সোশ্যাল মিডিয়াকে আনরিয়েল লাগে

অজস্র লাইক মানেই গান হিট নয়। টালিগঞ্জের বেশ কিছু ছবির সঙ্গীত পরিচালক হলেও বাংলা গান নিয়ে হতাশ কালিকাপ্রসাদ। তাঁর বিস্ফোরক কথার সামনে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় অজস্র লাইক মানেই গান হিট নয়। টালিগঞ্জের বেশ কিছু ছবির সঙ্গীত পরিচালক হলেও বাংলা গান নিয়ে হতাশ কালিকাপ্রসাদ। তাঁর বিস্ফোরক কথার সামনে স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১২
Share:

২০১৬-য় কি দোহারের গায়ক কালিকাপ্রসাদের আর ২০১৭ সঙ্গীত পরিচালক কালিকাপ্রসাদের?

Advertisement

এটা ঠিক নয়। কালিকাপ্রসাদ কোনও দিন ‘দোহার’ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ‘দোহার’ আমার প্রাথমিক আইডেন্টিটি। সদ্যই যেমন ২০১৭-র সানফ্রানসিসকোর বঙ্গ সম্মেলনে হাজার বছরের বাংলা গান একটি মিউজিকাল সয়েরির পরিচালনার দায়িত্ব পেলাম। এই দায়িত্বটা গায়ক কালিকাপ্রসাদের যেমন, তেমন পরিচালক কালিকাপ্রসাদেরও। এই যে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’ ছবিতে কাজ করলাম সেখানেও ‘দোহার’ গান গেয়েছে। ফলে পরিচালকের সত্তা থেকে গায়ক কিন্তু আলাদা নন।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’য়ে তো নচিকেতা প্রথম ফোক গাইলেন।

Advertisement

হ্যাঁ। নচিদা দারুণ গেয়েছেন। কৌশিকদার এই ছবিতে অন্য বাংলা ছবি বা অ্যালবামের মতো কিন্তু কম্পিউটেড মিউজিক বাজেনি। সারিন্দা থেকে উডুক্কাই (বড় ডমরু) অনেক অপ্রচলিত যন্ত্রের লাইভ রেকর্ডিং হয়েছে। এটা আমার কাছে একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। বুঝলাম কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় কতটা মিউজিক্যালি সাউন্ড। তবে নচিদার প্রসঙ্গ যখন এলই তখন একটা গান নিয়ে একটু বলতে চাই।

বলুন না...

সম্প্রতি ‘জুলফিকার’য়ে ‘এক পুরনো মসজিদে’ গানটা খুব কানে বেজেছে। নচিদা তো অসাধারণ গেয়েছেন। অ্যারেঞ্জমেন্টও খুব ভাল। কিন্তু মুশকিল হল ‘এক পুরোনো মসজিদে গান ধরেছে মুরশিদে’— এই মুরশিদ কথাটাতেই কিন্তু গানের মৃত্যু হয়ে গেছে। মুরশিদ কখনই মসজিদে
গান ধরতে পারে না। মুরশিদ
দরগায় বা আখরায় গাইবে। শুধু মাত্র ছন্দমিল ছাড়়া মসজিদের সঙ্গে মুরশিদের কোনও মিল নেই। এটা লিরিকের সমস্যা, তাই না বলে পারলাম না। এটাই এখনকার
বাংলা গানের সমস্যা। গান ভাল। অজস্র লাইক পেয়েও কোথাও গিয়ে আটকে যাচ্ছে।

অজস্র লাইক পাওয়া মানেই গান হিট নয়, বলছেন!

নাহ্। নয়। সোশ্যাল মিডিয়াকে আমার খুব আনরিয়েল লাগে। দেখবেন একটা লোক, যে কোনও দিন আপনার কাছাকাছি আসেননি, তিনি হঠাৎ আপনার কোনও ইভেন্টে ‘কামিং’ লিখে বসলেন। আপনিও খুশি! আপনার ইভেন্টে অজস্র ‘কামিং’। অথচ দেখা গেল হল অর্ধেকও ভরল না। তবে গান ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই মাধ্যমটা খুব জরুরি।

আর হিট গানের ক্ষেত্রে?

লোকে কী ভাবে নেবে জানি না। তবে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ বা ‘বারান্দায় রোদ্দুর’য়ের পর আমার মনে হয় না আর কোনও বাংলা গান হিট করেছে।

কালিকাপ্রসাদ পাঁচটা ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে। সিনেমায় প্লে ব্যাকের জন্য ফোন আসে না?

