অভিমানী শ্রীমতী

অভিনয়, গান, প্রযোজনা... সবেতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি কাননদেবী। কিন্তু ভারতীয় সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্রতিনিধির জীবনসংগ্রাম কেমন ছিল? খোঁজার চেষ্টা করলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়অভিনয়, গান, প্রযোজনা... সবেতেই তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি কাননদেবী। কিন্তু ভারতীয় সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই প্রতিনিধির জীবনসংগ্রাম কেমন ছিল? খোঁজার চেষ্টা করলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share:

(১)

Advertisement

শুটিং ফ্লোর তৈরি। লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন... প্রস্তুত কৃষ্ণ। কিন্তু রাধা কই! ফ্লোরে হুল্লোড়। খোঁজ খোঁজ।

আচমকা প্রোডাকশনের এক কর্মী চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ওই তো...’ রাধা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন পেয়ারা গাছের ডালে! তাকে নামিয়েই পরিচালকের সটান থাপ্পড়।

Advertisement

সিনেমাটি নির্বাক। নাম ‘জয়দেব’। পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাধাবেশী ন’-দশ বছরের কিশোরীটি কাননদেবী। থাপ্পড়টা ‘শিক্ষা’র জন্য হলেও বড্ড লেগেছিল মনে। শেষে কিনা ‘দাদু’ও মারল তাকে! বাড়ি ফিরে অপমানে ফুঁপিয়ে কান্না মেয়ের।

কান্নাটা স্বাভাবিকই।

জাম্প কাট। ১৯১৬-য় জন্ম কাননদেবীর। বাবা রতনচন্দ্র দাস। মা রাজবালাদেবী। রতনবাবু মার্চেন্ট অফিসের কর্মী। একটা ছোট গয়নার দোকানও রয়েছে। কিন্তু তাঁর রেসের মাঠে টাকা ওড়ানোর নেশা পরিবারটিকে পথে বসাল। বাজারে প্রচুর ঋণ রেখে মারা গেলেন তিনি। রাজবালাদেবী সর্বস্ব খুইয়ে সেই ঋণ শোধ করলেন। এক কাপড়ে উঠলেন আত্মীয়বাড়ি।

শুরুতেই ধাক্কা। আত্মীয়রা বাড়ির পরিচারিকা ও রাঁধুনিকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেন। শুরু হল মা-মেয়ের হাড়ভাঙা খাটুনি। এমনই একদিন রাজবালার হাত থেকে একটা চায়ের প্লেট পড়ে ভেঙে গেল। বাড়িসুদ্ধ লোক রে রে করে তেড়ে এলেন। আর থাকতে পারলেন না। রাজবালা উঠলেন হাওড়ার এক হতশ্রী ভাড়াবাড়িতে। সেখানকার পরিবেশে দম বন্ধ হয়ে আসে কাননের। স্কুলের পড়াটাও হল না, যথাসময়ে টাকা না দিতে পারায়।

ভারতীয় সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ও গায়িকা কাননদেবী ছোটবেলা থেকেই এ ভাবে বঞ্চনা, উপেক্ষা আর অভিমান— এই তিনটি শব্দকে পড়ে ফেলতে শিখলেন। এই তিনটি শব্দ তাই বোধহয় পিছু ছাড়ল না জীবনভর। বহু পরে তাই তিনি বসন্ত চৌধুরীকে বলবেন, ‘সমাজ আমাকে অনেক আঘাত দিয়েছিল, আমাকে অনেক বেশি অবহেলা করেছিল।’

অবহেলা থেকে মুক্তি পেতেই হয়তো পা়ড়ার ‘কাকাবাবু’ তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে ম্যাডান থিয়েটারে ‘জয়দেব’ সিনেমায় অভিনয় করা হল। পারিশ্রমিক মিলল পাঁচটি টাকা। অথচ পাওয়ার কথা ছিল ২৫ টাকা! বাকি টাকাটা ‘মিডলম্যান’রা নিয়ে নিয়েছে।

পারিশ্রমিকে বঞ্চনা হলেও এই সময়ে ‘দাদু’ জ্যোতিষবাবু কিশোরী কাননকে দীক্ষা দিয়েছিলেন সিনেমার প্রথম পাঠের। একেবারে প্রথম দিনের শুটিং। আয়না আর রিফ্লেক্টর দিয়ে আলো ফেলা হচ্ছে। চড়া আলোয় কুঁকড়ে গেলেন কানন। বললেন, ‘আমি পারব না।’ সঙ্গে কান্না। মৃদু ভর্ৎসনা করে জ্যোতিষবাবু বললেন, ‘ছি! অত ঘাবড়াতে নেই।’ এর পরে ‘শঙ্করাচার্য’ নামে একটি নির্বাক সিনেমায় অভিনয় করলেন কানন।

মুনমুন সেনের বিয়েতে, সুচিত্রা সেনের সঙ্গে। ছবি: ধীরেন দেব

(২)

ধীরে ধীরে ‘লাইট, ক্যামেরা’র যুগ থেকে সিনেমা ‘সাউন্ড, ক্যামেরা, অ্যাকশন’-এর যুগে হাঁটি হাঁটি ঢুকে পড়ল। ছবি কথা বলল।

সিনেমা ‘জোর বরাত’। সাল ১৯৩১। ‘সাউন্ড টেস্ট’ দিয়ে মনোনীত হলেন কানন। কিন্তু এই সিনেমাতেই ঘটল ফের এক ঘটনা।

একটি দৃশ্য প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। আচমকা সিনেমার নায়ক জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলেন কাননদেবীকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত অপমানিত কাননদেবীর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা হল যেন। ফের এগিয়ে এলেন পরিচালক জ্যোতিষবাবু। বললেন, ‘সাধারণ মানুষ আর শিল্পী এক নয়। সাধারণের কাছে যা কল্পনাতীত, শিল্পীর কাছে তা স্বাভাবিক।’ কিন্তু শত বোঝানোতেও কাজ হল না। দৃশ্যটি শেষমেশ বাদ দেওয়া হল সিনেমা থেকে।

এর পরে ধীরে ধীরে ম্যাডান থিয়েটার, রাধা ফিল্মস প্রভৃতি পথ পেরিয়ে কাননদেবী যোগ দিয়েলেন বিখ্যাত নিউ থিয়েটার্সে। ‘মা’, ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’, ‘খুনি কৌন’, ‘মুক্তি’, ‘বিদ্যাপতি’ প্রভৃতি সিনেমায় কাননদেবীর অভিনয় জয় করল ভারতচিত্ত।

সাফল্য মিললেও ফের এক অপমানের সম্মুখীন হলেন কানন। তখন কবীর রোডে বাড়ি তৈরি করবেন ঠিক করে নিউ থিয়েটার্স থেকে বেশ কিছু টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছেন। পরে তা শোধও করলেন। কিন্তু চুক্তিপত্র ‘রিনিউ’-এর সময়ে কাননদেবী রাখলেন দু’টি শর্ত। বললেন, ‘আমার মাইনে ১৪০০ টাকা করতে হবে। আমাকে বাইরের ব্যানারে ছবি করার অনুমতিও দিতে হবে।’ নিজের সপক্ষে যুক্তিও দিলেন কানন। তাঁর মতে, অনেক কম কৃতী শিল্পীরাও এই টাকা মাইনে পাচ্ছেন। আবার কেএল সায়গলকে বাইরে সিনেমা করারও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নিউ থিয়েটার্স কর্তৃপক্ষ দু’টি শর্তের কোনওটাই মানলেন না। মাইনে তাঁরা ১২০০ টাকা
পর্যন্ত দিতে রাজি হলেন। তিক্ততা নিয়েই শেষ হল কাননদেবীর নিউ থিয়েটার্স পর্ব।

প্রচণ্ড কষ্ট পেলেন কানন। তিনি এত সফল সিনেমা দিয়েছেন। তার বদলে এই ব্যবহার!

কিন্তু পিছু ফিরে তাকাতে হল না তাঁকে। প্রমথেশ বড়়ুয়ার পরিচালনায় ‘শেষ উত্তর’-এ অভিনয় করলেন কাননদেবী। পরিচালক প্রমথেশবাবুর স্বভাব— কোনও চরিত্রের কথা অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে বুঝিয়ে বলা। কিন্তু কাননদেবীকে তা বোঝাতেন না। এ জন্য বেশ অভিমানও হল কাননদেবীর। কিন্তু শুটিং ফ্লোরে আচমকা একদিন প্রমথেশবাবু কাননকে বললেন, ‘তোমার মতো আর্টিস্টকে বেশি কথা বলার যে দরকার পড়ে না।’ কৃতজ্ঞতায় চোখ ছলছল করে ওঠে কাননের।

বড়ুয়া সাহেব প্রসঙ্গে একটি আক্ষেপও ছিল কাননদেবীর। তাও সিনেমার সূত্রেই। এক সময় তাঁকে ‘দেবদাস’ সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে রাধা ফিল্মসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ায় তা আর করা হয়নি।

ইডেন গার্ডেন্সে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে

(৩)

তবে কাননদেবীর শিল্পী-জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ বোধহয় গানের প্রতি সময় দিতে না পারা।

কাননের জীবনে সংগীতশিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছে শৈশবেই, বাড়ির কাছেই থাকা ‘ভোলাদা’র কাছে। পরে ওস্তাদ আলারাক্কা, পঙ্কজ মল্লিক, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আখতারী বাঈ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, দিলীপ রায়, নজরুল ইসলাম প্রমুখ দিকপালের কাছে।

সিনেমার জগতে ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ ছবিতেই তাঁর প্রথম গান রেকর্ডিং। কাননদেবীর সংগীতপ্রতিভা কেমন, তা বোঝা যায় দুই দিকপাল রাইচাঁদ বড়াল ও পঙ্কজ মল্লিকের সূত্রে।

‘বিদ্যাপতি’ ছবির গানের রেকর্ডিং হবে। গান গাইবেন কানন। রাইবাবু বললেন, ‘মাত্র চারটে চান্স দেব।’ তা আর দরকার হল না, দুটো চান্সেই পাশ করলেন কানন।

ছবির নাম ‘মুক্তি’। সংগীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক। তাঁর তত্ত্বাবধানেই কানন এই প্রথম সিনেমায় গাইলেন রবীন্দ্রসংগীত। বাঙালির হৃদয় জয় করল সে গান। তাঁর কণ্ঠে ‘আজ সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে’, ‘সেই ভালো সেই ভালো’, ‘আমি বনফুল গো’, ‘কুঁচবরণ রাজকন্যার মেঘবরণ কেশ’, ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’ প্রভৃতি গান পাড়ায় পাড়ায় জনপ্রিয় হল। পঙ্কজবাবু কাননদেবী সম্পর্কে মূল্যায়ন করলেন, ‘ফার্স্ট সিঙ্গিং স্টার অব নিউ থিয়েটার্স।’

সিনেমায় সংগীতজীবনে এক জন মানুষের সঙ্গ কাননের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।

সে কালে গান রেকর্ডিংয়ের সময় মাইক থাকত একটি। ফলে শিল্পীদের মধ্যে মাইক দখলের একটা প্রতিযোগিতা ছিল।

একদিন রেকর্ডিংয়ের সময়। কানন তেমন অভিজ্ঞতা ঘটবে ভেবেই গিয়েছেন। কিন্তু এসে দেখেন, এ শিল্পী নিজের জায়গাটুকু ছেড়ে দিচ্ছেন ‘বহিন’-এর জন্য। শিল্পীর নাম কেএল সায়গল।

কিন্তু যে সংগীতের সূত্রে খ্যাতি-পরিচয় মিলল, সেই গানই এক দিন ছেড়ে গেল কাননকে। কেন? অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায় লিখছেন, ‘গানের জন্য বাড়িতে তাঁকে এত অসম্মানিত হতে হয়েছে যে, অভিমান করে তিনি গান গাওয়াটাই ছেড়ে দিয়েছেন।’ যদিও কাননের নিজের মত, ‘পরবর্তী জীবনে গানকে সাধনা হিসেবে নেওয়ার মতো সময় ছিল না। তাই আমি নই, গানই অভিমান করে সরে গেল।’

এ প্রসঙ্গে হয়তো কাননের প্রথম যুগের গুরু আলারাক্কার একটি কথা মনে পড়ে কাননের। সিনেমায় ব্যস্ত থাকায় ঠিক রেওয়াজ করা হয় না। ছাত্রীর অমনোযোগ দেখে ওস্তাদও অভিমানী। আর এলেন না ‘বেটি’র কাছে। যাওয়ার আগে কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সংগীতজীবনটা শেষ হতে পারে।

গান নিয়ে আক্ষেপ তাড়া করেছে কাননদেবীকেও। আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ একদিন কাননের বাড়িতে সুভো ঠাকুরের সাজানো ড্রয়িং রুমে গান ধরেছেন। অদূরেই টাঙানো যামিনী রায়ের আঁকা অরিজিনাল পেন্টিং। খানিক আনমনা হয়ে সে দিকে তাকিয়েই যেন মুগ্ধ শ্রোতা কানন বলে ফেললেন, ‘জীবনে কিছুই শিখতে পারলাম না, জ্ঞানবাবু।’

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অলঙ্কার দান

(৪)

অভিমানের মালা গাঁথতে গিয়ে সংগীত ছাড়াও আরও বেশ কিছু আক্ষেপের ফুল তুলেছেন কানন।

তার একটা যেমন রবীন্দ্রনাথকে গান শোনাতে না পারা। আমন্ত্রণের দিনটা মনে পড়ে কাননের। তখন তিনি ‘বিদ্যাপতি’ সিনেমায় শুটিং করছেন। হঠাৎ খবর— হিন্দুস্থান রেকর্ডসে আসছেন রবীন্দ্রনাথ। মেকআপ নিয়েই ছুটলেন কবিকে দেখতে। প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশের ভাই প্রফুল্লবাবু কবির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। তখনই রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানালেন, শান্তিনিকেতনে এসে গান শোনানোর।

তবে আক্ষেপের পাশে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গই বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে কাননের জীবনে। রবীন্দ্রনাথের সই করা একটি ছবি নাকি উপহার পেয়েছেন কানন। হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ের সময়ে। খবরটা জানাজানি হতেই সমাজের এক ‘বিখ্যাত’ মহিলা ঘোষণা করলেন, ‘অভিনেত্রীর কখনওই কবিগুরুর স্বাক্ষরিত ছবি রাখার অধিকার নেই!’

আসলে শুধু উপহারই নয়, বিতর্ক তাড়া করেছে কাননদেবীর ব্যক্তিজীবনেও।

কাননদেবীর প্রথম বিয়ে বিখ্যাত ব্রাহ্ম ও শিক্ষাবিদ হেরম্ব মৈত্রর ছেলে অশোক মৈত্রর সঙ্গে। অশোকবাবু অক্সফোর্ড ফেরত, শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক। অশোক-কাননের বিয়ে হল। কিন্তু হেরম্ববাবু এ বিয়ে মানলেন না। কাননও বুঝলেন, এ বিয়েকে সমাজ ‘সম্ভ্রমের বরণডালা দিয়ে বরণ’ করবে না। কিন্তু যে জন্য এত কিছু, সেই বিয়েটাও তো টিকল না!

কাননের হৃদয় ভাসে। গেয়ে ওঠেন, ‘যে-কেহ মোরে দিয়েছ
সুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়,/ সবারে আমি নমি।’

বিয়ে ভাঙলেও প্রেম ফের এল কাননের জীবনে। ঘটনাটি সিনেম্যাটিক। ১৯৪৯ সাল। টালিগঞ্জে নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুল। পুরস্কার বিতরণী সভায় রয়েছেন কানন। রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল কৈলাসনাথ কাটজু। কিন্তু রাজ্যপালের পাশে ও কে দাঁড়িয়ে? অমন সুপুরুষ! চোখে চোখে কথা হয়!

চলে ফোনে কথাবার্তা। হয় আলাপও। সেই সঙ্গে চেপে বসে ভয়, ফের যদি স্বপ্ন ভাঙে? কিন্তু তত দিনে ওই মানুষটি প্রস্তাব দিয়েছেন, ‘এত কষ্ট করে ফোন না করে দেখাশোনার পাকাপাকি ব্যবস্থাটা করে নিলে হয় না?’ ভীতি কাটিয়ে ‘নেভাল এডিসি’ হরিদাসবাবুর সঙ্গে বিয়েটা সেরেই ফেললেন কানন।

কিন্তু সে দাম্পত্যও কি সুখের ছিল? নানা জনে নানা কথা বলেন এ নিয়েও। গোটা জীবন জুড়ে একটি কথা বোধহয় তাই কাননের প্রায়ই মনে পড়েছে। তাঁর প্রিয় শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র দে একবার বলেছিলেন, ‘যে কঠিন তপস্যায় তুমি নেমেছো, তাতে তো বাধা আসবেই, অশ্রুপাথার পার না হলে কি শ্যামের কাছে পৌঁছনো যায়?’

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ছবি: সমর দাস

(৫)

আসলে ওই ‘অশ্রু’ এবং যন্ত্রণাই কাননদেবীকে আরও জীবনসংগ্রামী করে তুলল।

আর তাই মুম্বইয়ের প্রযোজক চন্দুলাল শাহকে ফেরাতেও এক মুহূর্ত সময় নেন না তিনি। চন্দুলাল তাঁকে মাসে পাঁচ লাখ টাকা মাইনে দিয়ে বলিউডে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন! কিন্তু কাননদেবীর এক রা, ‘দরকার পড়লে বোম্বে আসবে এখানে’। তাই-ই এসেছিল, ‘কৃষ্ণলীলা’ ছবির জন্য। এর জন্য কাননদেবী পারিশ্রমিক পেলেন ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। একই পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন সহ-অভিনেতা অশোককুমারের বিপরীতে ‘চন্দ্রশেখর’ ছবিতে অভিনয় করেও।

কিন্তু দিনে দিনে ‘হিরোদের চোখেমুখে নির্লজ্জ লুব্ধতা আর স্থূল লোলুপতা’ এবং ভয়াবহ ‘পরিচালক সংবাদ’ কাননকে ভাবতে বাধ্য করল শিল্পীর স্বাধীনতার বিষয়টি। বিশ্বাস করলেন, এমন এক সিনে-জগতের, যেখানে ‘কোথাও কর্তৃত্বের পীড়ন থাকবে না’।

নিলেন এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনা।

১৯৪৮-’৪৯ থেকে পথচলা শুরু কাননদেবীর প্রোডাকশন হাউস ‘শ্রীমতী পিকচার্স’-এর। ঠিকানা, অভিনেত্রীরই বাড়ি ১ নম্বর রিজেন্ট গ্রোভ এলাকায়। ক্যামেরাম্যান হিসেবে যোগ দিলেন অজয় কর।

কিন্তু নাম ‘শ্রীমতী’ কেন? আসলে গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র কাননকে বলতেন ‘রাধে’। নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিও ম্যানেজার পিএন রায়ের কাছে তিনিই ছিলেন ‘শ্রীমতী’। এই সম্বোধনগুলি বড় প্রিয় যে কাননের।

শ্রীমতী পিকচার্সে কাননদেবী ধরা দিলেন ‘রাশভারী’ এবং ‘ঘরোয়া’ রূপে।

কেমন তা? সদ্য পরিচালনায় হাত পাকাচ্ছেন এক জন। করছেন চিত্রনাট্য কপি করার কাজ। সেই যুবক ও তাঁর সহকর্মীরা প্রায়শই ক্লান্ত হয়ে পড়েন কাজ করতে করতে। আর তা দেখেই কানন সকলকে ডেকে নিয়ে গেলেন ব্যাডমিন্টন কোর্টে। খেলাধুলোর মাধ্যমে চাঙ্গা থাকা আর কী! সে দিনের ওই যুবকটি তরুণ মজুমদার।

অন্য একদিন। হঠাৎ একটু ভারী চেহারার পরিচিত এক ভদ্রলোক হাজির। এসেই আবদার, ‘টাটকা চুনো মাছের ঝোল খাব।’ বিস্তর খোঁজের পরে মাছ মিলল। আর তা কাটতে বসলেন কাননদেবী।

সিনেমার শুটিংয়ের সময় এই কাননদেবীকেই পাওয়া গেল অন্য রূপে। গল্পটা শুনিয়েছেন অভিনেত্রী শোভা দে। ছবির নাম ‘বামুনের মেয়ে’। জ্ঞানদা চরিত্রে শোভাদেবী অভিনয় করছেন। একদিন একটা দৃশ্যে অভিনয়ের পরেই শোনা গেল কাননদেবীর গলা, ‘এটা ‘রি-টেক’ করো।’ কেন? ‘তা হলে কিছু ভুল হল?’ ভাবছেন সিনেমায় নবাগতা শোভা। তাঁর অবস্থা দেখে হাসিমুখে কাননদেবী বললেন, ‘সবই ঠিক আছে। তবে তোমার কান্নাটা ছবিতে হাসির মতো দেখাচ্ছে।’

অভিনেতাদের সঙ্গে খুব সহজ ভাবে মেশায় জুড়ি মেলা ভার কাননদেবীর। ছবির নাম ‘নববিধান’। নায়ক কমল মিত্র। কমলবাবুর একটা স্বভাব ছিল— সাধারণত উনি হলে গিয়ে সিনেমা দেখতেন না। নিজের ছবি তো নয়ই। শুটিং শেষে একদিন আচমকা কাননদেবীর আগমন কমলবাবুর বাড়িতে। বললেন, ‘চলুন এখুনি, ছবিটা আমরা দেখব।’ এ কথা কিছুতেই ফেরানো সম্ভব হল না কমলবাবুর পক্ষে।

আসলে কাননদেবীকে ফেরানো সম্ভবও নয়। ফেরাতে পারেননি উত্তমকুমারও। ১৯৫৫-য় ‘দেবত্র’ সিনেমা। মহানায়কের হাতে তখন প্রায় আটটি ছবি। তবুও রাজি হলেন উত্তম। ‘কেন এমনটা?’ জিজ্ঞাসা করলেন ভাই তরুণকুমার। উত্তমের উত্তর, ‘কাননদেবীর সঙ্গে অভিনয় করব, এ আমার সৌভাগ্য।’

(৬)

তবে এই প্রোডাকশন হাউস খোলার ভাবনাচিন্তাটা এক দিনে হয়নি। আর তাই তাঁকে দেখি পাশ্চাত্যে ইংল্যান্ড, আমেরিকার একাধিক স্টুডিয়োয় কী ভাবে কাজ হয়, তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে। এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশ ও রানী মহালানবীশ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন বিদেশি সিনেমা ও অভিনেতাদের বিষয়ে। বিলেতে ঘুরতে ঘুরতেও কাননের মন পড়ে কিন্তু এই বাংলাতেই। মনে হল, পাশ্চাত্যের বিখ্যাত স্টুডিয়োগুলোর তুলনায় ভারতবর্ষের স্টুডিয়োগুলো যেন ‘তাসের ঘর’। আক্ষেপ করলেন, যদি এ সব সুযোগ মিলত, তা হলে হলিউডের চেয়েও বড় চলচ্চিত্রক্ষেত্র হত ভারতবর্ষ।

কাননদেবী বিলেতে থাকাকালীনই দেশ স্বাধীন হল। ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট ইংল্যান্ডে ভারতের হাইকমিশনার কৃষ্ণ মেনন ‘ইন্ডিয়া হাউস’-এ সভার আয়োজন করলেন। গাওয়া হল জাতীয় সংগীত। আর তার পরেই শোনা গেল রবীন্দ্রসুর, কাননদেবীর কণ্ঠে। বিদেশে থাকাকালীনই বিখ্যাত রূপ-বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ আর্চেন ও হেলিনা রুবেনস্টাইনের সংস্পর্শে এলেন কানন। শিখে নিলেন রূপচর্চার খুঁটিনাটি। এতটা নিষ্ঠার কারণেই বোধহয় তাঁর হাত ধরেই ‘নীহারিকা ব্লাউজ’, ‘অনুরাধা টিপ’, ‘পরিচয় শাড়ি’ বা ‘মুক্তি’ ছবিতে নায়িকার কেশ-বিন্যাসও মহিলাদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়।

(৭)

তবে শুধু জনপ্রিয়তা নয়। সেই সঙ্গে কাননদেবীর আরও একটি চরিত্রও ছিল। আর তা হল সহ-শিল্পীদের প্রতি সহমর্মিতা।

এ প্রসঙ্গে একটি ছোট্ট ঘটনা।

দিনটা বিশ্বকর্মা পুজোর। অভিনেত্রী ভারতী দেবীর বাড়িতে হঠাৎ হাজির কাননদেবী। সঙ্গী অভিনেত্রী সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনাদেবী, চন্দ্রাদেবী। রাতভর চলল বিস্তর হই-হুল্লোড়। সেখানেই পরিকল্পনা হল, বিগত দিনের মহিলা শিল্পীদের সহযোগিতা করতে হবে। তৈরি হল ‘মহিলা শিল্পীমহল’। নাটক করে, ব্যক্তিগত দানের মাধ্যমে শুরু প্রতিষ্ঠানটির পথচলা। এই প্রতিষ্ঠানটির জন্য নিজের অভিনয়-জীবনের স্বেচ্ছা-নির্বাসন ভাঙতেও কসুর করলেন না কাননদেবী। সংগঠনের জন্য ‘মিশরকুমারী’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করেছেন সরযূবালাদেবী ও ভারতীদেবী। কাননদেবীকে প্রস্তাব, ‘একটা মেয়ের বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে হবে!’ এক মুহূর্তও সময় নিলেন না কাননদেবী।

কিন্তু নানা কারণে এ প্রতিষ্ঠানটিও শেষ হল। ভারতীদেবীর মনে পড়ে ‘সেদিনকার কাননদির কান্না’।

(৮)

এই কান্নাই হয়তো কাননদেবীকে জীবনের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেল অধ্যাত্মবাদের কাছে। আর তাই গোপালসেবার জন্য রোজ সকালে উঠে বাগান থেকে ফুল তুলে মালা গাঁথেন তিনি। ঈশ্বরবিশ্বাস কোন পর্যায়ে ছিল, তা কাননই ব্যাখ্যা করেছেন, ‘খ্যাতির কাছে, প্রেমের কাছে, জীবনের কাছে যা পাইনি, আজ তা পেয়েছি আমার ঠাকুরঘরে।’

হয়তো তাঁর এই ঈশ্বরবিশ্বাসের মধ্যে কোথাও মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীরও একটা প্রভাব ছিল। সোদপুরে গাঁধীর প্রার্থনাসভায় যোগ দিয়ে আশীর্বাদ নিয়েছিলেন কানন। বাড়ি ফেরার পথে, তৈরি হল ‘সবকো সন্মতি দে ভগবান’-এর অনুরণন।

কানন শান্তি পেয়েছিলেন ঈশ্বরবিশ্বাসে।

কিন্তু অভিমান কি মিটেছিল? দাদাসাহেব ফালকে, পদ্মশ্রী, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার, ইন্ডিয়া ফিল্ম ল্যাবরেটরির অন্যতম ডিরেক্টর সব সম্মানই পাওয়া হয়েছে কাননদেবীর। কিন্তু তাঁর বোধহয় আরও কিছু প্রাপ্য ছিল। না হলে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডি. লিট’ পাওয়ার সময়ে মাধবী মুখোপাধ্যায়কে কেন বলবেন, ‘জানিস তো মাধু, কেউ আসেনি। একমাত্র তুই-ই এসেছিস।’

(৯)

‘কেউ আসে না’, হয়তো এ অভিমান নিয়েই কাননদেবী বিদায় নিলেন।

কাননদেবী হাসপাতালে যাচ্ছেন। সেই সময়ে বাড়ির পুরনো পরিচারক গণেশবাবুকে বললেন, ‘গণেশ, যাচ্ছি। বাড়িটা একটু দেখো।’ ১৭ জুলাই, ১৯৯২ প্রয়াণ এই নায়িকার। তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও সিনেমা জগতের বিশিষ্টরা শ্রদ্ধা জানালেন। সব সময় পাশে ছিলেন ছেলে সিদ্ধার্থ, পুত্রবধূ রুবি ভট্টাচার্য ও পরিবার। শেষ পর্যন্ত থাকলেন বুদ্ধবাবুর একান্ত সচিব অংশু শূর।

কিন্তু শেষযাত্রায় দেখা গেল না শিল্পীমহলের বিখ্যাত কাউকেই। আসেননি সেই সময়ে মধ্যগগনে থাকা এক বিখ্যাত অভিনেত্রীও। শেষমেশ কেওড়াতলায় বৈদ্যুতিন চুল্লিতে নয়, কাননদেবীর দেহ দাহ করা হয় কাঠের চুল্লিতে।

ঋণ: আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ, ‘দেশ’, ‘আনন্দলোক’, ‘বৈশাখী’ (শতবর্ষে কাননদেবী), ‘সপ্তাহ’, ‘কলেজ স্ট্রীট’, ‘মাধবীকানন’, ‘সোনার দাগ: শতবর্ষের আলোয় বাংলা চলচ্চিত্র’, ‘ওভারল্যান্ড’, ‘সাহানা’, ‘কানন দেবী: দ্য ফার্স্ট সুপারস্টার অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন