Art Exhibition

ছকের বাইরে এক সজাগ দৃষ্টি

প্রদর্শনীর একাধিক কাজে এই জৈব সম্পর্কের রূপান্তর ধরা পড়ে। দেওয়ালে টাঙানো প্রতিটি ছবিই তাঁর আত্ম-অভিযাত্রার নীরব সাক্ষ্য।

পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:২৬
Share:

পুনরাবিষ্কার: গোবর্ধন আশের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম

শিল্প ইতিহাসে গোবর্ধন আশ (১৯০৭-১৯৯৬) এমন এক নাম, যিনি ‘আধুনিক’ অর্থকে নিজস্ব ছাঁচে নির্মাণ করেছিলেন। গ্যালারি ৮৮-এ তাঁর প্রদর্শনী ‘অ্যান আর্লি মডার্ন’ শিল্পীর সেই ভাষার পুনরাবিষ্কার।

ঔপনিবেশিক রিয়্যালিজ়ম কিংবা বেঙ্গল স্কুলের নিস্তরঙ্গ আধ্যাত্মিকতা— কোনওটারই অনুকরণ তিনি করেননি। বরং এই দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক প্রাণবন্ত ভিজ়ুয়াল ভাষ্য। রং, রেখা ও অনুভূতির সংলাপ, যেখানে মানবমূর্তি কখনও ধোঁয়াটে, কখনও দৃঢ়। আলো ও সময়ের ভিতর থেকে উঠে আসে মানসিক ভূদৃশ্য। রঙের গঠন, ব্রাশ স্ট্রোকের তাল ও রেখার সঞ্চালন— সবই যেন আত্মসংলাপ। হলুদ, বাদামি ও নীলের মৃদু ছোঁয়ায় সেখানে ফুটে ওঠে নাড়ির স্পন্দন।

প্রদর্শনীর একাধিক কাজে এই জৈব সম্পর্কের রূপান্তর ধরা পড়ে। দেওয়ালে টাঙানো প্রতিটি ছবিই তাঁর আত্ম-অভিযাত্রার নীরব সাক্ষ্য। এখানে কোনও আলঙ্কারিক জাঁকজমক নেই। আছে গভীর সংযম। প্রদর্শনীর বর্ণনা প্যানেলে লেখা অনুসরণ করে বলতে হয়, তিনি নিজেই যেন এক ধারা, এক চিন্তার পরম্পরা।

১৯৪৩ সালে গোবর্ধন আশ যখন ‘ক্যালকাটা গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন ভারতীয় শিল্পজগতে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। এই গোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য ছিল, ঔপনিবেশিক শিক্ষা এবং আধ্যাত্মিক নন্দনতত্ত্বের সীমা পেরিয়ে স্বতন্ত্র ভাষা তৈরি করা। শিল্পী আশ ছিলেন এই অভিযাত্রার অন্যতম প্রেরণা। তাঁর ছবিগুলি যদিও রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা সরাসরি বলে না। কিন্তু প্রতীকী ভাবে প্রশ্ন তোলে, মানুষের অবস্থান আসলে কোথায়?

শিল্পী আশের ব্রাশ কখনও স্থির নয়। যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ড্রয়িং, তেমনই তার প্রাণ। তারা চলমান, কর্মব্যস্ত। কখনও ক্লান্ত অথচ অবিচল। শ্রমিকের মুখের রেখা, কৃষকের দেহের গঠন বা নারীর ভঙ্গিমায়, ফ্রেমের বাইরেও জীবনের তাপ ছড়িয়ে দেন। তিনি জানতেন, আসল রূপ লুকিয়ে আছে প্রাত্যহিক জীবনের গন্ধে। ছবিতে দেখা যায়, শ্রমিকের পিঠে তির্যক ভাবে আলোর ব্যবহার। রঙের ঘন টানে আলোর গঠন দেহের সঙ্গে মিশেছে। এখানে ‘আলো’ দৃষ্টির উপাদান নয়। এটি শ্রমের দীপ্তি, যা অন্ধকার ভেদ করে ওঠে।

হুগলি জেলার বেগমপুরে এক কৃষক পরিবারে জন্ম গোবর্ধন আশের। অনেক কষ্টের মধ্য দিয়েই তাঁকে যেতে হয়েছিল ছোটবেলায়। উনিশ বছর বয়সে কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। পরবর্তী কালে মাদ্রাজ আর্ট স্কুলে শিখতে যান। কিন্তু ধরাবাঁধা শিক্ষায় তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ফলত, তাঁর ভাবনা ও আঙ্গিক ক্রমাগত বদলে গিয়েছে।

