ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
পত্রিকা: রাষ্ট্রশক্তির নৈকট্য আপনি এড়িয়ে চলেছেন সারাজীবন। কিন্তু এই মুদ্রার একটা উল্টো পিঠও তো আছে। প্রতিবাদ করা। আপনি প্রতিবাদ করেছেন কখনও সখনও। নন্দীগ্রামের সময়ে যেমন।
শীর্ষেন্দু : আমি ক্ষীণ প্রতিবাদ করেছি। আমি জানি একটা কথা। রাম আসুক, রহিম আসুক, যেই আসুক.... কেউই তো পাওয়ারে এসে ভাল কিছু করেনি! এত দিন ধরে এটাই তো দেখছি।
পত্রিকা: অ্যাবসোলিউট পাওয়ার কোরাপ্টস্ অ্যাবসোলিউটলি।
শীর্ষেন্দু: তাহলেই বলো, আমরা কার প্রতিবাদ করব? তোমাদের চ্যানেলেই মাঝে মাঝে শুনি, নানা জন এসে নানা ভাল ভাল কথা বলছেন। তাঁদের নিজেদের জমানায় তাঁরা এসব কথা বলেছেন?
পত্রিকা: হ্যাঁ। আর যাঁরা ক্ষমতায় আসেননি, তাঁরা যদি কোনও দিন ক্ষমতায় আসেন, এই ভালভাল কথাগুলো মনে রাখবেন?
শীর্ষেন্দু: ঠিকই, রাজনীতি আমি অনেক দেখেছি। এ দেশের যে দলীয় রাজনীতি, তা থেকে যে কোনও ভদ্রলোকেরই দূরে থাকা উচিত। কারণ তিনি পারবেন না এটার মধ্যে থাকতে। আর তিনি যদি এটার সঙ্গে লড়ে যেতে পারেন, তাহলে সেটা খুব ভাল। আমি সুনীলকে বলেছিলাম, ‘এই বিপদে যে শুধু আপনি একাই পড়ছেন তা নয়, আমাদেরও ফেলছেন।’ তার কারণ হচ্ছে এই যে লোকে আমাকে, সুনীলকে ব্র্যাকেটেড করে ফেলেছিল। মানে, ওরা ভাবতেন, সুনীলবাবু যখন এটা করছেন...
পত্রিকা: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও তাহলে এটাই করছেন...।
শীর্ষেন্দু: হ্যাঁ। ওঁরা তো একই সঙ্গে আছেন। আমি সুনীলকে বললাম, ‘আপনি সিপিএমকে সাপোর্ট করেন...ঠিক আছে। কিন্তু আপনি আর দিব্যেন্দু কোন আক্কেলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে গাড়িতে বেরোলেন? এটা তো আপনার কাজ নয়। আপনি কেন নির্বাচনী প্রচারে বেরোবেন?’ আমি যখন মিছিলে হেঁটেছিলাম, সেদিন আমি তো কোনও রাজনীতি করিনি। আমার যা মনে হয়েছে, আমি করেছি। আমি একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি। একটা গভীর দুঃখ থেকে, বেদনা থেকে আমি সেই মিছিলে হেঁটেছিলাম। রাগও হয়েছিল। পরে ভাবলাম কার ওপর রাগ করব? এটা তো একটা সিস্টেম। সিস্টেমের উপর রাগ করে কী হবে?
পত্রিকা: শীর্ষেন্দুদা, আপনার তো প্রায় আশি হল।
শীর্ষেন্দু: হ্যাঁ, আশিতে ঢুকে গেছি। পূর্ণ হয়নি এই পর্যন্ত।
পত্রিকা: আপনাকে এটার গ্রাফ আঁকতে দেওয়া হলে কী ভাবে বর্ণনা দেবেন নিজের আশি বছরের যাত্রাটার?
শীর্ষেন্দু: (হাসি) আসলে খুবই সাধারণ একটা জীবন কাটিয়েছি আমি। আমার জীবনে খুব একটা নাটক নেই, ওঠাপড়া নেই। আমার একটা মায়া আছে। মায়া বলো, ভালবাসা বলো। এটা কখনও কখনও আমাকে পীড়াও দেয়। ভালবাসা না থাকলে জীবনটাকে উপভোগ করা যায় না। ভালবাসাটুকুকে সম্বল করেই বাঁচি। বাবা যখন মারা গেলেন, কাছে ছিলাম না। খবর পেয়ে চলে এলাম। শ্মশানে দেহ শোয়ানো আছে। চিতা সাজানো হচ্ছে। আমি বাবার কপালে একটা চুমু খেলাম। তারপর উচ্চারণ করেই বললাম, ‘আমি যে তোমায় কত ভালবাসতাম, তা তুমি কখনও টের পেয়েছিলে?’ বাবা খুব রাশভারী লোক ছিলেন। এই মায়াটা...বাবার সঙ্গে ভালবাসাটা তো প্রকাশ করিনি কোনও দিন। বাবাকে গিয়ে ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’ এই কথাটা বলা খুব নাটকীয়, বলা যায় না। ভালবাসার নানারকম প্রকাশ আছে। কিন্তু সেই সময় বলেই ফেললাম— ‘আমি তোমায় কত ভালবাসতাম।’... ওই মায়াটা আছে আর কী....!
পত্রিকা: আধ্যাত্মিকতার যে রাস্তাটা আপনি বেছেছেন, এত বছর ধরে সেই রাস্তায় চলেছেন— এটা কি বিশেষ কোনও ঘটনার পর?
শীর্ষেন্দু: ছেলেবেলা থেকেই জিনিসটা হয়তো আমার ভিতর ছিল। একটা মেলাঙ্কলি ছিল আমার ভিতরে। পাঁচ বছর থেকে...। হঠাৎ করে আমার চারপাশটাকে কেমন যেন আনরিয়াল মনে হত। চারপাশের জিনিসগুলি আর আইডেন্টিফাই করতে পারছি না....জিনিসগুলি অচেনা হয়ে গেল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এরও হত। বড় হতে হতে এক একটা সময় কোনও একটা বিষয়কে নিজের কাছে বাস্তব প্রতিপন্ন করার জন্য রাস্তার ধারে বসে পাথর দিয়ে নিজের হাতে মারতেন। এটা যে বাস্তব, সেটা নিজেকে অনুধাবন করানোর জন্য। কেমন পাগলের মতো একটা অবস্থা হত আমারও। কেন হচ্ছে, কী হচ্ছে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এই যে আমার চারিদিকের সঙ্গে আমার একটা বিচ্ছিন্নতা এসে গেল, তখন দৌড়ে আমি মায়ের কাছে গেলাম। সব বললাম। মায়ের তখন ভয়, ছেলে বোধ হয় পাগল হয়ে যাবে। সাধু ডেকে নানা রকম তাবিজ-কবচ ধারণ করালেন, নানা রকম তুকতাক এসব। আমি পরেওছি ওইসব, কাজ হয়নি। তবে বিষয়টা কিন্তু রয়েই গেল। আমি যখন আইএসসি পড়ি। বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে আমার মধ্যে প্রায় একটা বিকার চলে এসেছিল। আইএসসি পড়া বন্ধ করে বাড়ি চলে আসতে হল। এই সময় মা আমার পৈতে দিতে বললেন। পৈতে হওয়ার পর আশ্চর্য ভাবে এই বিকারটা চলে গেল। তবে পরে কলকাতায় এসে পড়ার সময় আমার একবার এটা হয়েছিল। গভীর একটা অবসাদ। বয়স তখন আঠাশ-উনত্রিশ। মনে হচ্ছিল সব শেষ। এই দীর্ঘ অবসাদ এমন জায়গায় নিয়ে গেল যে আমি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন যেন স্বস্তি পেলাম। যাক একটা তো উপায় হাতে আছে। এখনও মাঝে মাঝে হয় না তা নয়। তবে আর কাহিল করে ফেলতে পারে না। নিস্তারটা পেয়ে গেলাম। তবে মেলাঙ্কলি আমাকে অনেকটা দিয়েওছে। ওই রকম মেলাঙ্কলি আমি আমার একটি চরিত্রটিকে দিয়েছিলাম, ‘দুঃখরোগ’ বলে একটা গল্পে। চরিত্রটা ওই গল্পে একটা পোকা মেরেছিল দেওয়ালে। একটা দাগ হয়ে গেল। এই ঘটনাই ঘুরে ফিরে তাড়া করে ফিরল চরিত্রটাকে।
পত্রিকা: অনেক সাহিত্যিকই তো শুধু যে প্রেমের কথা লিখেছেন এমনটা নয়, বার বার প্রেমেও পড়েছেন। সেটা কি আপনাকে বিকর্ষণ করেছে, নাকি আপনি উদাসীন ছিলেন?
শীর্ষেন্দু: না, উদাসীন ছিলাম না। আমার গ্রহানুসারে আমি জন্ম-রোম্যান্টিক। একেবারে হামাগুড়ির শৈশব থেকে বুড়ো বয়স পর্যন্ত আমার রোম্যান্স চলার কথা। আমি রোম্যান্টিক ঠিকই কিন্তু মনে মনে। স্কোপ হয়তো ছিল, কিন্তু সাহস ছিল না। মেয়েদের সঙ্গে খুব সহজে বন্ধুত্ব হত না সে সময়ে। ক্লাসের পর মেয়েরা কমনরুমে চলে যেত, আবার ক্লাস শুরু হলে আসত তখন। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়.... রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতার মতো, ‘মরেছি হাজার মরণ’— প্রায় সময়ই প্রেমে পড়ে যেতাম। মুখ ফুটে কোনও দিন কাউকে কিচ্ছু বলিনি। কোনও দিন কাউকে কোনও প্রেমপত্র লিখিনি। (হাসি)
পত্রিকা: আপনি প্রেমপত্র লেখেননি, কিন্তু বাঙালি প্রেম পেলেই কবিতা লেখে। আপনি সারাজীবন গদ্যই লিখে গেলেন, কবিতা লিখলেন না কেন?
শীর্ষেন্দু: আমি কবিতা লিখতে পারিনি কখনও। চেষ্টা যে করিনি ছেলেবেলায় তা নয়। অল্প বয়সে চেষ্টাও করেছি। কিন্তু দেখলাম, কবিতাটা আমার দ্বারা হবে না। পড়েছি। পড়ে চলেছি। আর অন্যদের কবিতার ছন্দের ভুল ধরে দিয়েছি।
পত্রিকা: আপনার কিছু সৃষ্টির বিশ্বব্যাপী আবেদন। কিন্তু আপনি গ্লোবালি নিজেকে তুলে ধরতে চাননি। পাঠক হিসেবে কিন্তু একটা অভিযোগ, বাঙালির একান্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু অন্য ভাষায় নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাননি।
শীর্ষেন্দু: দ্যাখো, আমি জানিই যে বাঙালির পক্ষে খুব বেশি স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। একটা লিমিটেশনের মধ্যে থাকতে হবে। কারণ, বাংলা গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ নয়। সলমন রুশদি বলেছেন ভারতীয় ভাষাগুলোয় তেমন কিছু লেখা হচ্ছে না। বাজে কথা। বরং ভারতীয় যে সব লেখক ইংরেজিতে লিখছেন, তাঁরাই তেমন কিছু লিখছেন না। খুব নামকরা বাঙালি বা ভারতীয়রা যাঁরা ইংরেজি লিখছেন, তাঁরা ভাল লিখছেন ঠিকই কিন্তু তাঁরা ন্যারেশন ছাড়া আর কিছু করেননি। কোনও এক্সপেরিমেন্ট নেই, এক্সপেরিমেন্ট করার সাধ্যও নেই। কারণ ইংরেজি তাঁর মাতৃভাষা নয়।
পত্রিকা: আপনার কখনও আফশোস হয় না, আপনার ভাষাটা যদি ইংরেজি হত, তাহলে অন্য অনেকের চেয়ে বেশি খ্যাতি পেতেন?
শীর্ষেন্দু: না, সেটা আমার মনে হয় না একটা কারণে। এই সব নোবেল প্রাইজ-টাইজ আজকাল লোক বুঝে দেওয়া হয়। ঠিক মতো বিচার করে সেরা লোকটিকে দেওয়া হয় না। কনসিডারেশন-এ দেওয়া হয়। তাছাড়া টাইম ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিনের অনেক প্রভাব প্রতিপত্তি আছে। ওগুলো নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তবে এখন যে সব বাঙালি ছেলেমেয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ে, তারা মনে করে ওটাই শ্রেষ্ঠ। তবে তারা তাদের মাতৃভাষার দিকেও একটু তাকাতে পারে। আমরাও তো ইংরেজি পড়ি। না পড়ে যাব কোথায়? স্টেইনবেক বলে একজন আমেরিকান সাহিত্যিক আছেন, বেষ্ট সেলার, পৃথিবী বিখ্যাত। কিন্তু আমি ওঁর লেখায় যে কত ভুল খুঁজে পাই, হাসি পেয়ে যায়। নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেলেন। কিন্তু কী করা যাবে? ইংরেজিতে লেখেন বলে, প্রভাবশালী বলে!
২০০৩, এক ফুটবল-আড্ডায়। ছবি: তপন দাস
পত্রিকা: শীর্ষেন্দুদা, আপনার অনেকগুলো লেখা থেকে ফিল্ম হয়েছে। লেখক হিসেবে আপনি কতটা উৎসাহ পান ফিল্মগুলো দেখার?
শীর্ষেন্দু: আমি সাধারণত ফিল্মগুলো দেখতে যাই না। যদি ধরে-বেঁধে নিয়ে যায় তাহলে আলাদা কথা। ফিল্ম তো একটা অন্য মাধ্যম। ছবিটা যখন হচ্ছে, তখন ছবিতে পরিবর্তন তো কিছুহবেই। উপন্যাস তো পুরোপুরি সিনেমায় আসবে না। তবে আমার কাছেকেউ আমার কাহিনি থেকে ছবি বানানোর পারমিশন চাইলে আমি পারমিশন দিয়ে দিই। দেখতে উৎসাহী হই না কারণ হয়তো ভাল লাগবে না। মতামত চাইলে কী বলব তখন? এমনিতে সিনেমা জিনিসটা আমি ভাল বুঝি না। তবে মনে হয় সিনেমা আর সাহিত্যের মধ্যে খুব একটা সংযোগ নেই। সিনেমাটা সাহিত্যের নিরিখে ভাল হল কিনা এটা বিচার্য নয়, বিচার্য হল সিনেমাটা কত ভাল সিনেমা হয়ে উঠতে পারল। সাহিত্যকে মনে রেখে বিচার করতে গেলে তো মুশকিল।
পত্রিকা: আপনার কোনও দিন মনে হয়নি আপনার চিত্রনাট্যটা লেখা উচিত?
শীর্ষেন্দু: অনেকে বলেছেন আমায়। কিন্তু এই ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় আসে না। পেরে উঠি না। সুনীল করেছে বটে। দিব্যেন্দুদা করেছে। আমি করিনি,ভয় পেয়েছি। জগৎটা যখন চিনি না, তখন পা না বাড়ানোই ভাল। পথের পাঁচালী ছবি হয়েছে। ভাল ছবি। কিন্তু পথের পাঁচালী-র সবটুকু তো আসেনি। তবে ঘ্রাণটা আছে, সেই গাঁ-গঞ্জ, দারিদ্র, অপুর রূপ-মুগ্ধতা, সাদাকালোতেও ফুটিয়ে তুলেছেন। সেজন্য এই ছবিটা সাহিত্যের থেকে আলাদা ভাবে বিচার্য। সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করে যদি দেখতে চাও তাহলে ‘পথের পাঁচালী’-তেও বিচ্যুতি পাবে।
পত্রিকা: ‘জলতরঙ্গ’ আপনার প্রথম গল্প। এর প্রায় দশ বছর পর আপনি প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’ লিখলেন। এত দেরি কেন হল গল্প থেকে উপন্যাসে উত্তরণে?
শীর্ষেন্দু: উপন্যাসটা আসলে তখন আমাকে কেউই লিখতে বলেননি। সাহিত্যের জগতে তখন রথী-মহারথীরা বিরাজ করছেন। বিমল কর, সন্তোষকুমার ঘোষ, বিমল মিত্র, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়— কত নাম করব? তখন আমরা কোথায়? আমাদের কেউ পাত্তাই বা দেবে কেন? সুতরাং আমাদের জায়গাই ছিল না। সুনীলকে প্রথমে বলা হল উপন্যাস লিখতে। সিক্সটি সিক্সে সুনীল বোধ হয় ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখল। বরেন গাঙ্গুলি ছিল আমার বন্ধু। সুনীলের উপন্যাস বেরোনোর পরের বছর সাগরদা আমাকে ডেকে বললেন, ‘শীর্ষেন্দু শোনো, তোমাদের দু’জনের মধ্যে একজন উপন্যাস লিখবে।’ আমি তো হাঁ করে ভাবছি এ আবার কী রকম প্রস্তাব। পরের দিনটা রবিবার ছিল। আমি রাতে বরেনকে ফোনে ধরলাম। বললাম ‘ভাই তুই লেখ।’ সেই বছরটা আমার সত্যিই অসুবিধে ছিল। একটা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। বরেন বলল, ‘আমি এটা পারব না। আমার বাড়ির ঝামেলা আছে।’ যাই হোক, এই নিয়ে খানিকক্ষণ আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হল। বরেন বলল, ‘দেখ এই সুযোগটা হাতে এসেছে, এটা হাতছাড়া করিস না। তুই লেখ্। পরের বছরটা আমাকে বললে আমি লিখে দেব।’ এর পর আমিই লিখলাম। পরের বছর বরেন লিখল, কিন্তু বরেনের লেখা আর ছাপা হল না কারণ ধর্মঘট হয়ে সে বছর পুজো সংখ্যা বন্ধ হয়ে গেল।
পত্রিকা: বাঙালির একটা কমন পারসেপশান, আগের সাহিত্য খুব ভাল ছিল, এখন আর লেখার সেই ধার নেই। এমনকী আপনার লেখাও আর আগের মতো নেই। এটা নেহাত নস্টালজিয়া, নাকি এই সমালোচনার মধ্যে সত্যতা আছে?
শীর্ষেন্দু: আগে অবশ্যই, আমাদের আগের যুগে, চল্লিশের দশকে বা তারও আগে অনেক ভাল ভাল গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। তখন ন্যারেশনই মূলত থাকত। আমাদের সময় থেকে অন্য ধরনের চিন্তাভাবনা বেশি ঢুকল লেখার মধ্যে। গল্পের থেকে গল্পের বিশ্লেষণটা গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্য ধরনের লেখার প্রয়াস শুরু হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, সুনীল একটা গল্প লিখেছিল, একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে নিয়ে....নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, অদ্ভুত ধরনের একটা গল্প। রতন ভট্টাচার্য, স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, মতি নন্দী— এদের গল্পগুলো একটু অন্য ধরনের, দেবেশ রায়েরও। এখন গল্প মানেই শুধু গল্প বলা নয়, তার মধ্যে সুরিয়ালিজম ঢুকে যাচ্ছে। দেবেশের একটা গল্প পড়েছিলাম, গল্পটা শেষ হচ্ছে এই ভাবে— পোস্টাপিসে অন্ধকার হয়ে এসেছে। সেখানে ঢুকে দেখা যাচ্ছে একটা লোক চিঠির পর চিঠিতে স্ট্যাম্প মেরে চলেছে। এখানেই গল্পটা শেষ হয়ে যায়। তবে এই মুহূর্তটা এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করল যে এটা আর গল্প রইল না। এটা একটা ইমেজ হয়ে গেল। বাস্তবতা থেকে যেন আমাদের পরাবাস্তবে নিয়ে চলে গেল। দেবেশ অদ্ভুত কিছু গল্প লিখেছে। ‘দুপুর’ বলে একটা গল্প পড়েছিলাম। দুপুরটাই সেখানে সাবজেক্ট। এ ধরনের গল্প কিন্তু আগে লেখা হত না। তবে গল্পে অবাস্তব, পরাবাস্তব যাই আনো না কেন, ডিটেলসটা আনতে হবে, যাতে তাকে বাস্তব বলে মনে হয়।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
পত্রিকা: তাহলে কি আপনি বলছেন পাঠকের নতুন স্বাদটা নেওয়ার অক্ষমতাই এই সমালোচনা তৈরি করছে?
শীর্ষেন্দু: দ্যাখো, মানুষের নস্ট্যালজিয়া থাকবেই। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লাভ নেই। কেউ বঙ্কিমে থেমে আছেন, কেউ শরৎচন্দ্রে থেমে আছেন, তারপরে আর এগোতে পারেননি। স্মরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা বলতেন, ‘খুব তো লিখছ। শরৎবাবুর মতো ট্র্যাজেডি লিখতে পারবে? না লিখতে পারলে কিছুই হবে না।’ ভাবো! লেখকের বাবাই এ কথা বলছেন? উনি থেমে আছেন শরৎবাবুতেই। শরৎবাবুর পরে যে লেখা হয়েছে, সেটা উনি মানেন না, বিশ্বাসই করেন না। এক-একটা চৌকাঠে এক-একজন পাঠক থেমে থাকবে। আমি যখন ‘স্বপ্নের ভিতরে মৃত্যু’ বা ‘ঘুণপোকা’- লেখা শুরু করেছি, সেই সময় তো লোকে সেগুলো পাতেও নিত না। ছুঁতও না। ‘ঘুণপোকা’-র চারপাঁচ বছর ধরে কোনও বিক্রি নেই, সমালোচনা নেই, কিচ্ছু নেই। সাধুবাদ তো দূরে থাক! তারপরে ধীরে ধীরে স্বাদ বদলাতে দেখলাম। এখন তো ‘ঘুণপোকা’ বেশ ভালই বিক্রি হয় দেখি। বছরে একটা করে এডিশন। তখন? মাত্র ২০০-২৫০ কপি বিক্রি হত। আমার ভাগ্য ভাল যে প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল, তবুও একটা বই চলছে। মস্ত বড় ভাগ্য বলে মনে হয়।
পত্রিকা: আপনার শেকড় ময়মনসিংহের। ময়মনসিংহের আর দুই দিকপাল বাঙালি— নীরদ সি চৌধুরী এবং সত্যজিৎ রায় - দু’জনেই বইয়ের বাঁধাই থেকে বইয়ের মান কী হবে, পাতার মাপ কী হবে— এসব খুঁটিনাটি বিষয়ে একেবারে পারফেকশনিস্ট ছিলেন। আপনি কি অতটা মাথা ঘামান? নাকি বইয়ের প্রোডাকশন ভ্যালু নিয়ে ভাবেনই না?
শীর্ষেন্দু: না, প্রোডাকশান নিয়ে মাথা ঘামাই না। কখনও সখনও প্রুফটা দেখি, যদি সময় থাকে। উপন্যাস সমগ্র বেরোচ্ছে ধরো, তখন প্রুফ দেখাটা আর সম্ভব হয় না। কারণ সেটা খুবই সময়সাপেক্ষ। দেখতে পারি না। ভুল থেকে যায়। সম্ভব হলে কারেকশন করে পাঠিয়ে দিই। তবে সেটা আর ঠিক হয় কিনা, সেদিকে লক্ষ রাখি না। আমি একেবারেই এতটা মনোযোগী নই।
পত্রিকা: শীর্ষেন্দুদা, শেষ প্রশ্ন। আপনার যে বন্ধুমহলটা ছিল— সুনীলদা, শক্তিদা, যাঁরা এই মুহূর্তে আর নেই, সেই পুরোনো বন্ধুদের চলে যাওয়া… কোথাও কোনও একাকীত্ব স্পর্শ করে আপনাকে?
শীর্ষেন্দু: একটা কথা বলি, সুনীল-শক্তি আমার খুব বন্ধু ছিল, খুবই। কিন্তু আমি সন্ধেবেলাটা ওদের সঙ্গে বসতে পারতাম না। বাইরে গেলে বসতে হত। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, ওরা হাই হত ধীরে ধীরে আর আমি আমার লেভেলেই রয়ে যেতাম। কিছুক্ষণ বাদে একটা অসঙ্গতি- আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে হত। গানের পর গান হচ্ছে, তারা হাই হতে হতে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেল.....। তবে আমাদের অফিসে খুব সুন্দর একটা আড্ডা হত। সুনীল আর আমি তো দীর্ঘদিন পাশাপাশি বসে কাজ করেছি। সুনীলের সঙ্গে ওখানেই পার্সোনাল আড্ডা হত। সুনীল তার মনের ভেতরকার কথা খুলে বলত আমায়। অনেকের কাছেই বলতে পারবে না, এমন কথা আমাকে বলত ও। বলত নিরামিষ খেতে ইচ্ছে হয়....ইত্যাদি। তখন লক্ষ করেছিলাম অবিশ্বাস সুনীলের বাতিক নয়। মানে নাস্তিকতাটা ওর মধ্যে খুব দৃঢ় নয়। একটা দ্বিধা ও একটু অ্যালায়েন্সও যেন আছে। তাছাড়া নিরামিষ খেতে চাইলে আমাদের একজন ওকে বললেন, ‘না, না, নিরামিষ খাবেন না, নিরামিষ খাবেন না।’ আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘এ কী, ওকে নিরামিষ খেতে বারণ করছেন কেন?’ উত্তরে উনি বলতেন, ‘আরে মশাই, এমন একজন মানুষ নিরামিষ খেতে শুরু করলে তো শাকসব্জির দাম বেড়ে যাবে!’ (হাসি) অনেকেই সুনীলকে ভয় পেলেও, আমিই ওকে নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতাম বেশি। শক্তির সঙ্গেও এমন সম্পর্ক ছিল। শক্তি অনেক বেশি খোলামেলা ছিল। ওর জীবনে গোপনীয়তা বলে কিছু ছিল না। শ্যামলের সঙ্গেও ভারী বন্ধুত্ব ছিল। আশি বছরে এসে সেসব দিনগুলো মনে পড়ে … যে জীবন যাপন করছি খানিকটা জেনে, খানিকটা না-জেনে। এই যে বিশাল একটা জগৎ – কোনও কূল-কিনারা নেই। এসব নিয়েই তো কতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। রাত জেগে চিন্তা করি আমার অবস্থানটা কী? আমি কে? আমি কী? চারিদিকে অজস্র প্রশ্নের ভিড়। এই প্রশ্নের মাঝেই আমি নিজেকে খুঁজি। এটা আমার জীবনের একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস। জবাব হয়তো পাব না। কখনও আমার মনে হয়নি যে জীবনটা বুঝি শেষ হয়ে এল, এবার পাততাড়ি গুটোনোর পালা। মনে হয় না আমি রিটায়ার্ড। আমার মনটা নিরন্তর কাজ করে চলেছে— এখনও করে। আমি বুড়ো হয়েছি— এটা কখনও মনে হয় না। আমি যেন একটা বালক, চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি— জীবনের কোথায় কী আছে। মৃত্যুর পর কী আছে? জন্মের আগে কী ছিল? এখনও এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজছি, খুঁজে চলেছি…