যে গান যাকে দিয়ে হবে না কেউ ফোনে বললেও আমি সেটা করব না।

যদি প্রোডিউসার বলেন?

এখন অবধি এ রকম কোনও প্রেশার আমাকে নিতে হয়নি। আমি ফরমায়েশি গান লিখতে পারব না। আমি বলছি না ফরমায়েশি গান লেখা খারাপ। কবি নজরুল তো ফরমায়েশি গান লিখেছেন। এ রকমও হয়েছে একসঙ্গে একবার আঙুরবালাকে তিনি চার লাইন গাওয়াচ্ছেন, আবার ইন্দুবালাকে। ওই ক্ষমতাটাই আলাদা।

আজকাল তো কাকে দিয়ে কোন গান গাওয়ানো হবে তা পরিচালক আর প্রযোজক ঠিক করেন। আপনি কী করবেন?

দেখুন, সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করাটা কিন্তু আমার পেশা নয়। ঈশ্বরের আশীর্বাদে যদি আমার গলাটা বেঁচে থাকে তা হলে আমি আরও দশ বছর গাইতে পারব। সত্যি কথা বলতে কী কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যখন ফোন করে ‘বিসর্জন’য়ের গল্পটা শোনালেন তখন ভেবেছিলাম ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করা কি আমার কাজ? পরে মনে হল ছবির গানের ধরন আলাদা। মনে হল চ্যালেঞ্জটা নিই।

বাংলাদেশের ছবিতেও তো সুর দিলেন।

বাংলাদেশের ছবির কাজ জাস্ট শেষ করলাম। সরকারি অনুদানে বাংলাদেশের ছবির নাম — ‘ভুবন মাঝি’। মুক্তিযুদ্ধ, শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে ছবি। ভারতীয়দের মধ্যে আমি আর পরমব্রত আছি। পরম একটা গানও গেয়েছে। ওখানেও আধুনিক গান লিখে সুর দিতে হয়েছে। দেখলাম কাজটা সকলের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু বাংলা গানে সে রকম হিট গান এখনও পাচ্ছি না।

কেন ‘বসন্ত এসে গেছে’ বা ‘তুমি যাকে ভালবাস’ তো হিট গান?

লোকে টানা ছ’ মাস একটা গান শুনছে মানেই কিন্তু সেটা হিট নয়। আমরা সকলেই অপেক্ষায় আছি বাংলা গানে আবার বিরানব্বইয়ের মতো আগুন জ্বলে উঠবে। নতুন কিছু সৃষ্টি হবে। ছবির গানের যা প্রচার হয় তাতে তো সেই গান লোকে শুনবেই।

মানে? ঠিক কী বলতে চাইছেন?

‘প্রাক্তন’, ‘জুলফিকার’ এই ধরনের ছবির দু’-তিন মাস ধরে প্রোমোশন হয়। এত প্রোমোশন হওয়ার পর ছবির গান তো লোকের কাছে পৌঁছেই যায়। কিন্তু একজন বেসিক গান গেয়ে, কোনও বিজ্ঞাপন ছাড়া শুধু নিজের জোরে যদি হাজার শ্রোতা জোগাড় করেন, তা হলে আমি বলব সেটা অনেক বেশি কৃতিত্বের।

ইন্ডাস্ট্রিতে সদ্য সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। আর এ ভাবে সোজা কথা বলছেন। এ দিকে সৃজিত মুখোপাধ্যায় ডাকলে তো ঠিক চলে যাবেন।

সৃজিত তো ‘জাতিস্মর’য়ে আমায় দিয়ে গাইয়েছে। অভিনয়ও করিয়েছে। তাতে কী! তবে মিউজিক নিয়ে কোনও চাটুকারিতা করতে পারব না।

আর নতুন কী ছবি করছেন, বলবেন?

আশিস রায়ের পরিচালনায়, আবুল বাশারের গল্প নিয়ে একটা ছবি হচ্ছে। ওখানে মিউজিক করছি। সাবকালচারের গল্প, আন্ডারওয়ার্ল্ডের গল্প। ছবিতে নৌকো চালানোর দৃশ্য আছে। পরিচালক এক দিন বলছিলেন ‘দোহার’ যে ভাবে ‘ সামাল সামাল ভাই রে’ আর ‘এবার তোর মরা গাঙে’ মিলিয়ে গায়, সেভাবে গানটা রাখতে। আমি ওকে বোঝাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের মানুষের চৌহদ্দির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নেই। লোকের অভ্যেস হয়ে গেছে সিনেমা বা সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত রাখার। আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে খুব সহজে দর্শকের কাছে পৌঁছনো যায়।

তাই যদি হতো তা হলে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে নাম
করা যেত।

কে বলল যায় না? শ্রাবণী সেনকে দেখুন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ওর আইডেনটিটি। পাড়ার অনুষ্ঠান থেকে শীতকালের জলসা, সবেতেই গাইছেন। তবে আরেকটা কথাও সত্যি।

কী কথা?

সবাই সব গান গাইছে। শিল্পীদের কোনও আইডেন্টিটি তৈরি হচ্ছে না।

আপনার রিয়েলিটি শো তো এখন সে ভাবেই শিল্পী তৈরি করছে!

সে কারণেই তো মেয়াদ ছয় মাস।

সে কী! ‘সারেগামাপা’–র মেন্টর এই কথা বলছেন?

এটাই তো বাস্তব। এই যে নতুন

‘সারেগামাপা’ এসেছে, আবার নতুন তারকা তৈরি হবে! আসলে কী জানেন? আমরা যখন সিনেমা বা নাটক দেখি তখন সেটা আমাদের পছন্দে যাই। টিকিট কেটে দেখি। কিন্তু টিভি তো খোলা। কোনও দাম নেই। সেই কারণে টিভি থেকে উঠে আসা সব রকম গান জানা শিল্পীদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের পারিশ্রমিকও খুব কম। স্ট্রাগল অনেক বেশি।

ইদানীং লোকগানের চাহিদা কিন্তু বাড়ছে।

হ্যাঁ, ‘সারেগামাপা’-র পর থেকেই কিন্তু দেখছি এই ট্রেন্ডটা। জয়তী (চক্রবর্তী) ফোক গানের অ্যালবাম করল, পুরোনো ‘সারেগামাপা’-র দীপান্বিতা, রাঘব (চট্টোপাধ্যায়) বলছে করবে। রূপঙ্কর (বাগচী) আগেই করেছে।

সবাই তো ফোক গাইতে পারে না?

না। লোপা (লোপামুদ্রা মিত্র) যখন গাইতে চাইল বলেছিলাম তুমি গানটা ফোক গাইছ ভেবে গেয়ো না। একটা পদ গাইছ, ভেবে তোমার মতো করে গাও।

কিন্তু আপনি একইসঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত, ফোক সব গাইছেন। আপনি কি এতটাই ভার্সেটাইল?

আমি কিছুই না। শুধু নিজেকে ভাঙছি। এই যে ‘বাবার নাম গাঁধী’র পরিচালক পাভেলের ছবিতে মিউজিক করছি, কাজটা খুব ইস্টারেস্টিং। আবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ‘চন্দ্রাবতীর কথা’ অন্য ধরনের কাজ। গামছা পরা ফোকের ব্যবহার এখানে চলবে না। সম্পূর্ণ ক্ল্যাসিকাল লুক আনতে হবে। এ ভাবেই চেষ্টা করছি।

১৭ বছর ধরে একটা লোকগানের ব্যান্ড মহিলা বর্জিত কেন?

আরে সেরকম কোনও ব্যাপার নেই। প্রথম কারণ আমরা চড়া পর্দায় গাই। মহিলা কণ্ঠের পক্ষে সেটা সমস্যার। আর আগে ‘দোহার’য়ের রিহার্সাল হতো মাঝরাতে। কোনও মহিলার পক্ষে সময়টা কতটা গ্রহণযোগ্য হতো জানি না। তবে লোকসঙ্গীত কিন্তু মানুষকে টানে। মানুষ আজও লোপার কাছে ‘ছাতা ধরা হে দেওরা’ শুনবে। আমরাও যখন ঢাকঢোল নিয়ে মঞ্চে গান গাইতে এলাম তখন ভরা রক-য়ের সময়। সেখানেও লোকে ‘দোহার’কে নিয়েছে। নাড়ির টানটা না থাকলে কি লোকগান নিয়ে এতটা রাস্তা পেরোতে পারতাম?

রাস্তা পেরোতে গিয়ে এত মহিলা ফ্যান-দের সামলাচ্ছেন কী করে?

এ কী! আমার তো মনে হয় আমার পুরুষ ফ্যানও আছে।

আপনি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন।

দেখুন, ফ্যানদের মুগ্ধতা থাকতেই পারে। আমিও তো অভিনেত্রী
রেখা-য় মুগ্ধ। সেটা আর যাই হোক প্রেম নয়। তো সে রকম মুগ্ধতা অনেকই আছে। সবটাই আসলে মনে মনে। কেউ তো সামনে এসে বলেও না। বলতেই পারে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন