জল খান হিসেব করে

সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে জলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু জানেন কি অতিরিক্ত জলপান বিপদও ডেকে আনতে পারে? জলের পরিমাণ নির্ভর করে আপনার শরীরের গঠন, জীবনযাপন ও কাজের উপরে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে জলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু জানেন কি অতিরিক্ত জলপান বিপদও ডেকে আনতে পারে? জলের পরিমাণ নির্ভর করে আপনার শরীরের গঠন, জীবনযাপন ও কাজের উপরে

Advertisement

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

নেহাতই নিরীহ গোছের দেখতে। একেবারেই স্বচ্ছ, সাদা, যখন যে পাত্রে রাখা হয়, তার মাপেই দিব্যি নিজেকে গড়েপিটে নেয়। ভিতরে কিন্তু বিরাট ক্ষমতা। সুস্থ ভাবে বাঁচতে হলে, শরীরের কলকব্জা ঠিকঠাক চালাতে গেলে তাকে খানিক বুঝেসুঝেই ব্যবহার করতে হয়। নইলে ঘনাতে পারে বিপদ।

Advertisement

জলের কথা বলছি। মানুষের শরীরে থাকা টক্সিন বার করতে আর শরীরের ভিতরের জলের অনুপাত বজায় রাখতে ঠিক পরিমাণে জল পান করা প্রয়োজন। অথচ আমরা অনেকেই জল খাওয়ার কোনও হিসেবই রাখি না। ওষুধ, খাবার সবই সময় মেনে মাপ মতো খাওয়া হয়। কিন্তু জল নয়। জল খাওয়ার আবার হিসেব কী? খেলেই হল। শুধু কেউ সারা দিনে বোতলের পর বোতল জল খেয়ে শেষ করে দেন, আবার কেউ এক বোতল শেষ করতেই হাঁপিয়ে ওঠেন— এটুকুই তো তফাত। বড়জোর এমনটাই ভাবেন গড়পরতা মানুষ।

ভুল ভাবনা

Advertisement

এই ভাবনায় গলদ আছে বিস্তর। আসলে, এক জন সুস্থ মানুষের জল খাওয়ার পরিমাণ নিয়ে নানা মিথ কাজ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে। যেমন অনেকেই ভাবেন, অতিরিক্ত জল খেলেই বুঝি সব শারীরিক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এটা ঠিক নয়। এক জন সাধারণ মানুষ, যাঁর কিডনি ঠিকঠাক কাজ করছে এবং হার্ট ও লিভারেরও কোনও বড় অসুখ নেই, তাঁর সাধারণত দিনে আড়াই থেকে তিন লিটার ‘ফ্লুইড’-এর প্রয়োজন হয়। সিনিয়র কনসালট্যান্ট ফিজ়িশিয়ান

ডা. বিশ্বজিৎ ঘোষদস্তিদার স্পষ্ট করলেন, এই ফ্লুইড কিন্তু শুধু মাত্র জল নয়। যিনি দিনে অনেক বার চা খান, তাঁকে সেই মাপটাও নিতে হবে। ফলের রসও এর মধ্যে পড়ে। এমনকি খাবারের সঙ্গেও খানিকটা জল ঢোকে শরীরে। এ বার এই টোটাল ফ্লুইডের পরিমাণ গরম কালে কিছু বাড়তে পারে। আবার শীতের সময় কিছু কমতে পারে। এমনকি ডায়াবিটিসের রোগী যাঁরা, তাঁদের কিডনি, হার্ট এবং লিভার ফাংশন যদি ঠিক থাকে, তা হলে তাঁদের জল খাওয়ার পরিমাণ যে কোনও সাধারণ মানুষের মতোই। কোনও আলাদা বাধানিষেধ নেই।

কিন্তু অনেকে সকালে উঠে খালি পেটে অনেকটা জল খেয়ে ফেলেন। তাতে শরীর নাকি ঝরঝরে থাকে। এমন ধারণারও কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানালেন চিকিৎসক। সকালে উঠে এমনিতেই সকলের একটু বেশি তেষ্টা পায়। কারণ অনেকক্ষণ জল শরীরে পৌঁছয় না। তার মানে এই নয় যে, একসঙ্গে প্রচুর জল খেতে হবে।

আবার ডায়েরিয়ার সময়ে অনেকেই জল খাওয়া বন্ধ করে দিতে চান। ভাবেন, জল খেলেই বোধহয় আরও বেশি জল বেরিয়ে যাবে। এমন ভাবনাও কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে। এতে শরীর আরও বেশি ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। কিডনি ফেলিয়োরের আশঙ্কাও থেকে যায়।

ঢকঢক করে না অল্প অল্প?

চিকিৎসকদের মতে, একসঙ্গে অনেকটা জল না খেয়ে ফেলাই ভাল। সকালে দু’ লিটার জল একসঙ্গে খেয়ে নেওয়া হল, আর সারা দিনে জল খাওয়াই হল না, এমনটা না করে বরং সারা দিনে জল খাওয়ার পরিমাণটা সমান ভাবে ভাগ করে নেওয়া উচিত। সারা দিনই আমাদের শরীর থেকে নানা ভাবে জল বেরিয়ে যেতে থাকে। জল খাওয়ার মধ্যে ব্যালান্স থাকলে কিডনিরও কাজ করতে সুবিধে হয়।

অসুখবিসুখে জলের ভূমিকা

কিডনির অসুখ: কিডনির অসুখ নানা রকম। কার কী ধরনের কিডনির অসুখ এবং তাঁর শরীরের অবস্থা দেখে নেফ্রোলজিস্টরা সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে ঠিক কতটা পরিমাণে জল খেতে হবে। সাধারণ মানুষ জল একটু কম খেলে বা একটু বেশি খেলে অসুবিধে নেই। বড়জোর তাঁর ইউরিনের পরিমাণ এবং ঘনত্বের কিছু হেরফের হতে পারে। কিন্তু কিডনির অসুখের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। নেফ্রোলজিস্ট ডা. ললিত আগরওয়াল জানালেন, যে রোগীর অচল কিডনি জলকে শরীর থেকে বার করতে পারছে না, তাঁর ক্ষেত্রেই জল কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কারণ বাড়তি জল তাঁর শরীরে জমতে থাকে। শরীর ফুলে ওঠে, শ্বাসকষ্ট হয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর শরীর থেকে জল অতিরিক্ত হারে বেরিয়ে যাচ্ছে। অচল কিডনি জলকে ধরে রাখতে পারছে না। এই ক্ষেত্রে রোগী খুব তাড়াতাড়ি ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়। সেখানে জল বেশি খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সুতরাং কিডনির অসুখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনওই নিজে থেকে জল খাওয়ার পরিমাণ ঠিক করা উচিত নয়।

হার্টের অসুখ: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এস বি রায় জানালেন, হার্টের রোগী যাঁদের পাম্পিং ফাংশন স্বাভাবিক, অর্থাৎ ৬০-এর কাছাকাছি, তাঁরা সাধারণ মানুষের মতোই ২-৩ লিটার জল খেতে পারেন। তাঁদের বাইপাস, অ্যাঞ্জিয়োপ্লাস্টি হয়ে গেলেও জল খাওয়ার পরিমাণে কোনও বাধানিষেধ থাকবে না। সমস্যা হয়, হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়োমায়োপ্যাথির মতো কোনও কারণে হার্টের পাম্পিং রেট কমে গেলে। তাঁরা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি জল খেলে হার্ট ফেলিয়োর হতে পারে। এই সব ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা আগে দেখে নেন, তাঁর পাম্পিং কতটা খারাপ হয়েছে। সেই অনুযায়ী, তাঁদের জল খাওয়ার পরিমাণ মেপে দেওয়া হয়। এখানে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ— ওজন। পাম্পিং রেট মোটামুটি একই রকম, অথচ ওজন এক জনের কম, অন্য জনের বেশি— সে ক্ষেত্রে জলের পরিমাণেরও তারতম্য হবে। কম ওজনের মানুষের অল্প জল হলেই চলে যায়, কিন্তু ওজন বেশি হলে তাঁর জলও বেশি লাগবে।

এক্সারসাইজ়ের সময়ে

এক্সারসাইজ়ের সময়ে আমাদের ঘাম ঝরে। ফলে, অতিরিক্ত জল শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। সেই ঘাটতি মেটাতে এক্সারসাইজ়ের আগে এবং পরে প্রচুর জল খাওয়া প্রয়োজন। যদি ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে এক্সারসাইজ় চলে, তা হলে শুধু জল না খেয়ে স্পোর্টস ড্রিঙ্ক চলতে পারে। ঠিক একই ভাবে, যাঁদের দিনের বেশির ভাগ সময়টা বাইরে কাজ করতে হয়, তাঁদের জলের প্রয়োজনও এয়ার কন্ডিশনড জায়গায় বসে কাজ করা মানুষদের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে, গরম কালে বাইরে কাজ করার সময় অবশ্যই জলের বোতল সঙ্গে রাখুন। ভাল হয়, নুন-চিনি লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে নিয়ে যেতে পারলে। জলের বদলে লস্যি বা ডাবের জলও চলতে পারে বিকল্প হিসেবে। অথবা শসা, জামরুল, আঙুর জাতীয় রসালো ফল সঙ্গে রাখলেও শরীর ঠান্ডা থাকবে, জলের ঘাটতি কমবে। তবে বাইরের যে কোনও জায়গা থেকে আখের রস, রঙিন শরবত বা কোল্ড ড্রিঙ্ক এড়িয়ে চলা ভাল।

গর্ভাবস্থায়

প্রেগন্যান্সিতে জল খাওয়ার কোনও বিধিনিষেধই নেই। অনেকে ভাবেন, এই সময়ে বুঝি অনেক জল খাওয়া দরকার, তেমনটা কিন্তু নয়। এক জন সাধারণ মানুষের যে ভাবে জল এবং খাবার খাওয়া উচিত, ভাবী মায়েদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুধু মাত্র প্রথম দু’-তিন মাস অত্যধিক বমি হয় যাঁদের, তাঁদের ডিহাইড্রেশনের সমস্যা হতে পারে। তাঁরা যদি জল বা জলজাতীয় কোনও তরলই শরীরে ধরে রাখতে না পারেন, তখন তাঁদের দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

এই ধরনের সমস্যা ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে সারা দিনে বার বার অল্প করে খাবার এবং জলই প্রেগন্যান্সিতে আদর্শ।

ব্রেস্টফিডিংয়ের সময়ে

নতুন মায়েদের ঘন ঘন পিপাসা পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। বরং সেই তেষ্টা মেটাতে পরিমাণ মতো জল ও ফলের রস খেতে হবে। তবে অনেকের ধারণা ব্রেস্টফিডিংয়ের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জলপান প্রয়োজন। তা কিন্তু নয়। আসলে এই সময়ে ডিহাইড্রেশন আটকানোই মূল লক্ষ্য। তার জন্য যতটা জল প্রয়োজন, ঠিক ততটাই খেতে হবে। তবে মনে রাখবেন, শারীরিক গঠন অনুযায়ী এবং সন্তান কতটা ব্রেস্টফিড করছে, তার উপরেই নির্ভর করে মায়ের জলপানের পরিমাণ।

ত্বক ও চুলের জেল্লা বাড়াতে

পরিমাণ মতো জল খেলে শরীর থেকে টক্সিন বেরিয়ে যায়। ফলে ত্বক ও চুলে জেল্লা ফুটে ওঠে। ত্বক ও চুল ভাল রাখার জন্য বাইরে থেকে চর্চা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু ভিতর থেকে ত্বক হাইড্রেটেড না থাকলে সেই রূপচর্চা তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। সেই জন্য অভিজ্ঞ বিউটিশিয়ানরাও পরিমাণ মতো জল খাওয়ার পরামর্শ দেন।

আরও বড় কথা, আমাদের শরীরই কিন্তু সবচেয়ে বড় বন্ধু। তারাই ইশারা করে জানিয়ে দেয়, কখন কতটা জল খেতে হবে।

এ জন্যই শরীরে জলের প্রয়োজন হলে আমাদের তেষ্টা পায়। সুতরাং নিজের শরীরকেও বোঝার চেষ্টা করতে হবে বইকি।

(মডেল: রিয়া বণিক; মেকআপ: সৈকত নন্দী; ছবি: অমিত দাস; পোশাক ও বোতল: ওয়েস্টসাইড, ক্যামাক স্ট্রিট; লোকেশন ও ফুড পার্টনার: ফ্রাইডে রিলিজ়, সল্টলেক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement