উদ্ভটপুরাণ

ঘটনার সময় শীতকাল। পার্কে মাতাল জুয়াড়ির দলকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে দেখে ক্ষুধার্ত ভবঘুরে ভাবে—সেও যদি কোনও অপরাধ করে আর গ্রেফতার হয়, তা হলে এমন হাড় কাঁপানো শীতে জেলে আশ্রয় পাবে। সেই সঙ্গে বিনিপয়সায় খাবারও জুটবে। কিন্তু সে বেচারা একটার পর একটা অপরাধ করার চেষ্টা করেও বারবার অসফল হয়।

Advertisement

চৈতালি দাশগুপ্ত 

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ২৩:৩৫
Share:

নাটকের একটি দৃশ্য

অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে হয়ে গেল অনসম্বল পরিবেশিত নাটক ‘উদ্ভটপুরাণ’।সোহাগ সেন পরিচালিত এ নাটক ও’ হেনরির অসাধারণ নানা ছোটগল্পের মধ্যে একটি। মূল গল্পের নাম ‘দ্য কপ অ্যান্ড দি অ্যানথেম’। চিরকালীন সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যই হল, তা সব সময়েই প্রাসঙ্গিক। এই গল্পও তাই। আর সেই জন্যই নাটকটি এই সময়ের বিপন্নতার কথা বলে। এ রাজ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া অসংখ্য কল-কারখানার ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকদের গল্প। নাটকের মূল চরিত্র এমনই এক প্রাক্তন শ্রমিক—হতদরিদ্র গৃহহীন এক ভবঘুরে। দারিদ্র্য তাকে কেবল ঘরছাড়াই করেনি, কেড়ে নিয়েছে তার স্ত্রীকেও। স্ত্রী এখন অন্য কাউকে ভালবাসে। তবুও বেকার শ্রমিকটি এখনও ভালবাসে তার স্ত্রীকে। তাই সে কষ্ট পায়—স্ত্রীর ছেড়ে যাওয়ার বেদনা তাকে দগ্ধ করে অহরহ।

Advertisement

ঘটনার সময় শীতকাল। পার্কে মাতাল জুয়াড়ির দলকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হতে দেখে ক্ষুধার্ত ভবঘুরে ভাবে—সেও যদি কোনও অপরাধ করে আর গ্রেফতার হয়, তা হলে এমন হাড় কাঁপানো শীতে জেলে আশ্রয় পাবে। সেই সঙ্গে বিনিপয়সায় খাবারও জুটবে। কিন্তু সে বেচারা একটার পর একটা অপরাধ করার চেষ্টা করেও বারবার অসফল হয়। তখনই বিফলমনোরথ ভবঘুরের সঙ্গে পার্কে দেখা হয় একজনের—নিজেও যে কিনা তারই মতো বেকার—কিন্তু বাড়িতে জানায়নি যে, তার চাকরি গিয়েছে। তাই অফিসটাইমে এসে বসে থাকে পার্কে আর অফিস ছুটির সময় হলে বাড়িতে ফেরে। এ হেন লোকটির সঙ্গে ভবঘুরের বন্ধুত্ব হয়, লোকটি ওকে বিস্কুট খাওয়ায়। তখন থেকে সে ভবঘুরের ‘বিস্কুটদাদা’। পার্কে আর এক জনের সঙ্গে আলাপ হয় ভবঘুরের—একটি মেয়ের সঙ্গে। সেও দারিদ্র্যের শিকার, পেট চালাতে গণিকাবৃত্তিকে পেশা করেছে। ভবঘুরে মানুষটিকে দেখে তার মায়া হয়, নিজের খুন হয়ে যাওয়া ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। সেই মায়ার বশবর্তী হয়েই সে মাঝে মাঝে এটা-ওটা রান্না করে এনে খাওয়ায় ভবঘুরেকে।

বিস্কুটদাদা একদিন এই ভবঘুরে লোকটিকে এক বেআইনি সিন্ডিকেটে কাজ পাইয়ে দেয়, যেখানে সে নিজেও কাজে যোগ দিয়েছে। বিস্কুটদাদা তাকে বোঝায় যে, এ বাজারে ‘সততা’ একটা মূল্যহীন শব্দ। এই ভয়ানক সত্য যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা দর্শক মাত্রই জানেন। ভবঘুরেও বোঝে ও উল্লসিত হয়। উল্লাসের চোটে প্রচুর মদ খেয়ে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এ দিকে সেই রাতেই ভবঘুরের স্ত্রী তার প্রেমিকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে একদল গুন্ডার কবলে পড়ে ওই পার্কেই। তার অসহায় কান্নায় ভবঘুরের ঘুম ভেঙে যায় এবং সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে। সেই চিৎকারেই লোকগুলো মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে যায়। স্বামী স্ত্রী একে অপরকে চিনতে পারে আর ভবঘুরে এ বার হাত বাড়িয়ে দেয় তার স্ত্রীর দিকে।

Advertisement

এখানেই শেষ হতে পারত এই নাটকটি—অন দ্য হ্যাপি নোট! কিন্তু ছোট গল্পের মোচড় থাকে একেবারে শেষ লাইনে এসে। পুলিশ এসে ভবঘুরেকে ধর্ষণকারী ভেবে গ্রেফতার করে। জীবনের চরমতম ট্র্যাজেডি বুঝি এখানেই। নাটকটি শেষ হয় এই এক বিষণ্ণতা নিয়েই।

ভবঘুরের চরিত্রে কৌশিক বসুর অভিনয় এই নাটকের সবচেয়ে বড় সম্পদ। নাটকটির সহ-নির্দেশক তিনিই। গণিকার চরিত্রে সুতপা ঘোষের অভিনয় উল্লেখের দাবি রাখে। তাঁর গাওয়া গানের প্রয়োগটি মন ছুঁয়ে যায়। বিস্কুটদাদার চরিত্রে কজ্জল ঘোষকে মানিয়েছে ভাল। ইন্দ্র হালদার, শান্তনু মজুমদার, সুলগ্না চৌধুরী এবং নাটকের অন্য অভিনেতারা যথাযথ। ‘উদ্ভটপুরাণ’ নাটকের ভাবনা ও নির্দেশনা সোহাগ সেনের। অনসম্বল-এর নেপথ্যের কলাকুশলীরা ছিলেন মঞ্চে উপস্থিত শিল্পীদের সমান কৃতিত্বের অধিকারী। শেষত বলতেই হবে—উদ্ভট হলেও নাটক বা পুরাণটি কিন্তু রূঢ় বাস্তব!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন