বেশ কয়েক বছর ধরেই থাইরয়েডের ওষুধ খেতাম নিয়মিত। এক বার ফাইল শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিজের গাফিলতিতেই ওষুধ কেনা হয়ে ওঠেনি। তারই মাঝে এক বার জ্বর হওয়ায় বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম ওষুধের দোকানে। দোকানদার ভদ্রলোক হঠাৎই আমাকে অবাক করে দিয়েই জি়জ্ঞেস করে ওঠেন, ‘‘আপনার কি থাইরয়েড আছে?’’ আমি আমতা আমতা করেই সায় দিই। উনি আশঙ্কা করেন যে, আমার থাইরয়েড বেড়েছে। তার পর তড়িঘড়ি পরীক্ষা। ফল হাতে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ! অর্থাৎ, আমার মুখ দেখেই ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছিলেন যে, আমার শরীরটা আদৌ ভাল যাচ্ছে না।
সুন্দর মুখের যেমন কদর সর্বত্র, তেমনই এই মুখই গোটা বিশ্বকে বলে দিতে পারে আপনার শরীর ও মনের গোপন খবর। এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই। আমাদের মুখের প্রত্যেকটা অংশই শরীরের কোনও না কোনও অংশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। বিষয়টা খোলসা করেই বলি।
ফেস ম্যাপিং ও শরীরের নানা প্রত্যঙ্গের সঙ্গে তার সম্পর্ক:
পরিষ্কার ত্বক, সুন্দর মুখ দেখামাত্রই এটা ভাববেন না যে, সে দারুণ রূপচর্চা করে। বরং তার শরীরের সমস্ত প্রত্যঙ্গ ভাল থাকলে সেটাই বাইরে ফুটে ওঠে। চলতি ভাষায় একটা কথা আছে— ফেস ম্যাপিং। আয়ুর্বেদিক ও চৈনিক দর্শন অনুযায়ী শরীরের আভ্যন্তরীণ পরিবেশের কথা ত্বক ও মুখের উপর প্রকাশ পাওয়ার বিষয়টাই নাকি ফেস ম্যাপিং। তাই ত্বকের উপর সামান্য কোনও সমস্যা আদৌ ত্বকেরই, না কি লুকিয়ে রয়েছে কোনও প্রত্যঙ্গের অসুস্থতার লাল সঙ্কেত, ফেস ম্যাপিং বলে দেয় সেটাও।
আলোচনা করে নেওয়া যাক মুখের লক্ষণ এবং তার পিছনে লুকিয়ে থাকা সঙ্কেতবাণী।
হলদেটে ভাব:
যদি আপনার ত্বকে ও চোখে হলদেটে ভাব লক্ষ করতে শুরু করেন, তা হলে খেয়াল করুন। চোখের সাদা অংশে যদি হলদে আভা মিশতে থাকে, সেটাও বলে দিতে পারে শিগগিরই আপনি পড়তে পারেন জন্ডিসের কবলে। এ ছাড়াও হেপাটাইটিস, সিরোসিসের মতো যকৃৎ সংক্রান্ত রোগের আগমনও ঘটতে পারে। ত্বকে হলদেটে ভাব আবার পিত্তকোষ এবং অগ্ন্যাশয়ের সমস্যার কথাও বলে।
বাটারফ্লাই শেপড র্যাশ:
ত্বকের উপর যে কোনও ধরনের র্যাশই আভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা বলে। কিন্তু সেই র্যাশ দু’গালে ছড়াতে ছড়াতে যদি প্রায় প্রজাপতির শরীরের মতো আকার ধারণ করে, তা হলে আপনি লুপাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। লুপাস শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার ডিজঅর্ডার-জনিত একটি রোদ। এতে ত্বক, রক্ত, গাঁট, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড আর যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়াও অন্য কোনও ওষুধ থেকে সাইডএফেক্ট, অতিরিক্ত সূর্যরশ্মিতে দীর্ঘক্ষণ থাকা কিংবা নানা ধরনের অ্যালার্জিরও লক্ষণ নির্ধারণ করে র্যাশ।
মুখে অত্যধিক রোম:
মেয়েদের জ-লাইন, চিবুক ও আপার লিপসে অতিরিক্ত রোমের আভাস সরাসরি ইঙ্গিত দেয় পিসিওএস-এর। অর্থাৎ পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম। শরীরে হরমোনে অসমতা, মেনোপজ এবং আকস্মিক হরমোনের বদল থেকে এই সমস্যা বাড়তে পারে। এই মুহূর্তে বেশির ভাগ মেয়েই এই সমস্যায় জর্জরিত।
ফ্যাকাশে ত্বক:
ত্বকের ঔজ্জ্বল্য কমতে শুরু করে ফ্যাকাশে হলে অবশ্যই শরীরে আয়রনের ঘাটতি আছে কি না পরীক্ষা করুন। এই ঘাটতিই কিন্তু হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। ত্বকে পিগমেন্টেশন বাড়তে থাকলে তার জন্য সূর্যের কড়া রোদকেই শুধু দায়ী করবেন না। টাইপ টু ডায়াবেটিসের লক্ষণ বহন করতে পারে এই পিগমেন্টেশন।
শুষ্ক ত্বক ও খসখসে ঠোঁট:
শীত পড়তে না পড়তেই অনেকেই শুকনো ত্বক, খসখসে ঠোঁটের কবলে পড়েন। কিন্তু এগুলো হতে পারে শরীরে জলের অভাব বা ডিহাইড্রেশনের লক্ষণও। আবার শুষ্ক ত্বক বার্তা দিতে পারে শরীরে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের স্বল্পতার কথাও।
ফোলা ভাব:
রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে থাকলে তা ঘাঁটি গড়ার জন্য বেছে নেয় ত্বকে থাকা কোলাজেন, ইলাস্টেন। ফলে সুগার বাড়তে থাকলে ত্বকে-মুখে আসতে পারে ফোলা ভাব। বৃক্কজনিত সমস্যাতেও মুখ ফুলতে শুরু করতে পারে।
তেলা ভাব ও পিম্পল:
মুখ তেলতেলে হয়ে যাওয়া বা একগাদা পিম্পল বেরোনো মানে যে শুধুই লিভারের সমস্যা, এমনটা নয়। বিজ্ঞান বলছে, স্ট্রেস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। স্ট্রেসের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে হরমোনের ব্যালান্সে আঘাত ঘটে। তা থেকেই বাড়তে থাকে তেলা ভাব ও পিম্পল।
তাই সুন্দর মুখ পেতে গেলে ভিতর থেকে সুস্থ আর ভাল থাকা জরুরি। বা উল্টো দিক দিয়ে বলতে গেলে, আপনার মুখের সামান্যতম অদলবদলে আগে ত্বকের নয়, ভাবুন শরীরের ভিতরের কথা!