জলে নেমে কেউ কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে?
গুজরাতের বড়ানগরের দরিদ্র এক বালক কিন্তু সত্যি সত্যিই নদীতে কুমিরের সঙ্গে লড়েছিলেন।
সেদিনের সেই বালক আজকের নরেন্দ্র মোদী। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী।
বড়ানগর গ্রাম দেখাতে দেখাতে এক গুজরাতি ধাবায় বসে ছোট্ট নরেন্দ্রর সাহসের গল্প বলছিলেন ওঁর বড় দাদা সোম।
শর্মিষ্ঠা সরোবর। লোকে বলত ওই সরোবরে কুমির আছে। এ দিকে সেখানেই নিয়মিত এপার-ওপার করত ছোট্ট নরেন্দ্র।
একদিন দু’হাতে করে বয়ে আনল একটা ছোট কুমির ছানা। মা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ফেলে দে ওটাকে।’ নরেন্দ্র মোদী পরে নিজেই বলেছিলেন, ‘তখন বুঝতেও পারিনি মগর মাছ মানে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার।’
সরোবরের মাঝখানে ছিল এক কৃষ্ণ মন্দির। সেবার প্রবল বৃষ্টিতে গোটা মন্দিরটা জলের নীচে চলে যায়। তার চুড়োতে যে পতাকাটা উড়ছিল তা’ও ভেসে যায় জলে। এ দিকে ওই পতাকা এক বছর অন্তর বদলাতে হত বিশেষ একটি দিনে। বন্যা বলে তা’ও ভেসে যাবে? তাই বালক নরেন্দ্র ওই প্রবল বর্ষার মধ্যেই সরোবরে সাঁতার কেটে গিয়ে মন্দিরের চুড়োয় লাগিয়ে এসেছিল নতুন গৈরিক পতাকা। আর তখনই কুমিরের পাল্লায় পড়ে সে।
বাবা ছিলেন বাসস্ট্যান্ডের চা-ওয়ালা। অমদাবাদের বাস-আড্ডায় তাঁর চায়ের দোকান। গুজরাত পরিবহণ দফতরের অফিসও ছিল সেখানে। বাবার বানানো চা কেটলি করে কর্মীদের টেবিলে টেবিলে নিয়ে যাওয়া ছিল নরেন্দ্রর কাজ।
গাঁধীনগরের মুখ্যমন্ত্রীর নিবাসে এ দিনই সকালে ছোটবেলার সে কাহিনি শোনাচ্ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বলছিলেন, “আমি নিজে আম আদমি পরিবার থেকেই এসেছি। আজও মনে মনে তা-ই আছি।”
এখনও ঘুম থেকে ওঠেন খুব ভোরে। সাদা ফতুয়া গায়ে আজও সাতসকালে নিমের ডাল দিয়ে দাঁতন করেন। দৃশ্যটি কষ্টকল্পিত হলেও মোদী বলছিলেন, “সারাজীবন ধরে তো তাই-ই করেছি। তবে নিম এবং টুথ পেস্ট দুটোতেই আছি।”
যে বাড়িটিতে ওঁরা থাকতেন, সেটি ছিল অনেকটা রেলগাড়ির কামরার মতো। পরপর ছোট ছোট তিনটি ঘর। ঘুপচি। আলো বাতাস কম।
এমনিতে বড়ানগর গ্রামও ছিল খুব ছোট্ট। বিদ্যুৎ ছিল না। নরেন্দ্র বলছিলেন, “প্রায় সারাদিন বাড়িতে কেরোসিনের লম্ফ জ্বালাতে হত।” এক দিকে কেরোসিনের গ্যাস, অন্য দিকে গোবরের গন্ধ। ভ্যাপসা গুমোট চারপাশ।
মোদী বললেন, “ছোটবেলার ওই দিনগুলো অমন কাটিয়েছি বলেই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমেই আমার মনে হয়েছিল গুজরাতে এমন কোনও গ্রাম থাকা উচিত নয়, যেখানে বিদ্যুৎ নেই। তাই চালু করেছিলাম জ্যোতিগ্রাম যোজনা। এই প্রকল্প গুজরাতে খুবই সফল হয়।”
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা চলছে। তার মাঝেই কিন্তু বেশ চোখে পড়ছে চারপাশে ঘুর ঘুর করে চলেছে ওঁর দুই ছায়াসঙ্গী ওপি আর উমেশ। মোদীর চোখের ওঠাপড়ায় ওঁরা নাকি বুঝে যান, তাঁর কী চাই। মুখ্যমন্ত্রীর গায়ে ইট রঙের একটা হাফ কুর্তা। পাট করা চাদর কাঁধে ফেলা।
অভাব-টভাব যাই-ই থাকুক, ছোট থেকেই জামাকাপড়, সাজগোজের সব ব্যাপারে নাকি টিপটপ উনি। এক সময় অন্ধ ভক্ত ছিলেন রাজেশ খন্নার। তখন রাজেশের মতো উঁচু কলার দেওয়া ‘গুরু পাঞ্জাবি’ও খুব পরতেন। এর পর যে কুর্তা পরা ধরলেন, তা তো গোটা গুজরাতে আজ ‘মোদী কুর্তা’ নামে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। তারও কিন্তু কলার উঁচু। অমদাবাদ-গাঁধীনগরের যে কোনও শো-রুমে ‘মোদী-কুর্তা’-র চাহিদা শুনলে তাজ্জব লাগে।
অমদাবাদের বিখ্যাত বহুতল মল বা অভিজাত বস্ত্র বিপণিতে ‘মোদী-কুর্তা’ এক্কেবারে হাল ফ্যাশনের ব্যাপার। পোশাকআশাকের বাইরে মোদীর পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় ধাপে আছে ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র।
মোদী বলছিলেন, “লালকৃষ্ণ আডবাণী বা প্রমোদ মহাজনকে দেখেছি, সবাই নতুন প্রযুক্তি খুব পছন্দ করতেন। নতুন মোবাইল, নতুন আই প্যাড। আমি বোধহয় দলে প্রথম, যে কি না ডিজিটাল ডায়েরি ব্যবহার করতে শুরু করি।”
পোশাকআশাক, ইলেকট্রনিক গ্যাজেটস-এ যেমন শখ, তেমন অসম্ভব প্যাশন ওঁর দাড়ি। খুব যত্ন করে দাড়ি ‘ট্রিম’ করান।
চুল কাটতে বাড়িতে এক পুরনো নাপিত আসেন। কিছু দিন আগে কয়েক মাস কাটেননি। চুল বড় হয়ে গিয়েছিল। তাতে হঠাৎ শোনা গেল, কোনও এক জ্যোতিষী নাকি তাঁকে চুল কাটতে নিষেধ করেছেন। জানা ছিল সেই কথা।
প্রশ্ন করতেই বললেন, “আরে, সময় পাচ্ছিলাম না। ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলাম। কোথা থেকে যে রটে গেল জ্যোতিষীর গল্পটা!”
কথাবার্তার মাঝেই ব্রেকফাস্ট এসে গেল। পোহা আর ধোকলা। আমিষ খান না। কিন্তু নিরামিষেই নাকি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা তাঁর আর এক শখ। শোনা গেল, ছোটবেলায় মা অসুস্থ হলে নিজের হাতে রান্না করতেন সকলের জন্য। এ জন্য আজও তিনি ভাল রাঁধুনি।
খুব পছন্দ দক্ষিণী খানা। রীতিমতো ভোজনরসিক হলেও পাশাপাশি রয়েছে বছরে দু’বার উপোস করা। এক বার নবরাত্রিতে। আরেক বার দশহরা-বিজয়াদশমীর আগে। ওই সময় ন’টা দিন শুধু জল খেয়ে থাকেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
বলছিলেন, “উপোসে আমার কোনও কষ্ট হয় না। প্রাচীন হিন্দু চিকিৎসা শাস্ত্রে এই উপোসের প্রথা কিন্তু চালু ছিল।” ২০১২ সালে যখন ভোট প্রচার চলছিল, ওই কঠিন সফরেও নাকি মোদী উপোস করেছিলেন।
ফিরে গেলেন পুরোনো কথায়। ওঁর মুখেই শোনা গেল, বহু দিন আগে মোদী পরিবার থাকতেন বানাসকাঁথা জেলার নবদোত্রা গ্রামে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মগনলাল রাণচোদাস নামের এক জন সে গ্রাম ছেড়ে বড়ানগরে এসে মুদির দোকান খোলেন। মগন লালের এক ছেলে। নাম মূলচাঁদ। মূলচাঁদের ছেলে দামোদরদাস। আর দামোদরদাসের তৃতীয় সন্তান হলেন আজকের অ্যাখ্যানের নায়ক।
মোদীর জন্ম ’৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ছয় ভাই বোনের সংসার। বড় দাদা সোম ছিলেন সরকারের জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। মেজদা অমৃত আইটিআই থেকে পাস করে আপাতত ব্যবসাদার।
মোদী বলছিলেন, “৪০ ফুট বাই ১২ ফুট লম্বা একটা বাড়িতে ছয় ভাই বোন কী ভাবে যে কাটিয়েছি!” মাটি আর ইট দিয়ে তৈরি তিনটে ঘর। একটা ছিল জল জমিয়ে রাখার জন্য। সেটাই স্নানঘর। আর অন্য দুটো ঘরের মধ্যে একটা শোবার ঘর। আর একটা ছিল বসার। বসার ঘরেই এক দিকে রান্না করা হত। আর এক দিকে ছিল দেবদেবীর সব ছবি আর মূর্তি।
মোদী বলছিলেন, “আমি এই শৈশবকে কখনওই ভুলতে চাই না। ঘরের মধ্যেই কাঠ আর ঘুঁটে জমিয়ে রাখা হত। গরম কালে মাটি এত তেতে পুড়ে থাকত, পা ফেলতে পারতাম না। মা বাঁশ দিয়ে মেঝে তৈরি করে, তার ওপর মাটি লেপে দিতেন, যাতে আমাদের কষ্ট না হয়। বাড়িতে কোনও টয়লেট ছিল না। যেতে হত দূরের একটা মাঠে।”
মোদীর ছোটবেলার বন্ধু জাসুদ খান পাঠান। আগের দিনই অমদাবাদের একটি ক্যাফেতে আলাপ হয়েছে ওঁর সঙ্গে। ক্লাস ওয়ান থেকে ইলেভেন একসঙ্গে পড়েছেন। ভগবতাচার্য নারায়ণাচার্য হাই স্কুলে। পাশাপাশি বসতেন, একই বেঞ্চিতে। জাসুদও বলছিলেন মোদী পরিবারের এক সময়ের দুর্দশার কথা। তার সঙ্গে বন্ধুদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় নরেন্দ্র দামোদরদাস-এর ‘এন ডি’ হয়ে ওঠার গল্প।
জাসুদ পাঠান থাকতেন মুসলিম মহল্লায়। সেখানেও যেতেন নরেন্দ্র। জাসুদ বললেন, “দীর্ঘ স্কুল জীবনে একদিনের জন্যও মনে পড়ে না এনডি-র সঙ্গে আমার হিন্দু-মুসলমান ব্যাপারস্যাপার নিয়ে কোনও ঝগড়া হয়েছে বলে।” অথচ স্কুলবেলার সেই ‘এনডি’-ই কি না হয়ে গেলেন গোধরা কাণ্ডের খলনায়ক। ঘোরতর হিন্দুত্ববাদী।
হিন্দুত্ববাদী, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে মোদী যে বিরাট কিছু পুজোআচ্চা নিয়ে থাকেন, তা নয়। বাড়িতে কোনও ঠাকুরঘরও নেই। এও এক অদ্ভুত ব্যাপার। লালকৃষ্ণ আডবাণী যেমন। এক সময়ে রামমন্দির আন্দোলনের প্রতীক। তাঁরও রোজ পুজো করার কোনও অভ্যাস নেই। এঁদের দুজনের চেয়ে বরং বেশি পুজো আর চণ্ডী পাঠ করেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
জাসুদের কাছে শোনা সেই প্রসঙ্গ তুলতেই নরেন্দ্র শুধু বললেন, “ধর্মীয় হওয়ার চেয়ে আমার কাছে ‘স্পিরিচুয়াল’ হওয়াটা বেশি জরুরি।”
তবে মোদী হলেন শিবভক্ত। শক্তির উপাসকও। নবরাত্রির সময় উপোস করেন, দুর্গার পুজো করেন। কৈলাস, মানস সরোবর বা অমরনাথ গিয়েছেন শিব দর্শনে।
বললেন, “সোমনাথও তাই আমাকে খুব টানে।” গুজরাতে শিবের মন্দির সোমনাথ আর নাগেশ্বর। এ দুটিই দ্বাদশ জ্যোতিলির্র্ঙ্গের মধ্যে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দুটি মন্দিরকে পর্যটকদের কাছে আরও আকর্ষক করতে নানা রকম উদ্যোগ নিয়েছেন মোদী।
প্রাতরাশ টেবিলে এই পর্যন্তই। দ্বিতীয় দফায় মোদীকে পাওয়া গেল শেষ সন্ধেয়। একেবারে ডিনার অবধি। মুখ্যমন্ত্রী নিবাসেই। তখনও ধরা দিলেন মোদী একেবারে অন্য চেহারায়।
সক্কালবেলা প্রতিদিন নিয়ম করে যোগাসন করেন নরেন্দ্র মোদী। একদিন বাদ পড়লেই অস্বস্তি লাগে। এমনকী শীতের সকালে ট্র্যাকসুট পরে বাড়ির সবুজ লনে প্রাণায়ামও।
ব্রহ্মাসনে তিনি যে আজও কতক্ষণ বসে থাকতে পারেন, ভাবাই যায় না। এমনকী শীর্ষাসনও করতে পারেন নিখুঁত। আগে তো প্রায় নিয়মিত করতেন। আজকাল চিকিৎসকদের পরামর্শে কমিয়েছেন।
ইদানীং খুব ভোরে নরেন্দ্র মোদীকে জাপানিদের সঙ্গে গল্ফের মাঠে খেলতে দেখলেও অবাক হওয়ার নেই। অবশ্যই তখন ‘মোদী -কুর্তা’য় নয়, হ্যাট-কোট-ট্রাউজার-এ পুরোদস্তর গল্ফারের পোশাকে।
গল্ফ কোনও দিনই খেলেননি, কিন্তু খেলাটার সঙ্গে জাপান আর গুজরাতে বিনিয়োগের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেয়ে গল্ফ বুঝছেন, শিখছেন। মোদীর নিজের ভাষায়, “জাপানিরা আমাদের রাজ্যে খুব বিনিয়োগ করছে। গোটা দেশের বিচারে গুজরাতে তাঁদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। এই জাপানিদের গল্ফ খেলাটা এক প্রবল নেশা। সকালে গল্ফ না খেললে ওঁরা কোনও কাজই করতে পারে না। এই সব মিলিয়ে আমি অনেক গল্ফ কোর্স বানিয়েছি, আজকাল নিজেও খেলাটা বোঝার চেষ্টা করছি।”
কত রকমের যে ‘শেড’ এই নরেন্দ্র মোদী নামক চরিত্রটিতে! কত রকমের যে নরেন্দ্র মোদী।
ওঁর পরিচিতরা বলেন, ছোট থেকেই নরেন্দ্রর জেদ ছিল অসম্ভব বেশি।
স্কুলে যে বিরাট মেধাবী ছাত্র ছিলেন এমন নয়। কিন্তু একবার সংস্কৃতের শিক্ষক বলেন, নদীর ওপর সংস্কৃত ভাষায় একটা রচনা লিখে যেন সবাই ক্লাস মনিটরকে দেখিয়ে নেয়। সবাই তাই করল। একমাত্র মোদী কিছুতেই রাজি নয়। কেন? ক্লাসের শিক্ষককে সে লেখা দিতে রাজি, কিন্তু মনিটরকে কিছুতেই না।
আরেক বার জেদ করে নুন, লঙ্কা আর তেল খাওয়া ছেড়ে দেয় ছোট্ট নরেন্দ্র। হাজার চেষ্টা করেও কেউ তাকে খাওয়াতে পারেননি। শেষমেশ যখন নিজে থেকে প্রতিজ্ঞা তুলল, তখনই সেটা সম্ভব হল।
জেদ ছিল, কিন্তু বাড়িতে ঝঞ্ঝাটঝামেলায় কিছুতেই যেতেন না মোদী। নরেন্দ্র বললেন, “রাগ হলে আমি চুপ করে যেতাম। যাকে বলে মৌনব্রত। অনেক সময় একা একা নদীর ধারে গিয়ে বসে থাকতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারও সঙ্গে কোনও কথা বলতাম না।”
খুব ছোটবেলায় একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলেন মোদী। মা হীরাবেন-কে বলেছিলেন, আর ফিরবেন না। সন্ন্যাসী হয়ে যেতে চান। “মা তো শুনেই খুব কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। কিন্তু আমি যখন একেবারে নাছোড়, বাধ্য হয়ে রাজি হন মা।”
গৃহত্যাগের দিন পুজো করে তাঁকে প্রসাদী লাড্ডু খাইয়ে দিলেন মা। ঘর ছাড়লেন মোদী। তারপর টানা দু’বছর কোনও খোঁজ নেই ছেলের।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে মোদী প্রথমে চলে যান রাজকোট। রামকৃষ্ণ আশ্রমে। সেখানে গিয়ে কিছু দিন ছিলেন। বেলুড় মঠের আজ যিনি প্রেসিডেন্ট মহারাজ, সেই আত্মস্থানন্দজি তখন গুজরাত আশ্রমের অধ্যক্ষ। ওই আশ্রমেই থাকতেন নরেন্দ্র। স্বামীজির বই পড়ার ইচ্ছে জন্মায় তাঁর তখন থেকেই। স্বামীজির লেখা পড়ার সময়ই শ্রীরামকৃষ্ণদেব আর মা সারদার প্রতিও অগাধ শ্রদ্ধা জন্মায় তাঁর।
কিন্তু রাজকোটে কিছু দিন কাটিয়ে আর ভাল লাগছিল না। ওখান থেকেও একদিন চলে গেলেন। এ বার হিমালয়। সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও। প্রায় পরিব্রাজকের মতো টহল দিতে দিতে একদিন ফিরে আসেন বড়ানগরে। হঠাৎই।
দু’বছর পর ছেলেকে দেখে তো আত্মহারা মা হীরাবেন। ছেলের কাঁধে একটা ছোট্ট ঝোলা। সঙ্গে আর কিছুই নেই। রান্নাঘরে ছিলেন হীরাবেন। ছুটে এলেন ছেলের কাছে। বোন ততক্ষণে দাদাকে দেখে পাগলের মতো চিৎকার জুড়ে দিয়েছে।
সেদিনটা নরেন্দ্র বাড়িতে ছিলেন। কিন্তু রাতটুকু থেকে পরদিনই আবার বাড়ি ছেড়ে চলে যান তিনি। কিন্তু তার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামে সকলের সঙ্গে দেখা করে আসেন নরেন্দ্র। “ও যখন গ্রামে গেল, লুকিয়ে লুকিয়ে ওর ঝোলাটা খুললাম। দেখি, একটা শাল, একটা ফতুয়া আর আমারই একটা পুরনো ছবি। কোথা থেকে যে ওই ছবিটা পেয়েছিল কে জানে!” এ দিন সকালেই ঘটনাটি বলছিলেন হীরাবেন নিজে। এখনও তিনি থাকেন দেশের বাড়িতেই। গিয়ে দেখা গেল ঘরের সেই ‘ট্রেন কামরা’র চেহারাটা আর নেই। কিন্তু বাহুল্যও যে আছে, তাও নয়। দোতলা। রং করা বাড়ি। তারই একটি ঘরে বসে কথা বলছিলেন শীর্ণকায়া বৃদ্ধা হীরাবেন।
দ্বিতীয় বার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নরেন্দ্র ওর কাকা বাবুভাইয়ের কাছে চলে যান। বাবুভাই অমদাবাদে রাজ্য পরিবহণ দফতরে একটা ক্যান্টিন চালাতেন। কিছু দিন ওই ক্যান্টিনেও কাজ করেন মোদী। আর ঠিক এই সময়টাতে তিনি আরএসএসের কাছাকাছি আসেন।
বড়ানগরে আরএসএসের শাখা হয় ১৯৪৪ সালে। এর পর ১৯৪৮ সালে গাঁধীর মৃত্যুর পর এই সংগঠনের খুব বদনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাতে বিশেষ করে গুজরাতে আরএসএসের সংগঠনে বড় ধাক্কা লাগে।
সেই প্রসঙ্গে তুলতেই মোদী বললেন, “আমি আরএসএস করেছি, কিন্তু আমরা কোনও দিন গাঁধীজির মৃত্যু নিয়ে সংগঠনে একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। মহাত্মা সম্পর্কে সংঘের কোনও নেতার মুখ থেকে কোনও খারাপ কথাও বলতে শুনিনি।”
কাকার কাছ থেকেও পালিয়ে এর পর ‘শাখা’য় যোগ দেন মোদী। মুখ্যমন্ত্রীর নতুন সুসজ্জিত ঘরে ছিমছাম টেবিলের উপর নিজের দুই হাত রেখে বসেছিলেন মোদী। সামনেই কাচের একটা পেপারওয়েট হাতে তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “শাখায় যখন থাকতাম তখন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দুধ আনতাম। সকলকে জাগাতাম, চা বানাতাম, ব্রেকফাস্ট তৈরি করতাম সকলের জন্য। আট থেকে ন’টা ঘর ছিল, সেগুলো ঝাঁট দিতাম। পরিষ্কার করতাম। আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবেও তো মনে হয় সেই একই কাজ করে চলেছি।”
গান শুনতে খুব ভালবাসেন নরেন্দ্র মোদী। আজকাল বাড়ি ফিরেও অনেক কাজ। অনেক রাত অবধি ফোনে কথা চলে। বসে বসে হাজারটা ফাইল দেখা থাকে। শুতে শুতে বারোটা তো বাজেই। টিভি দেখার সময়ও হয় না। কিন্তু ঘুমোতে যাওয়ার আগে পুরনো হিন্দি গান শুনতে খুব ভাল লাগে। সে হেমন্ত কুমারই হোক আর রফি-কিশোর। পিয়াসা বা গাইড, সাহেব বিবি গুলাম অথবা আরাধনা।
রাজেশ খন্নার পাশাপাশি এক সময় অমিতাভ বচ্চনের খুব ভক্ত হয়ে পড়ে ছিলেন তিনি। “শোলে যে কত বার দেখেছি, গুনে বলতে পারব না।” সাক্ষাৎকারের একেবারে শেষ পর্বে এসে হঠাৎই বললেন কথাটা, কিন্তু কে বললেন, গুজরাতের বড়ানগরের সেই নরেন্দ্র, নাকি আজকের এই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী?
বোঝা যায় না।