গ্যালারির দু’টি তল নিয়ে আপ্যায়িত ছবির সংখ্যা ছিল একশোর উপর। প্রথমেই নজরে আসে ইয়েলো অকার বেসড আশির দশকের কিছু ল্যান্ডস্কেপ চিত্র। ম্রিয়মাণ রঙেও শব্দমুখর হয়ে ওঠে জীবন। জমি জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কর্মব্যস্ত প্রান্তিক মানুষ। জলরং-এ অপেক্ষাকৃত গাঢ় টোনের ছন্দোময় পোঁচ ছিল দেখার মতো।

শিল্পী আশের কাজে শ্রমের মুহূর্ত নতুন রূপ পায়। যেমন গোয়াশের তিন সাঁওতাল নারীশ্রমিক। সাদা-নীল সাপোর্টে বাদামি রেখার সীমানা আত্মমর্যাদার ফণা তোলে। এ রকমই আর একটি ছিল কাগজের উপরে গোয়াশ নির্মিত ‘ট্রাইব’ দম্পতি। সাদা ওপেকের জমিতে বাদামি শরীর এবং সবুজের মৃদু স্পর্শ। অদ্ভুত ভাবে ছবিটি আর ছবি থাকে না, আদি-অকৃত্রিম স্বচ্ছতাকে তুলে ধরে।

বাংলার গ্রামীণ চিত্রে সবুজ-লালের সংঘাতে শ্রমের আগুন ফুটে ওঠে। আবার কখনও সামান্য সবুজ,নীল, হলুদে দাপিয়ে বেড়ায় জীবনের দাবি। শিল্পী বিশদ বর্ণনাকে পরিহার করে, বেছে নিয়েছেন ঘূর্ণাবর্ত রঙের খেলা। নির্দিষ্ট কোনও ফর্মুলার পথে না গিয়ে, রং ও ব্রাশের স্বাধীনতাকে আপন গতিতে ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন ‘ডান্স অব লাইট’ (গোয়াশ), ব্রাশওয়ার্কে ‘রিভার সরস্বতী’, আল্ট্রামেরিনের ‘বেদুইন’।

আশের ব্যবহৃত কাগজের রং এককথায় সাহসী, জটিল অথচ সুরেলা। একটি রং-কে কেন্দ্র করে, দু’তিনটি রঙের ঘন সংলাপ এমন ভাবে চালনা করা, চরম আধুনিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। যেমন গোয়াশের ‘প্রেগন্যান্ট’ জননী। পাশ্চাত্য শিল্পের আধুনিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কাজ। ব্রাশ-ওয়ার্কের আর একটি স্পর্ধিত নমুনার চিত্র ‘প্রোলেতারিয়েত’। রেখার এক টানে একাধিক মুখের অভিব্যক্তি। প্রদর্শনীর ‘রিহার্সাল’ ও ‘রেভোলিউশন’ ছবির গাঢ় রং ও দৈহিক ফর্মে সমমর্যাদার প্রস্তুতি উঠে আসে। শিল্পীর চলাচল ঘিরে তৈরি হয় প্রান্তিক ঘরের কাহিনি। যেমন, ‘অ্যাফেকশন’, ‘মাদার উইথ ডটার্স’ এবং ‘ওল্ড এজ হোম’, ‘হোমলেস’। অসহায় অবস্থানের প্রতি শিল্পীর মর্মস্পর্শী অনুধাবন গেঁথে যায় আমাদের মনেও।

প্রদর্শিত ছোট ছোট কাজগুলি সহজেই মনের দরজা খুলে দেয়। দর্শক প্রবেশ করেন সেই অভ্যন্তরীণ পৃথিবীতে। যেখানে প্রতিটি রেখা জীবনের অনুবাদ। গোবর্ধন আশ শিল্পে রেখে গিয়েছেন এক গভীর দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর কাজ প্রমাণ করে, চরিত্রের অনমনীয়তা। সম্পূর্ণ ছকের বাইরে এবং আপসের বাইরে তাঁর একান্ত অনুভব। এই প্রদর্শনী তাই অতীতের স্মরণ নয়, এক বর্তমান প্রশ্নও বটে। আমরা কতটা স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারি, কতটা সাহস করে নিজেদের আধুনিকতা গড়ি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন

এটি একটি প্রিমিয়াম খবর…

  • প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর

  • সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ

  • সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে

সাবস্ক্রাইব করুন