নিজের বাড়িতে প্রান্তবেলার দেবদুলাল
মোটা পাওয়ারের চশমা। মাইক্রোফোনের কাছে হুমড়ি খেয়ে সংবাদ পড়ছেন।
আমি দেখছি, কাচের ঘরের মধ্যে শব্দের ওজনে, ঘটনার ভিন্নতায় ওই ব্যারিটোন ভয়েস কেমন করে শরীরের ভঙ্গিমাকে বদলে দিচ্ছে।
মনে হত দিন-রাতের অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে সময়। তৈরি হচ্ছে খবর।
দেবুদাকে সেই আমার প্রথম দেখা। তত দিনে অবশ্য ওঁর কিছুটা পরিচয় পেয়ে গিয়েছি। আপাতগম্ভীর একজন মানুষ। ভেতরে ভেতরে কিন্তু অসম্ভব রসিক।
একবারের ঘটনা মনে পড়ছে। কাজের জন্যই আকাশবাণীতে রাতে থেকে যেতে হয়েছিল আমায়।
ভোরে অনুষ্ঠানও ছিল। অগত্যা ক্যান্টিনে খাওয়া সেরে বারান্দায় এসে দেখি রাজভবনের পিছনে গাছগাছালিতে ভরা সরু রাস্তাটা পুরো যেন মায়াবী চেহারা নিয়েছে। ঘন শীতের রাত কেমন যেন অতিলৌকিক ঠেকেছিল!
গার্স্টিন প্লেস থেকে আকাশবাণী তত দিনে ইডেন উদ্যান ভবনে উঠে এলেও ওখানকার ভূতের গল্পটা কিন্তু চালু ছিল তখনও।
রেডিয়োর সুর যেমন হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, ভূতেরাও যেন ওই হাওয়ায় হাওয়ায় চলে আসত। কতটুকুই বা পথ!
ভূতে যে বড় একটা বিশ্বাস ছিল তা নয়। কিন্তু শিরশিরানি একটা ভয় যে শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল, আজও স্বীকার করতে বাধা নেই।
বালিশ চাদর নিয়ে যেখানে গানের অডিশন নেওয়া হয়, সেখানেই শুয়ে পড়লাম। পাশে পার্থ ঘোষ (বিশিষ্ট ঘোষক)।
স্টুডিয়োর ঘড়িতে টিকটিক আওয়াজ। তার মাঝেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি আমি।
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল। শুনলাম কোত্থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আর তার পরেই অট্টহাসি!
উঠে আলো জ্বালব যে, সে সাহস অবধি পাচ্ছি না। শীতের রাতে আরও জবুথবু হয়ে আছি।
হঠাৎ দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখি কালো চাদর মোড়া, ঢ্যাঙা একটা ছায়া, সঙ্গে খর্বকায় আরও একটি। বাপরে! হুশ করে নিমেষে উধাও। ধড়াস করে উঠল বুকটা!
তাও সাহস করে বাইরে আসতেই দেখি সেই লম্বা ছায়া আসলে ছায়া নয়, একটা লোক। স্বয়ং দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছেন, বলছেন, কী ভয় পেয়েছিলি তো? আর তার পাশের জন অসিতদা (মজুমদার)। ডিউটি অফিসার। ঘোমটা পরে লাজুক হাসছেন!
বর্ধমানের একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমরা অনেকেই গিয়েছি একসঙ্গে। শক্তিদাও (চট্টোপাধ্যায়) আছেন। সুনীলদা-শক্তিদার সঙ্গে তো দেবুদার তুইতোকারি সম্পর্ক ছিল। তো, সারা রাত আড্ডা চলছে।
শক্তিদা আড্ডার ছলেই হঠাৎ বাজখাই গলায় বলে উঠলেন, “এই যে দেবদুলাল, কী নিউজ পড় বাবা? যত্তসব....!” অমনি দেবুদা রীতিমত চেয়ার তুলে ছুটে গেলেন শক্তিদার দিকে। সে এক কাণ্ড! গলা তুলে বললেন, “কী সব কবিতা লেখো শক্তি? ধুসসসস ওগুলো নাকি কবিতা!” আমার বয়স তখন খুবই কম, একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে যেতাম, ভাবতাম ভারী চশমার আড়ালে তা’হলে কোন মানুষটা আসল?
অসম্ভব দুষ্টুবুদ্ধি সব সময় মাথার মধ্যে কিলবিল করত। তার জন্য এত কিছু ঘটাতেন, এত রকম ভাবে, তার বেশির ভাগই খবরের কাগজে বলতে পারব না। তবে রসিক কেমন ছিলেন, হালকা একটা নমুনা দিই।
ট্রেনে করে শান্তিনিকেতনে চলেছেন দেবুদা। আবৃত্তির অনুষ্ঠান। সঙ্গে এক আচার্যমশাই। তিনি বক্তৃতা দেবেন। আপাতগম্ভীর দেবুদা জলের বোতলে মদ নিয়ে, ঠিক জল খাওয়ার ভঙ্গিতে চুমুক দিতে দিতে চলেছেন। হঠাৎ সেই আচার্যর তেষ্টা পাওয়াতে সেই জল নিয়ে পান করতে যাবেন, দেবুদা তো প্রমাদ গুনলেন! চিৎকার করে উঠলেন, “আরে কী করছেন জলে ওষুধ মেশানো আছে। মারা পড়বেন যে!” থতমত খেয়ে আচার্য ক্ষান্ত দিলেন। দেবুদাও সে-যাত্রায় লোকলজ্জা থেকে বাঁচলেন।
এমন সব কাণ্ড করতেন বলেই দেবুদার সঙ্গে কোথাও যেন একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেত অনেকেরই। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই।
আসলে দেবুদাও বন্ধুত্বটা পাতাতে জানতেন। নানা ধরনের জীবন দেখলে যা হয়, স্বভাব থেকে তো অনেক জটিলতা খসে পড়ে, তখন মেলামেশাটাও অনেক সহজ হয়ে যায়। দেবুদার ক্ষেত্রেও তাই হয়ে ছিল। শুধু কমবয়েসিরা নন, লীলা মজুমদার থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র, সকলের পছন্দের মানুষ ছিলেন দেবুদা।
ছোটবেলায় থাকতেন শান্তিপুরে। তারপর ওঁরা চলে আসেন কলকাতায়।
ছোটবেলার জীবন দেবুদার যে খুব আয়াসে কেটেছিল, এমন নয়। বরং উল্টোটা।
সংসারের অর্থকষ্ট মেটাতে তিনি বন্ধ করেছিলেন পড়াশুনা। তাতে বিষম চটে গিয়েছিলেন দেবুদার বাবা। তিনি তখনই দেবুদার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন।
অল্প বয়েসেই কলকাতায় ঘরছাড়া হলেন দেবুদা। উঠলেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ওই মেসে তখন দেবুদার সঙ্গে থাকতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
রোজগারের জন্য তখন যা পেতেন তাই করতেন। চায়ের দোকানের কাজ। রেল কোম্পানির হয়ে সার্ভে। অর্থকষ্ট এতটাই ভয়াবহ ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও সৃজনী মনটা কিন্তু উধাও হয়নি ওঁর। হয়তো সারাদিন চায়ের দোকানে কাজ করলেন, রাতে ফিরে কলম-খাতা নিয়ে বসে গেলেন কবিতা লিখতেন।
এমনই একটা সময় সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত এবং সুবীর হাজরার (সত্যজিৎ রায়ের সহকারী) একটি ছবিতেও প্রোডাকশনের কাজ করেছিলেন দেবুদা। যদিও সে ছবি মুক্তি পায়নি।
সুধীন দাশগুপ্তই দেবুদাকে আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির কথা বলেন। পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছিলেন দেবুদা। সে ১৯৬০ সালের কথা। তারপর একটানা বত্রিশ বছর আকাশবাণীর সংসারে দেবুদা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন।
খবর পড়ায় একটা আলাদা ঘরাণা তৈরি করেছিলেন দেবুদা।
ধরা যাক একটা মৃত্যুর সংবাদ। সেটা পড়তে গিয়ে পরিষ্কার দেখতাম দেবুদার চোখে জল। গলাটাও বেশ ধরে আসছে। গলার পর্দাটা নামিয়ে একটা ব্যক্তিগত টাচ দিতেন উনি।
এ দিকে আমরা তো জানি সংবাদ যিনি পড়বেন তার পড়ায় কোনও আবেগ থাকলে চলবে না। কিন্তু দেবুদা সেটা মানতেন না। কত সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু দেখেছি কট্টর, জেদি, একরোখা মন নিয়ে উনি কেমন সকলকে জয় করেছেন।
কমবয়েসিরা তো রীতিমতো ‘ফ্যান’ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর। সহকর্মীদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, সমসাময়িক অনেকে তাঁকে নকল করত। কেউ তো গুরু মানত। তার গভীরতা যে কতটা ছিল একটু বলি।
দেবুদার সঙ্গেই সংবাদ পড়তেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সংবাদ পড়া ছাড়া আর সব কাজ তিনি চমৎকার করতে পারতেন। একবার খবর পড়তে গিয়ে তিনি বলে ফেললেন, “আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।”
ডিউটি অফিসার তো মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছেন। কিন্তু এই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারবেন, কী মারাত্মক একটা প্রভাব ছিল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
দেবুদার রেডিয়ো-জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্প্রচারটি।
১৯৬৬ সাল থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা চলে আসতেন কলকাতায়।
তাঁরা সোজা গিয়ে দেখা করতেন আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগে। শোনাতেন নিজেদের অসহায় জীবনের নানা কাহিনি।
আকাশবাণীর ‘সংবাদ পরিক্রমা’-র লেখক প্রণবেশ সেন আর সংবাদ পাঠক দেবদুলালকে সেই সব কাহিনি অসম্ভব বিচলিত করেছিল।
প্রতিদিন রাত দশটা থেকে দশটা পাঁচ মিনিট দেবুদা পড়তে লাগলেন যুদ্ধের কথা। যন্ত্রণার ইতিহাস। যাঁরা রেডিয়োর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাঁরা তো বটেই শ্রোতারাও জানেন কী প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয়েছিল সে অনুষ্ঠান।
মনে হত এই তো দেখতে পাচ্ছি যুদ্ধের প্রান্তর। যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস। কলকাতা আর বাংলাদেশ কোথাও যেন একসুতোয় সুতোয় গাঁথা রইল। ১৯৭২ সালে দেবুদা এই সংবাদ পাঠের জন্যই পদ্মশ্রী উপাধি পান।
কাজের জন্য যে কী নিষ্ঠা ওঁর মধ্যে দেখেছি, বলার নয়। একটা নমুনা দিই।
বানান নিয়ে ভয়ঙ্কর খুঁতখুঁতে ছিলেন দেবুদা। মনে হতেই পারে রেডিয়োয় বানানের কী প্রয়োজন? দেবুদার এই ঘটনাটা বললে ব্যাপারটা খানিকটা ধরতে পারবেন।
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রচুর বিদেশি ডেলিগেট এসেছেন শহরে। তাঁদের বাইটও নেওয়া হয়েছে।
হঠাৎ দেখি আকাশবাণীর নিউজ রুমে দেবুদা হন্যে হয়ে সব হাই কমিশনের ফোন নম্বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। খেয়াল করলাম উনি রেকর্ডিং-এর আগে সমস্ত হাই কমিশনে ফোন করে যাচ্ছেন। আর গম্ভীর মুখে কী সব আলোচনা করছেন। একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।
খবর পড়ার সময় শুনলাম নির্ভুল বিদেশি উচ্চারণে দেবুদা কেমন অনায়াসে বিদেশি নামগুলো বলে গেলেন। এই ছিলেন দেবদুলাল!
দেবুদার সঙ্গে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমার। কিন্তু আজ বলি, তার শুরুটা কিন্তু মোটেই এমন ছিল না। মিষ্টি তো নয়ই, বরং বেশ তেতো।
সাতাশ বছরের একটি ছেলে! আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পদের জন্য পরীক্ষা দিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে প্রোডিউসারের গুরুভার বহন করবে? এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি আকাশবাণীর সেকালের নামজাদা ব্যক্তিত্ব দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
বলা যেতে পারে আলতো বিরোধিতার মধ্যে দিয়েই এই অসাধারণ প্রতিভার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
আজীবন বন্ধুবৎসল এই মানুষটি কিন্তু নিজের জন্য আমার আকাশবাণীতে প্রবেশের বিরোধিতা করেননি। যোগ্য বন্ধু শংকর সেনের মতো মানুষ থাকতেও এত কম বয়সে আমার এই পদে বসে যাওয়াকে তিনি মানতে পারেননি। যদিও সামনে কখনই আমায় কিছু বলেননি।
যাই হোক, আকাশবাণীর কাজে যোগ দিয়ে আমি আমার কাজ শুরু করলাম। তখন একের পর এক সব নতুন প্রোডাকশন হচ্ছে, সেই কারণে অ্যাওয়ার্ডও জুটেছিল বেশ কয়েকটা।
বেশ কিছু দিন কেটে গেছে, বাচিক শিল্পী হিসেবে আমাদের অনুষ্ঠানে দেখাও হচ্ছে। মঞ্চে উনি উঠছেন, অমি নামছি। হাসি বিনিময়ের পরে দু’চারটে কথাও হচ্ছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
এমন একটা সময় একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রে দেবুদা লিখলেন, আমি এক সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চেয়ারে এক তরুণ প্রযোজকের বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী কালে তাঁর উদ্যম, আর কাজ দেখে আমার মনে হয়েছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণর ওই চেয়ারের প্রয়োজন ছিল এক তরুণ প্রযোজকের। আমি আমার ভুল স্বীকার করে নিচ্ছি।
সক্কাল সক্কাল একেবারে চমকে গেলাম! উনি তো মুখেই বলতে পারতেন এ কথা, কিন্তু প্রকাশ্যে কাগজে লিখে জানালেন।
সেদিন প্রকৃত এক শিল্পীর, অমন সংবেদনশীল মন আমায় ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
অগ্রজের কাছে এত বড় সম্মান আর কোনও দিন পেয়েছি কি!