নালন্দা-রাজগীর-বুদ্ধগয়া

এখানকার পরতে-পরতে বুদ্ধের আনাগোনা। ঘুরে এসে লিখলেন অত্রি মিত্রযুদ্ধক্ষেত্রের জঠরেই তো শান্তির জন্ম। ঠিক যেমন ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’। ভারতে তেমনই এক যুদ্ধক্ষেত্র অধুনা ‘বিহার’। ইতিহাসের পাতায় যার অনেকটা জুড়ে মগধ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

নালন্দার ধ্বংসাবশেষ

যুদ্ধক্ষেত্রের জঠরেই তো শান্তির জন্ম। ঠিক যেমন ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’। ভারতে তেমনই এক যুদ্ধক্ষেত্র অধুনা ‘বিহার’। ইতিহাসের পাতায় যার অনেকটা জুড়ে মগধ।

Advertisement

আসুন আমরা বরং সহিষ্ণুতার খোঁজে মগধের নালন্দা, রাজগীর কিংবা বুদ্ধগয়ায় ঘুরে আসি। যেখানকার পরতে পরতে বুদ্ধের আনাগোনা। সেই সঙ্গে মগধে ঘোরাফেরা করছেন মহাবীরও। সহিষ্ণুতার পাঠ নিতে মগধে যাবেন না তো কোথায় যাবেন!

শুরুটা করা যাক বুদ্ধগয়া দিয়েই। যেখানে নেপাল থেকে আসা তরুণ সিদ্ধার্থ খ্রিস্টজন্মের প্রায় ছ’শো বছর আগে বোধিলাভ করেছিলেন। এখন সেখানে মহাবোধি মন্দির। ওই মন্দিরের পাশে পিপুল গাছের নীচেই সিদ্ধার্থের বোধিলাভ। যার পাশে তিনশো বছর খ্রিস্টপূর্বাব্দে বালিপাথরের সিংহাসন আর বুদ্ধের স্তূপ তৈরি করেছিলেন সম্রাট অশোক। দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত ওই স্তূপই ছিল বৌদ্ধদের প্রধান আরাধ্য স্থান। তার পর ওখানে শুরু হয় মহাবোধি মন্দির। সপ্তম শতাব্দীতে গুপ্তযুগে শেষ হয় পিপুল গাছের পূর্ব দিকে মহাবোধি মন্দির তৈরির কাজ। মন্দিরের ভিতরে সোনার জল করা কষ্টিপাথরের ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বুদ্ধের বসে থাকার মূর্তি তৈরি করেন পাল রাজারা। ৪৮ বর্গফুট চৌকো বেসমেন্টের বুকে পিরামিডের মতো উপরের দিকে উঠে গিয়েছে মন্দির। লম্বায় যা প্রায় ১৭০ ফুট।

Advertisement

রাজগীরে শান্তিস্তূপ

দিনের পড়ন্ত আলোয় মহাবোধি মন্দির চত্বরে বসে থাকলে, সত্যিই মন জু়ড়িয়ে যায়। এখন তো ওই মন্দির চত্বর জুড়ে তৈরি হয়েছে ৮০ ফুটের বুদ্ধমূর্তি থেকে শুরু করে অজস্র বৌদ্ধবিহার। চিন, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার মতো দেশ থেকে বুদ্ধগয়ায় তৈরি করা হয়েছে বুদ্ধের বিহার বা মন্দির। সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধগয়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক তীর্থক্ষেত্র। তাই, সারা বছর ধরেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বৌদ্ধদের আনাগোনা চলে এখানে। বছরে অন্তত একবার বুদ্ধগয়ায় আসেন দলাইলামাও। সে সময়ে মহাবোধি মন্দিরে বসে ‘শান্তি প্রার্থনা’র আসর। যা সত্যিই দেখার মতো। আর রাস্তাঘাটে জাপানি আদলের শিশুদের ঠেট হিন্দিতে কথা বলতে শুনলে অবাক হবেন না। অনেক জাপানিরই বিশ্বাস, বুদ্ধগয়ার বাসিন্দাদের শরীরে বুদ্ধের অংশ রয়েছে। তাই অনেক জাপানি মহিলাই এখানে এসে বিয়ে করে ফেলেন স্থানীয় ‘গাইড’দের। তার পর এখানেই তাঁদের অর্ধেক সংসার।

আশি ফুট বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধগয়া

বুদ্ধগয়ায় দু’রাত কাটিয়ে পাড়ি দেওয়া যায় নালন্দায়, বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১৪ হেক্টর এলাকা জোড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে পুরাতাত্ত্বিকদের মত, এটা শুধু মাত্র নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল এলাকা। তার পরেও প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় খননকার্যে মিলছে ওই সময়কার নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। নালন্দায় অবশ্য বেশির ভাগটাই একেবারে ধ্বংসাবশেষ। তার মধ্যেই কুষাণ রাজাদের সময়কার স্থাপত্যে তৈরি বিভিন্ন মুদ্রায় বুদ্ধমূর্তি, ছাত্রদের থাকার জায়গা, প্রার্থনাস্থান দেখার মতো। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ঠিক বাইরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের মিউজিয়ামটি দেখতেই হবে।

দিনভর নালন্দা দেখে নিয়ে রওনা হয়ে যান রাজগীরের দিকে, প্রাচীন মগধের প্রথম রাজধানী। দূরত্ব মাত্র ১৫-১৬ কিলোমিটার। পথে সিলাও গ্রামে নেমে যেতে পারেন ঘণ্টাখানেকের জন্য। এখানে মিলবে বিহারের বিখ্যাত ‘সিলাও খাজা’।

মহাবোধি মন্দির

পাহাড় এবং জঙ্গলে ঘেরা রাজগীরের প্রতি অনুচ্ছেদে ইতিহাস। এখানে যেমন আছে মহাভারতের জরাসন্ধের সভা বা ভীম আর জরাসন্ধের লড়াইয়ের স্থান ‘জরাসন্ধ আখাড়া’। তেমনই রয়েছে বন্ধুবর রাজা বিম্বিসারের দান করা জমিতে তৈরি হওয়া বুদ্ধের বাসভবন ‘বেণুবন’। তবে রাজগীরের প্রধান আকর্ষণ অবশ্যই রত্নগিরি এবং গৃদ্ধকূট পর্বত। মগধ তো বটেই, বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাজগীর। রোপওয়ে দিয়ে নীচ থেকে উঠে যাওয়া যায় রত্নগিরি পর্বতে। সেখানে জাপানিদের তৈরি মনাস্ট্রি ও শান্তিস্তূপ দেখার মতো। তার পাশেই গৃদ্ধকূট পর্বত। যেখানে বহু উপদেশ শিষ্যদের দিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধ। এমনকী, অজাতশত্রু তাঁর পিতাকে বন্দি করার পর বিম্বিসারের একমাত্র ইচ্ছে ছিল, এমন জায়গায় তাঁকে বন্দি করা হোক, যেখান থেকে তিনি প্রতিদিন দেখতে পাবেন বুদ্ধের ধীর পায়ে গৃদ্ধকূট পর্বতে উঠে যাওয়া। এখন সেই কারাগারের কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে জায়গাটি অবশ্য দ্রষ্টব্য। আর আছে হিন্দুদের তীর্থক্ষেত্রে উষ্ণ প্রস্রবণ এবং বৈভব পাহাড়ের উপরে সপ্তর্ণী গুহা।

রাজগীর থেকে ফেরার পথে ঘুরে দেখে নিতে পারেন ৩৫ কিলোমিটার দূরে মহাবীরের মহাপরিনির্বাণ স্থান ‘পাওয়াপুরী’ কিংবা ১৮ কিলোমিটার দূরে কুন্দলপুর। জৈনদের দিগম্বর সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, এখানেই জন্মেছিলেন মহাবীর। আর ভারতের সহিষ্ণুতার আর এক নিদর্শন তো সুফি। রাজগীর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে তারই চিহ্ন নিয়ে রয়ে গিয়েছে বিহারশরিফের মকদুম শা শরিফউদ্দিনের দরগা। ঘুরে নিতে পারেন ওই দরগাও।

কীভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে ট্রেনে চলে যান গয়া। সেখান থেকে গাড়ি বুক করে ঘুরে

নেওয়া যায় বুদ্ধগয়া, নালন্দা এবং রাজগীর।

কলকাতা থেকে গয়া নিয়মিত এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান রয়েছে।

কোথায় থাকবেন?

থাকতে পারেন বুদ্ধগয়া কিংবা রাজগীরে। বিহার পর্যটন নিগমের হোটেল বেশ ভাল। এ ছাড়া, রয়েছে অজস্র বেসরকারি হোটেল।

কখন যাবেন

অক্টোবর থেকে মার্চ। ৪ অক্টোবর থেকে ২৬ অক্টোবরের মধ্যে রাজগীর নৃত্য উৎসব চলে। যেতে পারেন সে সময়েও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন