সমকালীন ভাবনায় শিল্পকলার সর্বভারতীয় ফসল

গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিড়লা অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ সর্বভারতীয় এক শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন।

Advertisement

অতনু বসু

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

ছকভাঙা: বিড়লা অ্যাকাডেমিতে হওয়া প্রদর্শনীর কাজ

গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিড়লা অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ সর্বভারতীয় এক শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করছেন। বর্তমানে তাঁরা প্রদর্শনীতে আধুনিক ভাবনাসমৃদ্ধ একটি সময় বা স্পেসকে ধরে নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুদূর অতীতের ঐতিহাসিক শিল্পসাহিত্য সৃষ্টির পর্বকে যথোচিত গুরুত্ব দানের পাশাপাশি, সমকালীন প্রতিভাবান শিল্পী এবং ভাস্করদের বিশিষ্ট কাজ নিয়ে একটি আলাদা পর্ব উপস্থাপিত করছেন। এ বারের কিউরেটর ছিলেন মুম্বইয়ের ন্যান্সি আদাজানিয়া এবং এই পর্বের বিশেষত্ব ছিল দু’টি। প্রথমটি ‘ইন দ্য ল্যান্ড অব ডাউনসাইড আপ: অদ্ভুত লোক’ এবং দ্বিতীয়টি সর্বভারতীয় শিল্পকলার বার্ষিক প্রদর্শনী।

Advertisement

প্রথমটিতে অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যে একটি ডায়লগকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা ছিল। সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’-এর ছড়া ও ছবি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘খুদ্দুর যাত্রা’র উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাভিমুখ। ‘অদ্ভুত লোক’ নামটিও গগনেন্দ্র-সৃষ্টিরই এক মহৎ উদাহরণ। এ ছাড়া রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বর্তমান সময়কে ধরারও অনেকটা চেষ্টা ছিল। এই পর্বে গগনেন্দ্রনাথ-সহ সতেরো জন শিল্পীর কাজ উপস্থাপিত হয়।

আবুল হিশাম সফ্‌ট প্যাস্টেলে অ্যাক্রিলিক-অয়েলের হুবহু অনুভূতি এনেছেন। অতুল দোদিয়ার কাজে উঁচু নিচু কাষ্ঠফলকের বিভ্রম দেখে প্রশ্ন জাগে, অবনীন্দ্রনাথের ‘খুদ্দুর যাত্রা’র অনুপ্রেরণা কি? জেব্রা, কলের গান ও অন্যান্য অনুষঙ্গের ছবিতে অনন্য স্বাদ! গগনেন্দ্রনাথের ‘অদ্ভুত লোক’ হাতুড়ি দিয়ে ছবি ভাঙতে উদ্যত। এটি এবং ‘যাতা-সুর’ দু’টি লিথোগ্রাফই বিখ্যাত। কে জি সুব্রহ্মণ্যমের প্রসিদ্ধ ‘চেয়ার সিরিজ়’, কবিতা-সমেত সাদাকালোর কোলাজ ও কালিকলমের অবিশ্বাস্য সব ড্রয়িং! চমকে দেওয়ার মতো কাজ মানসী ভাটের। এ ছাড়া সাক্ষী গুপ্ত, অরিজিৎ সেন, পলা সেনগুপ্ত, অর্চনা হান্ডে, সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রণবীর কালেকা, সাহেজ রাহাল, পুষ্পমালা চনকোর কাজকে যথেষ্ট প্রশংসনীয় বলতেই হয়। তবে ভীর মুনশি নরকরোটির গলায় ডিজ়াইন করা মোটা রঙিন বালা ও ফাইবার রেজ়িন, বার্নিশ, পেপার ম্যাসে, ক্লথ এবং থ্রেডের মাধ্যমে করোটিতে অসামান্য অলৌকিকত্ব আনতে রঙিন ফুলেল ডিজ়াইন সংবলিত যে কাজগুলি করেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য! যদিও এখানে অন্যান্য শিল্পীর সব কাজই আহামরি মনে হয়নি। অন্তত বার্ষিক প্রদর্শনীর শিল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিছু কাজ দ্বিধাহীন ভাবে বাদ দেওয়াই যেত।

Advertisement

অনন্যা দালাল মোট ছ’টি প্লেটে সভ্যতার বিধ্বংসী রূপকে ধরেছেন। যা মানবতা হত্যাকারী যন্ত্রবিপ্লবের ধারণায় ও মৃত্যুচেতনার রূপকে বড় সুন্দর এচিং। অনিল যাদবের পেন্টিং ‘গাঁধী রিটার্নস’ টেক্সচারাল কোয়ালিটি ব্যাপারটিকে প্রাধান্য দিয়ে টেকনিকের মুনশিয়ানায় উজ্জ্বল। ত্রিবাঙ্কুরের ছেঁড়া ম্যাপ সমেত জোরালো কম্পোজ়িশন ‘মুলক্কারাম’ এক দৃষ্টিনন্দন টেম্পারার কাজ! এতে প্রিন্টও ব্যবহৃত হয়েছে। এই কাজটি অনিরুদ্ধ পারিতের। বড় কাচের বাক্সে দশরথ দাসের অসামান্য সুদৃশ্য ড্রয়িংগুলি মিশ্র মাধ্যমে করা। বিরাট ক্যারিব্যাগে লাল পেঁয়াজ এবং নানা রকম ফল যথেষ্ট সুন্দর। তবে পলিথিনের স্বচ্ছতাকে আরও প্রাণবন্ত করা যেত ধনঞ্জয় ঘোষের অয়েল পেন্টিংয়ে। ধাতু, প্লাস্টিক, পলিথিন ও অন্যান্য দ্রব্যসহ চৌকো ফ্রেমে কিছুটা ডায়মেনশন তৈরির এক ধরনের বিভ্রমের মধ্যে আশ্চর্য কম্পোজ়িশনে বড় উপভোগ্য কাজ করেছেন হরিবাবু নাতেসান।

সাদাকালো ড্রয়িং, পেন-ইঙ্ক ও সেরামিক স্টোনওয়্যারের দীপ্ত ভাস্কর্য সংবলিত মৌসুমী রায়ের কাজটি এক অসামান্য নান্দনিক নিদর্শন। তেমনই প্রত্নভাস্কর্যের পরিশীলিত রূপে যেন নালন্দা বিহারের ভগ্নপ্রায় অবস্থাকেই মনে পড়ায় নীতিন দত্তের স্যান্ডস্টোন মাধ্যমের কাজটি। প্রতাপ চক্রবর্তীর পেন-ইঙ্কটি মনে রাখার মতো। প্রিয়া দাশের প্লাস্টার ও প্লাস্টিকের নির্মাণে ছোট ছোট দাঁত, ভুট্টার দানা এবং মাঝখান থেকে খাওয়া ভুট্টাটি বেশ লাগে। তবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ মনে হয়েছে ধাতু-সংবলিত নানা যন্ত্রাংশের টুকরো দিয়ে করা বিশাল এক জন্তুর মুখ! কলকব্জা, সাইকেলের চেন ও নাটবল্টু দিয়ে করা সুদীপ ঘোষের ঋদ্ধ এই কাজটি অসম্ভব শিল্পগুণসম্পন্ন এক ভাস্কর্যের নমুনা। রাজশ্রী নায়কের চারটি প্যানেল ড্রয়িংয়ে খুবই দৃষ্টিনন্দন ক্যাকটাস। রীতেশ ভোই প্রচুর খেটে অ্যাক্রিলিকে উঁচু উঁচু সূক্ষ্মতর ডিজ়াইন সদৃশ এক ধরনের প্যাটার্ন তৈরি করে, গোটা ক্যানভাসেই অলঙ্করণের এক সুচারু ঐতিহ্যকে বজায় রেখেছেন। এ ছাড়া শাদিকুল ইসলাম, সঞ্জীব বারুই, কে আর বাসবরাজাচার, সুধীরঞ্জন মহারথ, অমিত সরকার, শৌভিক বারুই, শুভজিৎ রায়, সরিফুল মণ্ডল, তাপস দাস,

বিক্রান্ত বিসওয়াসবিশে, তন্ময় রায়চৌধুরী, রাজশেখর তিপ্পানা, বিশ্বজিৎ মণ্ডল, তন্ময় মজুমদার প্রমুখ শিল্পীর কাজও যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন