Painting Exhibition

নন্দলালের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নান্দনিক বীক্ষণমালা

নন্দলালের শিল্পচর্চা ও শিল্পভাবনা ইতিমধ্যেই বহু ভাবে বিশ্লেষিত ও আলোচিত। ভারতবর্ষে আধুনিক শিল্পচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর অবদানও আজ সর্বজনস্বীকৃত।

Advertisement

সোহিনী ধর

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৩ ০৭:১০
Share:

কলাকৃতি: ‘আকার-প্রকার’ গ্যালারিতে নন্দলাল বসুর চিত্রকর্ম।

যে কোনও দৃশ্য, ছবি বা সঙ্কেত মাত্রই তা অক্ষর বা শব্দের চেয়ে বেশি আবেদন রাখে। কারণ, সেটি তখন থাকে কল্পনার নির্যাসে সিক্ত। সম্প্রতি ‘আকার প্রকার’ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল নন্দলাল বসুর তেমনই কিছু বিরল, পোস্টকার্ডে আঁকা মোট ৮৯টি ছবি, চিঠি ও খবরের কাগজের কাটিং-সহ অসাধারণ এক প্রদর্শনী।

Advertisement

নন্দলালের শিল্পচর্চা ও শিল্পভাবনা ইতিমধ্যেই বহু ভাবে বিশ্লেষিত ও আলোচিত। ভারতবর্ষে আধুনিক শিল্পচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে তাঁর অবদানও আজ সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু ইদানীং দেশ-বিদেশ জুড়ে তাঁর স্নেহধন্য বহু ছাত্রছাত্রী ও ব্যক্তিসমূহের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে খুঁজে অদেখা, অজানা ছবি নিয়ে এ জাতীয় প্রদর্শনী নেহাতই বিরল। তাই শিল্প সমালোচক ও লেখক দেবদত্ত গুপ্তের এই আবিষ্কার ও অদম্য প্রয়াসে এর আয়োজন বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে।

আমরা কখনওই শুধু কোনও জিনিস দেখি না। বরঞ্চ আমরা সর্বদা বস্তুটির সঙ্গে তার এবং নিজের এক সংযোগকে দেখে থাকি। নন্দলাল ছিলেন তেমনই এক শিল্পী, যিনি তাঁর দেশ, কাল, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির সংযুক্তিকরণ করেই তাঁর অনির্বচনীয় রূপের ভাণ্ডার তৈরি করে গিয়েছেন। নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের পরশে শিল্পকে এক চিরস্মরণীয় রূপ দিয়েছেন। তদানীন্তন ইংরেজ আমলের পরাধীন ভারতবর্ষে সনাতন ভারতীয় শিল্পশাস্ত্র ও শৈলীর নবীকরণ করে, তিনি ভারতশিল্পকে এক নতুন মানে উন্নীত করেছেন।

Advertisement

নন্দলাল বহু মাধ্যম ও বহু আয়তনে কাজ করেছেন। কখনও মুরাল বা ভিত্তিচিত্রের মতো বিশাল পরিধি থেকে শুরু করে, একেবারে অণুচিত্রের পরিসরে তাঁর ছিল অবাধ গতিবিধি। এই প্রদর্শনীতে তেমনই কিছু পোস্টকার্ডে আঁকা ক্ষুদ্রকায় ছবির পরিচয় আমরা পাই। কখনও কালি-তুলি, কখনও ওয়াশ, কখনও কোলাজ বা প্রিন্ট মাধ্যমে তাঁর এই ড্রয়িংগুলি এক প্রকারের ‘ভিসুয়াল নোট’-এর মতো। দর্শককে অভিভূত করে। এ যেন জাপানি হাইকু কবিতার মতো, সংক্ষিপ্তের মধ্য দিয়ে ব্যাপ্তির এক অনুরণনসম।

কলাকৃতি: ‘আকার-প্রকার’ গ্যালারিতে নন্দলাল বসুর চিত্রকর্ম।

আমরা জানি, নন্দলাল তাঁর সৃষ্টিকর্মে দূর প্রাচ্যের দর্শনে বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ওকাকুরার ভাবাদর্শে উদ্দীপ্ত হয়ে তিনি প্রকৃতি, পরম্পরা ও স্বকীয়তা— এই ত্রয়ী ভাবনার সমন্বয়কে নিজের ভাবনার প্রধান উপপাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন ও সে কালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সেই ভাবনার সম্প্রসারণ ঘটান। এই প্রদর্শনীর প্রায় প্রতিটি কাজেই সেই রূপকল্পের এক অপরূপ পরিচয় পাওয়া যায়।

সীমার মাঝে অসীমের যে আস্বাদ, তা এই সংক্ষিপ্ত চিত্রণগুলির মধ্য দিয়ে তিনি অনবদ্য ভাবে ব্যক্ত করেছেন। কোথাও তিনি তাঁর স্নেহের নাতনিকে, কোথাও ছাত্রীকে, কোথাও বা তাঁর সহকর্মীকে সম্বোধন করে আঁকা এই পোস্টকার্ডগুলি আশ্চর্যজনক ভাবে যেন আজকের দিনের প্রযুক্তিনির্ভর সংক্ষিপ্তসার সংযোগের এক পূর্বাভাস তুলে ধরে। এ যেন বর্তমান যুগের এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপ-এর প্রাক পর্বের এক শৈল্পিক অনুসন্ধান। সংক্ষিপ্ত পরিসরে সুনিশ্চিত, দৃঢ় কিছু রেখা, রং ও বলিষ্ঠ তুলিচালনা— যা নাকি দূর প্রাচ্যের ক্যালিগ্রাফির সমতুল্য, তাই দিয়ে কখনও খেজুর গাছ, গরুর গাড়ি, সাঁওতাল রমণী, সমুদ্রতট বা খোয়াইয়ের মতো বহু বহু রূপ ফুটিয়ে তুলে, প্রাপকের সঙ্গে এক সংযোগ স্থাপন করেছেন।

স্বল্প বা ক্ষুদ্রের মধ্যেই যে বৃহত্বের নির্যাস লুকিয়ে থাকে, অণুর মাঝেই যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব নিমজ্জিত, তার প্রত্যক্ষ পরিচয় দেয় এই ছবিগুলি। কয়েকটি কাজে আবার চিত্রের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সংলাপ চিত্রভাষাটিকে আরও পূর্ণতা দিয়েছে।

নন্দলালের শিল্পীজীবনে সেই সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকতার এক তীব্র সংশ্লেষ বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গান্ধীজির আমন্ত্রণে তাঁর হরিপুরা পোস্টারসমূহ, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শের ব্রত ও শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্ম চেতনায় দীক্ষিত হয়ে, ভারতীয় দর্শন ও পরম্পরাগত জীবনবোধের এক বলিষ্ঠ ত্রিভুজাত্মক শিল্পচেতনার কাঠামো তিনি নির্মাণ করেছিলেন। সৃষ্টিলীলায় যা নাকি ছিল আনন্দের অনুসন্ধান। এই প্রদর্শনীর প্রায় প্রতিটি কাজের মধ্যে সেইআস্বাদ প্রতিভাত হয়। আয়তন বা পরিধিই যে কোনও ছবির মান নির্ণয় করে না, এই অনবদ্য ক্ষুদ্রাকার ছবিগুলি তার জাজ্বল্যমান উদাহরণস্বরূপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন