁড়ানো শিব। দুজনেরই কালো শ্মশ্রুর আভাস বেশ গাঢ়। অবনীন্দ্রনাথ ও প্রাণকৃষ্ণ পালের জল রংও মনোগ্রাহী।

কালীঘাটের দু’টি ছবি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। তার মধ্যে একটি ছবিতে বাদামি পটভূমিতে অপেক্ষাকৃত সিক্ত জমিতে তুলির সংক্ষিপ্ত ছন্দের রেখায় বর্ণিত ষাঁড়ের উপরে ঈষৎ ঝুঁকে বসা শিব। শিবের ভঙ্গি ও মুহূর্তকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ইচ্ছাকৃত ভাবেই শিল্পী পটভূমির বর্ণের সঙ্গে বাহনকে প্রায় মিশিয়ে দিয়েছেন। আর অন্য ছবিটিতে দেবীর সামনে ভিক্ষাপাত্র বাড়ানো শিব দণ্ডায়মান। এখানে দেবীর লাল কাপড় ও বলয়ের রক্তিমতা সবুজের সঙ্গে বৈপরীত্য তৈরি করছে। সমগ্র কাজটি রূপায়ণের কমনীয়তা, তুলির টানটোন ও বর্ণের অনুজ্জ্বল ব্যবহার দেখার মতো।

আর্লি বেঙ্গল পর্যায়ের ছবিগুলিতে সোনালি বর্ণ ব্যবহারে রূপায়িত নানা অলঙ্কারখচিত দৃশ্যপট, প্রতি চরিত্রের নিখুঁত ফিনিশিং, অন্ধকারে আলোর চকিত দৃশ্যায়ন, বিভিন্ন কম্পোজ়িশনে রিয়্যালিজ়ম ও ড্রয়িংকে অপূর্ব সমন্বয়ে বাঁধা ও ঘটনাবলির অনুপুঙ্খময়তা চোখে লেগে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন