শাদি মানেই বরবাদি!
বিয়ে করেছ কী মরেছ।
সিলভার স্ক্রিনে নায়িকার কেরিয়ার নিয়ে এমন আপ্তবাক্যকে তিনি কেমন এক ফুঁয়ে উড়িয়ে বলিউডে বছরের পর বছর আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন!
রাখি গুলজার।
কেরিয়ারের পয়লা নম্বর ছবি করার আগেই বিবাহিত। কিন্তু শুধু প্রতিভা আর সৌন্দর্যের জোরে তিনি কব্জা করেছিলেন তাঁর যশ। পর্দায় কখনও তিনি অনন্ত উদ্যমের উৎস, তো কখনও বয়স্কা নারী। মায়ের ভূমিকায়। যে ভাবে শিখর জয়ের এক একটা ধাপ পেরিয়েছেন রাখি, বলতে গেলে বলিউডের ইতিহাসে তা এক একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
১৯৪৭। ১৫ অগস্ট। ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছে তারই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে জন্ম রাখির। এই পশ্চিমবাংলারই রানাঘাটে।
সে কথা বলতে গেলে আজও সবজে-খয়েরি চোখের নায়িকার মনে পড়ে, জন্মদিন পালন বলতে তাঁর জীবনে কিছুই তো ছিল না। “এলাকার মেয়েদের একটি স্কুলে পড়তাম। স্কুলে ওই দিন আমাদের কবিতা পড়তে দেওয়া হত। আর প্রত্যেককে শাড়ি পরতেই হত। এই ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগত আমার। কিন্তু জন্মদিন পালন-টালন বলে কিছু কোনও দিনই ছিল না,” বলেন রাখি।
পূর্ব বাংলা যখন বাংলাদেশ হয়ে গেল, তখন তাঁদের সর্বস্ব খোয়া যায়। কিশোরী বয়েসে তাঁর বিয়ে হয় লেখক অজয় বিশ্বাসের সঙ্গে। সে-বিয়ে বেশিদিন টেকেনি। কিন্তু তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই।
ফিল্মি দুনিয়ায় ঢোকার কথা জানতে চাইলে রাখি বরাবরই একটা কথা বলে এসেছেন, “পরিস্থিতির চাপে পড়ে আমার পর্দার জীবন শুরু। ব্যাপারটা কখনই এমন নয়, যে আমার সিনেমা নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল। আমার সিনেমায় আসার একটাই কারণ, রোজগার। আমরা যে খুব গরিব ছিলাম।”
তাঁদের পরিবার ছিল ব্রাহ্মণ। যেখানে সিনেমার জগৎকে ভাল চোখে দেখার কোনও প্রশ্নই ছিল না। ঘুংরু পরা, নাচ এ সব ছিল সে-পরিবারে রীতিমতো নিষিদ্ধ। তবু বাধ্য হয়েই তাঁকে তেমন কাজই করতে হয়েছিল।
ছবির জগতে তাঁর প্রথম আসা ১৯৬৭-তে। সিনেমার নাম ছিল ‘বধূবরণ’। এই সিনেমার পরেই তাঁর হঠাৎ ডাক আসে মুম্বইয়ের ‘রাজশ্রী প্রোডাকশনস্’ থেকে। সেখানে প্রথম ছবি ‘জীবনমৃত্যু’। কিন্তু সে-ছবি দেখে তাজ্জব হয়ে যায় ইন্ডস্ট্রির লোকজন। নায়ক ধর্মেন্দ্র। তাঁর তখনই বেশ নামডাক। তবু রাখিকে আলাদা করে চিনিয়ে দিয়েছিল তাঁর অভিনয়। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এর মাঝে রাখি বিয়েও করলেন। দ্বিতীয় বার। পরিচালক-লেখক-সঙ্গীতকার-কবি গুলজারকে। পাশাপাশি একের পর এক ছবিতে সিনেমাপ্রেমীদের পুরো স্তব্ধ করে দিচ্ছিলেন একেবারে গোড়ার পর্ব থেকেই। দাগ, শর্মিলী, কভি কভি, ব্ল্যাকমেল, দুসরা আদমি, বসেরা, পরমা...। এক-একটি ছবিতে রাখি তাঁর জাত চেনাতে থাকেন।
ছবিতে রাখি কখনও অনন্ত উদ্যমের উৎস (কভি কভি), তো কখনও একজন বয়স্কা নারী, যিনি অল্পবয়েসি ছেলের প্রেমে হাবুডুবু (দুসরা আদমি)। প্রত্যেকটা ফিল্মে স্টোরি লাইনও ছিল অসম্ভব জোরদার। ধীরে ধীরে রাখি হয়ে উঠলেন বলিউডের একজন নাটকীয় শক্তিশালী অভিনেত্রী। এমনকী কয়েকটি ক্ষেত্রে তার পারফরম্যান্স তুলনা করা হতে লাগল তাঁরই ‘আইডল’ মীনাকুমারীর সঙ্গে।
রাখির সৌন্দর্য নিয়ে বহু বার বহু ভাবে অনেক কথা লেখা হয়েছে। তা সত্ত্বেও একটা কথা বারে বারেই ওঠে। পরিচালক বা অভিনেতারা প্রায়ই বলেন, ওঁর চোখগুলো এমন যে একবার তাকালেই কেমন হারিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তাঁর সৌন্দর্যকে ঠিক ঠাক কাজে লাগাতে চাইলে রাখির মেজাজ, মন আগে জিতে নিতে হয়।
“আমি শুধু একটা ব্যাপারই জানি, তা হল পারফরম্যান্স। যে জন্য আমার একজন ভাল পরিচালক চাই, ব্যস। আমার বেশির ভাগ পরিচালকের সঙ্গেই আমি চরিত্রের নানারকম শেড্স, তার স্পন্দন নিয়ে শেয়ার করেছি। তাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস নিয়ে কাজেও লাগিয়েছি। সেটা হয়তো বা এতটাই স্বাভাবিক ভাবে করেছি, যে অনেক সময়ই আমার হিরোরা ভেবে বসেছেন, আমি বোধহয় তাঁদের প্রেমে পড়ে গেছি। ব্যাপারটা কিন্তু একেবারেই তেমন নয়,” একটি সাক্ষাৎকারে এটাই ছিল রাখির সরল স্বীকারোক্তি।
তিনি প্রায়ই বলেন, তিনি শরীর দেখিয়ে বেড়াতেই পারতেন। যে-শরীর আজকের যে কোনও অভিনেত্রীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। কিন্তু এর মধ্যে কোনও গর্বের ব্যাপার তিনি খুঁজে পান না। তাই কোনও দিনই এ পথে তিনি হাঁটতে চাননি। তা বলে সাফল্য তো তার পিছু ছাড়েনি।
কেরিয়ারের এই পর্বে এসে কেমন আছেন রাখি?
এই মুহূর্তে তিনি প্রায় একাকী জীবন কাটাচ্ছেন পানভেল-এ। গুলজারের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও তাঁদের এখনও ডিভোর্স হয়নি। তাঁর এই একাকী জীবনে এখন শুধুই জুড়ে আছে তাঁর পরিবার, তাঁর মেয়ে মেঘনা। মেঘনার বিয়ে হয়ে গেছে। একটি মেয়েও আছে। রাখির জগৎ এখন ওদের নিয়ে। মাঝে মধ্যে ভাল লাগলে ছবি করছেন, তবে তা যত না হিন্দি, তার চেয়ে বাংলাই বেশি।
রাখি চিরকালই পরিপূর্ণ একজন অভিনেত্রী। তার ওপর ডাকসাইটে সুন্দরী। দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স। এ সব কিছু বলার পরেও রাখিকে নিয়ে একটা কথা না বললে যেন কিছুই বলা হয় না। তা হল রাখির মেজাজ। লোকজন বলে অল্পতেই মেজাজ হারাতে ইন্ডাস্ট্রিতে রাখির জুড়ি নেই। অসম্ভব মুডি। সচরাচর বিশেষ কারও সঙ্গে কথা বলেন না, আবার মেজাজের কথা ভেবে কেউ তাঁকে ঘাঁটাতেও চান না।
শর্মিলা ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়েও তো কত কথা। একে অপরকে নাকি কিছুতেই দেখতে পারেন না। যদিও ‘দাগ’-এ তাঁরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু তাঁর এই মেজাজের জন্যই নাকি দুজনের সম্পর্ক কোনও দিনই খুব ভাল নয়। বহু বছর বাদে তাঁদের আবার একসঙ্গে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল ‘শুভ মহরৎ’-এ। আগাথা ক্রিস্টির “দ্য মিরর ক্র্যাকড’ অবলম্বনে যে কাহিনিতে মিসেস মার্পল-এর দেশি সংস্করণে অভিনয় করেছিলেন রাখি।
পুরনো সম্পর্কের জেরে এ শহরে তখন সবাই বেশ নড়েচড়ে উঠেছিল, ‘দুই বাঘিনির দুরন্ত মোলাকাত’-এর খবরে। সে সময়ের কথা মনে করে রাখি অবশ্য বলেন, “কলকাতায় প্রেসের লোকজন ভেবে বসেছিলেন, আমি আর রিঙ্কু (শর্মিলা ঠাকুর) বুঝি, চোখ দিয়েই দুজনে দুজনকে ছিঁড়ে খাব। আমার মনে হয়, পরে ওঁরা বেশ হতাশ হয়েছিলেন। আসলে তেমন কিছুই তো ঘটল না। বরং প্রায় তিন দশক বাদে আমরা দুজনে দুজনের সঙ্গে দেখা করলাম, কাজ করলাম, অথচ মনে হচ্ছিল এই তো তিন সপ্তাহ আগেই যেন আমরা একসঙ্গে সময় কাটিয়েছি।”
তবে ইন্ডস্ট্রির অনেকেই বলেন, কোনও পুরুষ-পরিচালকই কিন্তু নিজেকে আড়ালে রাখার, দূরত্বে রাখার গণ্ডি ডিঙিয়ে রাখির কাছাকাছি যেতে চান না। এ নিয়ে অবশ্য রাখির ব্যাখ্যাটা একটু অন্য রকম। তিনি বলেন, “আমার সব পরিচালকই আমার মেজাজের কথা জানে। আমি খারাপ ব্যাপারটা তো তা নয়, কিন্তু আমি জানি আমি একটু বেশিই খুঁতখুঁতে। কিন্তু সেটা আমার কাজের নিষ্ঠা থেকেই আসে। আমার এই ডেডিকেশনটা অনেকেই ধরতে পারেন না। আমি জানি, মেজাজ হারালে আমাকে দেখে অন্যরা কেঁপে ওঠে। এই সমস্যাটা ওঁদের। আমার নয়। তাঁরা যদি একজন শক্তমনের মহিলাকে গ্রহণ করতে না পারেন, আমি কী’বা করতে পারি!”
নিজেকে আড়ালে রাখেন। তাঁর স্বভাব ঘিরে অনেক রহস্য। তিনি চট করে তাঁর প্রাইভেসিকে বাইরে আনতে চান না, কিন্তু খুব সম্প্রতি রাখিকে অনেকেই প্রকাশ্যে ভেঙে পড়তে দেখেছিলেন, যখন তিনি সঞ্জয় দত্তর কারাবাস নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। শোনা যায়, সঞ্জয়কে তিনি নিজের ছেলের মতো ভালবাসেন। তিনি বলেনও, “আমি সঞ্জয়কে নিজের ছেলে বলেই মনে করি। ওর পরিবারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা, আমি যখন ‘রেশমা অউর শেরা’ করেছি, তখন থেকে। সুনীল দত্তর সঙ্গে সেটাই ছিল আমার প্রথম ফিল্ম। সঞ্জয়কে আমি নিজের চোখের সামনে বড় হতে দেখেছি।” গত বছরই একটি সাক্ষাৎকারে তিনি পরিষ্কার বলেছেন, তিনি চান, সঞ্জয় তার কারাবাসের জীবন শেষ করে নতুন একটা জীবন শুরু করুক।
একজন অভিনেত্রী, যিনি সিনেমাজগতে প্রবেশ করেছিলেন, যখন তিনি বিবাহিত, অসম্ভব মেজাজি, তার সঙ্গে আবার নির্জনতাপ্রেমী, একাকী, দু’বারের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া একজন শিল্পী। তাঁর কেরিয়ারের দিকে তাকালে এত কিছুর পরেও কিন্তু মনে হয়, কী সাবলীল ভাবেই না কত দূর এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। যদিও ইদানীং তাঁকে বড় একটা দেখাই যায় না। এমনকী শেষ দেখা গিয়েছে এমন একটি ছবিতে যেখানে তিনি ছিলেন মায়ের চরিত্রে। কিন্তু তাতেও তাঁর অভিনয়ের সাবলীলতা দেখে কেবলই মনে হয়, কোথায় যেন অনন্তকালের জন্য একটা প্রাণের স্পন্দন রাখি যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিছুতেই যেন তা হারাবার নয়, সে রাখি যে চরিত্রেই থাকুন না কেন। যখনই তিনি পর্দায় আসুন না কেন!