Artist

‘অপূর্ব নির্মাণ থেকে উঠে আসে ভোরের কোকিল…’

নাটকীয় কাজ ‘ফ্যামিলি ক্যাট’। মনুষ্যমুখী বাদামি বেড়াল হেঁটে যাচ্ছে ফুলছাপ মেঝের উপরে। তার পাশে এলোচুল ও ঝোলানো হাত নিয়ে শুয়ে থাকা নগ্ন নারী।

Advertisement

অতনু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:২৪
Share:

অভিনব: শুভনীল রায়ের একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম। নিজস্ব চিত্র।

শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ নেই, সরকারি চাকরি দিনের অধিকাংশ সময় কেড়ে নিলেও অনেক রাত পর্যন্ত কাগজ, ক্যানভাস, রং-তুলি তাঁকে কর্মমুখর রাখে। শিল্পকলা নিয়ে বিস্তর ভাবনা, শিল্পের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহেই শিল্পী শুভনীল রায় পড়ে ও দেখে ফেলেছেন বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের জীবন ও কাজ।

Advertisement

অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে শুভনীলের ‘প্রোনোরিয়া’ নামে দ্বিতীয় একক প্রদর্শনীতে দেখা গেল, একটি নিজস্ব স্টাইল তৈরি করতে তিনি বদ্ধপরিকর। এই জায়গাটির প্রধান দিকই হল, পটভূমিতে রূপ ও অনুষঙ্গের অ্যারেঞ্জমেন্ট ও ব্রাশিংয়ে বর্ণের বিস্তীর্ণ ঘষামাজার আলোড়ন। কিছুটা ইউরোপীয় প্রভাবাচ্ছন্ন। এই প্রভাব তাঁকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। প্রতিটি পেন্টিংয়ে বর্ণের ব্যবহার ও মিশ্রণের সাহায্যে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন কিছু সম্ভাবনাময় দিক লক্ষ্য করা গিয়েছে, যেখানে রূপের একক অস্তিত্বের বর্ণোচ্ছল সমারোহের বাইরেও অন্যান্য আবহ তৈরিতে বর্ণ ও তার ব্যবহার, বিশেষত ব্রাশিংয়ের বিভিন্ন রকম মুহূর্ত তৈরির প্রয়োগ-কৌশল আলাদা অভিনবত্বের দাবি রাখে। তাঁর কথায়, ‘‘আমার শৈল্পিক যাত্রা চলমান, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার ছবি যেন ক্রমশই সরল হয়ে উঠছে।’’ এ কথা সত্যিই তাঁর প্রদর্শনী দেখে বোঝা যায়।

তাঁর প্রাথমিক কল্পনা কিন্তু কাগজে দ্রুত ওই সরলীকরণের মধ্যেই কম্পোজ়িশনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। তাঁর ‘জার্নি টু আননোন’-এর বাইকআরোহী নারী-পুরুষ ও সমগ্র আবহ, ‘ব্লাইন্ড লাভ’-এর মোটরযান ও মুখোমুখি দুই দৃষ্টিহীন কিশোর-কিশোরী, ‘লস্ট ইন থট’-এ বেগুনি কক্ষে ফুলেল ছাপ বিছানায় টানটান শুয়ে থাকা কালচে খয়েরি নগ্ন মানব, ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’-এর দু’পাশে প্রস্ফুটিত নানা রঙের পুষ্পের মাঝখানের কাব্যিক এক ঘোর কালো বঙ্কিম পথ মিশে যাওয়া দূরের ওই কালো দিগন্তে, বা অতি গাঢ় আলট্রামেরিন ব্লু-র দিগন্তে মেশা আকাশ ও এমারেল্ড গ্রিন ভ্যালির উঁচু-নীচু স্থানে, রেডিশ ব্রাউন মাটাডোরের পার্সপেক্টিভ চমৎকার ভাবে রূপায়িত করেছেন কল্পনায়।

Advertisement

নিঃসন্দেহে শিশুসুলভ ‘ল্যান্ডস্কেপ-ওয়ান’, ‘ল্যান্ডস্কেপ-টু’, ‘ল্যান্ডস্কেপ-থ্রি’, ‘আ হেডোনিস্ট’, ‘ফিটনেস ফ্রিক’, ‘লং ড্রাইভ’-এ অনেক অসম্পূর্ণতা, দুর্বলতা ছিল। সুযোগ ছিল আরও কাজ করার, বিবর্তিত করারও। এগুলো বুঝতে হবে। সব ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করেই এক মিশ্রবর্ণের পটভূমি তৈরি করেন শিল্পী। সাবলীল গতির ব্রাশিং ও বর্ণপ্রয়োগ কাগজে এক রকম টেক্সচার তৈরি করে। কখনও অয়েল পেন্টিংয়ের ইমপ্যাস্টো বা স্প্যাচুলা ব্যবহারের মতো আবহ তৈরি হয়। এখানেই কৌশল নয়, বর্ণের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাচ্ছন্দ্যকে তিনি একটি নতুন আবহাওয়ায় নিয়ে যান। মনে রাখতে হবে, তাঁর সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে কোথায় যেন তৈরি হয়ে যাওয়া বা উঁকি মারা ইম্প্রেশনিস্ট বা এক্সপ্রেশনিস্ট পেন্টিংয়ের আদল না থেকে যায়। যা তাঁর কাজে কিছু জায়গায় রয়েছে। এ সব জায়গায় সতর্কতা প্রয়োজন।

সিংহ তাঁর প্রিয়। তীব্র বৈপরীত্যের বর্ণে গাঢ় নীল ও টকটকে লাল, কোথাও ঘষামাজা কালোর মধ্যে লাল সিংহ, যা ‘লায়ন শেয়ার’ নামে এঁকেছেন। অসামান্য নিদর্শন। রং গড়িয়ে দিয়েছেন মোটা রিংয়ের মধ্যে অন্তর্হিত মুখমণ্ডলের নীচ থেকে। তাঁর নিজের কথায়, ‘মানুষের মধ্যেও জান্তব প্রকৃতি প্রকাশ পায়। জন্তুও কোথাও কোথাও মানুষের মতো, দুটো যেন কোথাও মিশে গেছে।’ তিনি কি ওই মুণ্ডহীন সিংহে মানুষের মুখ কল্পনা করে, তাকে অদৃশ্য করেছেন? সামনের পায়ের পিছনে হকি স্টিকের মতো সরু কালচে, নেমে বা ঝুলে থাকা ও দু’টি কি মনুষ্য পদযুগল? বরং ‘বিয়িং আ ডাঙ্কি’-র ঘোর কালো চতুষ্পদ জন্তুর পিঠে বসা অমন কালো মানুষের অসাধারণ লাল প্যান্ট সবুজ প্রান্তর ও নীল আকাশের বুক চিরে বেরিয়ে আসা ছবিটিতে কিন্তু বিশেষ করে ইউরোপীয় শৈলীর ছাপ। নীল পটভূমিতে বাদামি-সাদা লম্বা গলার বিহঙ্গ ‘লস্ট প্রাইড’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাকে মনে পড়ায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন লালচে গোলাপি-কালো পটভূমিতে গাছে বিন্দু বিন্দু ব্রাশিং, ফ্লেশটিন্ট বর্ণের নির্জন, মনুষ্যহীন দাঁড়িয়ে থাকা মাটাডোর ‘সাইনিং ইমোশন ইন মোশন’ বেশ ভাল কাজ।

নাটকীয় কাজ ‘ফ্যামিলি ক্যাট’। মনুষ্যমুখী বাদামি বেড়াল হেঁটে যাচ্ছে ফুলছাপ মেঝের উপরে। ভৌতিক, কালো কুচকুচে মুখোশ পরে বিছানায় বসা ও গোলাপি পাপোশে পা রাখা কে ও? পাশে এলোচুল ও ঝোলানো হাত নিয়ে শুয়ে থাকা নগ্ন নারী। ঘরের দেওয়ালে ছাইবর্ণ ঘন মেঘ। পাশে জানালায় বাইরের প্রকৃতি। এ ছবির রোমান্টিকতা একেবারেই ড্রামাকে যেন এক অনির্দেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য রকম কাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন