মৃত চিঠির ডাক

ব্যস্ত ডালহৌসি পাড়ায়। খবর দিচ্ছেন অশোক সেনগুপ্তফি বছর দু’বার করে ডাক-মারফত উপহার পাঠাতেন বিধাননগরের অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। রেজিষ্ট্রি খাম বা পার্সেল পাঠানো হত বিরাটির এক দিদিমণির উদ্দেশে। প্রতিবারই সেটি ডাকপিওনকে ফিরিয়ে দিতেন দিদিমণি। সেই পার্সেল এসে জমত মৃত চিঠির মর্গে। ডাক-পরিভাষায় যাকে বলে ডেড লেটার অফিস, অর্থাৎ ডিএলও। তবু আবার যথারীতি বিরাটিতে যেত অশোকবাবুর নতুন কোনও উপহার। ওই ঠিকানা ঘুরে সেটি যেত ডিএলও-তে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০৮
Share:

সেই লাল বাড়ি। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ফি বছর দু’বার করে ডাক-মারফত উপহার পাঠাতেন বিধাননগরের অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

রেজিষ্ট্রি খাম বা পার্সেল পাঠানো হত বিরাটির এক দিদিমণির উদ্দেশে। প্রতিবারই সেটি ডাকপিওনকে ফিরিয়ে দিতেন দিদিমণি।

সেই পার্সেল এসে জমত মৃত চিঠির মর্গে। ডাক-পরিভাষায় যাকে বলে ডেড লেটার অফিস, অর্থাৎ ডিএলও। তবু আবার যথারীতি বিরাটিতে যেত অশোকবাবুর নতুন কোনও উপহার। ওই ঠিকানা ঘুরে সেটি যেত ডিএলও-তে।

Advertisement

বহু বছর চলেছে এ রকম। হালে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন, তা জানা নেই ডিএলও কর্মীদের। কী থাকত অশোকবাবুর পাঠানো প্যাকেটে? শুভেচ্ছাপত্র, গোলাপ, শাড়ি, সুগন্ধি এক একবার এক এক রকমের।

প্রেম থেকে অপরাধ বহু ঘটনার সাক্ষী কলকাতায় ডিএলও-র এই লাল বাড়ি।

বাড়ি তো নয়, প্রাসাদ। তবে মহাকরণের ঢিল ছোড়া দূরত্বে, ব্রিটিশদের এই অনুপম হেরিটেজে ঐতিহাসিক বিভাগটা আজ যেন ধুঁকছে অস্তিত্বের সঙ্কটে।

বছর পনেরো আগেও গমগম করত ডেড লেটার অফিস। দেড়শ থেকে কর্মী সংখ্যা নেমেছে ছাব্বিশ-এ। নিয়োগ হয়নি বহু দিন। এ ভাবে চললে বছর পাঁচ বাদে কর্মী থাকবেন মাত্র পাঁচ।

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ডিএলও কলকাতায় তৈরি হয় ১৮৩৫-এ, জর্জ লর্ড অকল্যান্ডের উদ্যোগে। যার একটা কাজ: কখনও ভুল ঠিকানা শুধরে বা খাম-পার্সেল খুলে প্রাপকের খোঁজ করে সঠিক ঠিকানায় পাঠানো।

স্পিড পোস্ট, রেজিষ্টার্ড লেটার, রেজিস্টার্ড পার্সেলএ রকম ছ’টি ভাগে থাকে ডিএলও-র বেওয়ারিশ জিনিসপত্র। প্রাপকের খোঁজ না পেয়ে অথবা প্রাপক-প্রেরক উভয়েই খাম বা মোড়ক না নিতে চাইলে এক বছর বাদে সেটি নষ্ট করে ফেলা হয়।

কত অদ্ভুত গল্প যে জড়িয়ে আছে লালবাড়ির এই বিভাগের সঙ্গে।

বছর তিন আগের কথা। উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে মধ্য কলকাতার একটি ঠিকানায় রেজিষ্টার্ড ডাকে এল একটি ভারী বাক্স। উদ্দিষ্ট ব্যক্তি নিতে রাজি নন। ফেরত নিতে রাজি নন প্রেরকও। ডিএলও-র সুপার সুকুমার মণ্ডল জানান, “প্যাকেট খুলে দেখলাম বেশ মোটা হাতির দাঁতের চারটি খণ্ড। ওজন সাড়ে চার কিলো। আমরা শেষমেশ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেটা তুলে দিই বনবিভাগের গোয়েন্দাদের হাতে।”

ডিএলও-তে এসেছে ডাক-মারফত পাঠানো বেআইনি হরেক রকম মাদক, এমনকী আগ্নেয়াস্ত্রও। কখনও টাকা অথবা কেক-এর সঙ্গে প্রেমপত্র। ডিএলও-রই এক পদস্থ অফিসার মৃণাল বসু বললেন, “প্রাপক প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে কোনও কারণে চিঠিপত্র বা পার্সেল অবাঞ্ছিত মনে হলে শেষমেশ তা জমা হয় এখানে। তবে এখন মোবাইলের যুগে অবশ্য এ ধরনের চিঠিপত্র কমে গিয়েছে। আর ডাক-মারফত বেআইনি জিনিসের ব্যবসা যাঁরা করেন, তাঁরাও ধরা পড়ার ভয়ে প্যাকেট নিতে চান না। ফলে তাও এসে জমা পড়ে দপ্তরে।”

এভাবেই ডাক মারফত বিদেশ থেকে মধ্য কলকাতায় আসা বেওয়ারিশ কিছু স্বর্ণমুদ্রা বেশ কিছুকাল জমা ছিল ডিএলও-তে। নিলাম ডেকে বছর দেড়েক আগে তা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

এখনও ডিএলও-র হেফাজতে রয়ে গিয়েছে দুষ্প্রাপ্য বেশ কিছু মুদ্রা। এ সবই বিভিন্ন সময়ে খাম খুলে উদ্ধার করা। আইন অনুযায়ী, খামে টাকা-পয়সা পাঠানো নিষিদ্ধ। সন্দেহজনক খাম বিভিন্ন ডাকঘর পাঠিয়ে দেয় ডিএলও-তে। আর, খাম খুলে জিনিস পরীক্ষা করা বা সেটিকে প্রয়োজনে গন্তব্যে পাঠানোর আইনি অধিকার বা এক্তিয়ার একমাত্র ডিএলও-রই।

সুকুমারবাবুর দাবি, “বছরে গড়ে এখনও প্রায় ৭০ হাজার চিঠি বা খাম আসে এই বিভাগে। তার অন্তত ৯২ শতাংশ সঠিক ঘর খুঁজে পায়।”

লালদিঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রাস্তার ব্যস্ত সংযোগস্থলে পেল্লাই বাড়ি। লিফ্ট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ৪২টি ধাপ পেরিয়ে দো’তলা, আরও ৪৮টি ধাপে তৃতীয় তল। নিয়মিত কর্মীদের উঠতে কষ্ট হয় বলে চিফ পোষ্টমাষ্টার জেনারেলের কাছে আর্জি গিয়েছিল। সিঁড়ির ধার বরাবর লাগানো হয়েছে হাতল।

তিন তলার ছাদে আছে প্রায় ১৪ ফুট উঁচু বাঁধানো উনুন (ইনসেনিটর)। আগে মৃত চিঠিগুলো সেখানে পোড়ানো হত। এখন সেটিও মৃত। ব্যবহার হয় না। রোদে, জলে নষ্ট হচ্ছে।

কর্মীরা বলছেন, পরিবেশবিধির কথা মাথায় রেখে ওই চুল্লি আগের চেয়ে কম ব্যবহার করা হয়। ঘটনা হল, ছাদে উঠে আগুন জ্বালিয়ে পোড়ানোর চেয়ে চেয়ারে বসে ছিঁড়ে বা কেটে মৃত চিঠি বর্জ্যের বাক্সে ফেলে দেওয়ার কাজটা অনেক সহজ। সুকুমারবাবু অবশ্য বললেন, “চুল্লিটা সারাইয়ের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আর্জি জানিয়েছি।”

টেলিপ্রিন্টার উঠে গিয়েছে। সহায়ক জিনিসগুলোও আজ ইতিহাস। ডাক-ব্যবস্থাও হয়ে উঠেছে সেকেলে। তাহলে কি ডিএলও-ও গুনছে শেষের সেদিন?

“যদি তা হয়, অত্যন্ত অনুচিত হবে”মন্তব্য মৃণাল বসুর। তাঁর মনে ঘুরপাক খায় অন্য রাস্তা, “এখন ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং-এর রমরমা। নিখোঁজ চিঠিগুলোর খবর যদি আমরা সেখানে তুলে দিই, প্রাপকরা খোঁজ পেতে পারেন।” তাঁর এই রাস্তা ধরেই কি মৃত ঐতিহাসিক এই ডাক অন্য কোনও মোড়ের সন্ধান পেয়ে ফের চনমনে হয়ে উঠবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন