প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। মেলবোর্নে বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ ফাইনাল, ১৯৯২
মাসকয়েক আগে একটি টিভি টক শো-এ জাভেদ মিয়াঁদাদকে নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা।
বিষয়টা ওকে ভারতে আসার ভিসা না দেওয়া নিয়ে। ওর ছেলে জুনেইদ ডন দাউদ ইব্রাহিমের মেয়েকে বিয়ে করেছে, তাই জাভেদের ভিসা দেওয়া নিয়ে শোরগোল।
সেদিন টিভি প্যানেলে ছিলেন বিদেশমন্ত্রকের এক প্রাক্তন উচ্চ পদস্থ আমলা, মিডিয়া টাইকুন বিনোদ মেহতা, সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী এবং শিব সেনার জনপ্রিয় এক নেতা। তার সঙ্গে আমি।
আমলা ভদ্রলোক কেন্দ্রের কাছে আবেদন করছিলেন, প্রাক্তন সুপারস্টারকে যেন ভিসা না দেওয়া হয়। বলছিলেন, মিয়াঁদাদ যে অন্ধকার জগতের সঙ্গে জড়িত, তার ‘অ্যানেকডোটাল প্রমাণ’ আছে। এবং মিয়াঁদাদ নাকি নিজে বেশ কর্কশ চরিত্রের লোক, প্রায় গ্যাংস্টারের মতোই।
স্বীকার করছি, আমি নিজেও মাত্রাতিরিক্ত চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলাম, অ্যানেকডোটাল প্রমাণটা নির্ভেজাল জল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মিয়াঁদাদ অসাধারণ একজন মানুষ, আমার বন্ধু এবং এক ঐতিহ্যশালী ক্রিকেটার।
মনে হয় সেই সন্ধেয় কোনও ভাবে আমার মততামতটা অনেকেরই ভাল সমর্থন পেয়েছিল। যদিও পরে মিয়াঁদাদ নিজেই ভিসার ব্যাপার থেকে পিছিয়ে আসে। ও বলে, সবার কাছে সমান ভাবে স্বাগত না হলে কোথাও যাওয়ার কোনও মানে নেই।
শুনে সত্যিই খুব খারাপ লেগেছিল। কারণ আমরা ওর সঙ্গে পার্টি করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। সে যাত্রায় ক্রিকেট-আড্ডা, পিছনে লাগা, ইয়ার্কি-ঠাট্টা আর মিমিক্রি নিয়ে লম্বা সন্ধেগুলো আর উপভোগ করা হল না।
১৯৭৮-এর পাকিস্তান সফরে মিয়াঁদাদকে যখন দেখি, ও তখন বছর কুড়ির ছটফটে এক জন ক্রিকেটার। প্রচণ্ড প্রতিভাবান আর অসম্ভব আগ্রাসী।
তখনকার দিনে লাইভ টিভি ব্যাপারটা ছিল না। কিন্তু আসিফ ইকবালের সঙ্গে ওর উদ্ধত রানিং বিটউইন দ্য উইকেট্স কেউ দেখেননি, এমনটা হতে পারে না। যার সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণটা হল, কিপার কিরমানির কাছে বলটা পৌঁছনোর আগেই রুদ্ধশ্বাস করিয়ে দিয়ে ওর সিঙ্গল বাই নেওয়া। বোলার ছিল সেবারে ভারতের সফরকারী দলে প্রথম বারের সদস্য কপিল দেব। ওটা ছিল লাহৌরে তৃতীয় টেস্টের সেই মহাকাব্যিক, সফল রান তাড়া করার ম্যাচ।
মিয়াঁদাদের আবির্ভাবের আগে এশিয়ায় যুদ্ধপ্রিয় ক্রিকেটার বলতে ছিলেন একমাত্র ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার। মিয়াঁদাদ জন্ম দিয়েছিল ক্রিকেটারের এক নতুন জাতকে যাকে স্ট্রিট ফাইটার বলা যায়। যে প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাবে। যে ইম্প্রোভাইজ করবে। আর ফিল্ডার হিসেবে যে কখন কী করবে, আঁচ করা যাবে না। ব্যাটসম্যান যদি ক্রিজ ছেড়ে এক পা-ও না নড়ে, তা হলেও স্টাম্প ছিটকে দেবে।
দিনের খেলার পর বেদানার রস খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এ রকম কেন করো? মিয়াঁদাদের জবাব ছিল, ব্যাটসম্যানকে বিরক্ত করাটা ও উপভোগ করে। মহম্মদ আলি আর জন ম্যাকেনরো যে ব্যাপারটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
করাচি থেকে রাওয়ালপিণ্ডির ফ্লাইটে ও এক বার আমাকে বলেছিল যে, আম্পায়াররাও নাকি ওকে ভয় পান! হালকা ভাবে বললে কী হবে, যথেষ্ট ওজন ছিল কথাটার।
বেদানার রস অবশ্য মিয়াঁদাদের পছন্দের তরল ছিল না। যাক গে, পরে আসছি সে কথায়।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে টিমে জায়গা করে নেওয়ার জন্য জাভেদ লড়ছিল সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে। জাহির আব্বাস, মজিদ খান, মুদস্সর নজর, আসিফ ইকবাল, মুস্তাক মহম্মদ আর ওর ভাই সাদিক, ইমরান খানের মতো ক্রিকেটার। এদের সঙ্গে ছিল এক ঝাঁক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান আর ব্যাটিং অলরাউন্ডার।
প্রথমে মিয়াঁদাদ বোলার-ব্যাটসম্যান হিসেবে এলেও পরে নিজের প্রতিভা বুঝে বোলিংটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। আর টিমে জায়গার জন্য কোনও দিন ওকে স্ট্রাগল করতে হয়নি।
আটাত্তরের ‘ফ্রেন্ডশিপ ট্যুরে’ ওর সঙ্গে খুব মজার সময় কেটেছে। ফিল্ম স্টার আর প্লে-বয়, সাহিত্যিক আর লম্পটদের সঙ্গে আমরা পার্টি করতাম।
তখনকার পাকিস্তান একেবারে ‘শুখা’। কিন্তু হৃদয়বান ওয়াসিম বারির সঙ্গে মিলে মিয়াঁদাদ আমাদের লাহৌর আর করাচির সব পার্সি বাসিন্দার সঙ্গে ‘আলাপ’ করাতে নিয়ে যেত। মদিরা পরিবেশন নিয়ে যাঁদের উপর কোনও রকম নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
খুব ভাল করে মনে আছে মিয়াঁদাদের ‘তাজ পোশি’ ওর অভিষেক!
করাচির একটা হোটেলে বিরাট ভোজের ব্যবস্থা করা হল। স্থানীয় কয়েক জন বন্ধু ওকে ‘কিং অব ক্রিকেট’ হিসেবে অভিষিক্ত করল। কিন্তু আমরা যারা ভদ্রতার খাতিরে (ওখানকার স্থানীয় ভাষায় তকলুফ) একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাদের আর খিদে মিটল না। এত তাড়াতাড়ি সব খাবার অদৃশ্য হয়ে গেল!
মিয়াঁদাদ কিন্তু পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। ও আমাদের নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে রান্না করা কিছু খাবার পরিবেশন করল। সত্যি, ওই রাতটা ভোলার নয়!
১৯৭৯-তে পাকিস্তানের ভারত সফরে মিয়াঁদাদের সঙ্গে একই ফ্লাইটে থাকতাম আমরা ক’জন সাংবাদিক, প্লেয়ার, টিমের সঙ্গে ঘোরাফেরা করা কিছু লোকজন আর অফিশিয়াল।
তখনকার দিনে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স (বিমান সংস্থা বলতে তখন ওই একটাই) ফ্লাইটে মদ্যপান করলে কেউ কোনও আপত্তি করত না। মাঝে মধ্যে তো সোডার ব্যবস্থাও করে দিত। ইউনিস আহমেদের সঙ্গে শেষ রো-এ বসত জাভেদ। আর ওখানে বসেই চলত ওর শিভাসের বোতলটাকে আক্রমণ করা। বোতলটা সব সময় ওর সঙ্গেই থাকত।
একবার ফ্লাইটে পাইলটকেই নেমন্তন্ন করে বসল ওর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মদ্যপান করতে। বলল, ওরা নাকি পরের দিনের ওয়ান ডে-তে পাকিস্তানের জয় ‘সেলিব্রেট’ করছে। আগেভাগেই!
জাভেদের হৃদয় যে কত বড়, তা অন্তত কলকাতায় আমার অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের কেউ ভুলবে না। ও এলে আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে বাচ্চারা এসে জড়ো হয়ে যেত। ওদের সবার অটোগ্রাফ চাই। কাউকেই ফেরাত না জাভেদ। আর বেশ অনেক বার, যদি বাচ্চাটার বয়স খুব কম না হত, বোনাস হিসেবে প্রায়ই পরের দিনের খেলার টিকিটও হাতে ধরিয়ে দিত!
জাহির আব্বাস আর খাদ্যরসিক ইমরান খানের সঙ্গে, মাঝে মাঝে সিঙ্গার ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর ইফতিখান আহমেদকে নিয়ে ও প্রায়ই আসত আমাদের বাড়ি। চিৎপুরের রয়্যাল হোটেলের ‘সবচেয়ে সুস্বাদু বিরিয়ানি’ খেতে।
অনেক বছর ধরে ওর একান্ত নিজস্ব স্লেজিঙের ধরনটাকে নিখুঁত করে ফেলেছিল জাভেদ।
দুটো ঘটনা মনে পড়ছে। দিলীপ দোশি ছিল খুব আন্তরিক আর চিন্তাশীল একজন ক্রিকেটার। নিজের বোলিংটাকে দোশি খুব সিরিয়াসলি নিত। ১৯৮৩-র হেমন্তে বেঙ্গালুরুর ম্যাচে বাঁ-হাতি স্পিনার দোশি যখন বল করছে, তখন নন-স্ট্রাইকার্স এন্ড থেকে জাভেদ বারবার জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে, “ওয়েস্ট এন্ড হোটেলে তোমার রুম নম্বরটা কী বলো তো?”
কথাটার মানে খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছিল দিলীপ। শেষ পর্যন্ত নিজের চশমাটা একবার ঠিক করে, বোলিং দৌড়টা থামিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মিয়াঁদাদকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কেন জানতে চাইছ বলো তো?” মিয়াঁদাদের জবাব ছিল, দিলীপের পরের যে ডেলিভারিটা ও খেলবে, সেটাকে ওখানেই পাঠাবে!
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ। সচিন তখন টিনএজার। সিডনিতে আক্রোশ মেটানোর প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ও ব্যাট করতে এল। তখনই সিলি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে পড়ল মিয়াঁদাদ (ম্যাচটা কিন্তু ওয়ান ডে!)। আর সচিনকে সমানে জিজ্ঞেস করে গেল, তুমি হোমওয়ার্ক করেছ তো? না হলে কিন্তু কাল স্যার খুব রাগ করবে।
ঠান্ডা মাথার সচিনকে অবশ্য তাতে নড়াতে পারেনি। ম্যাচের পর গভীর রাতে উত্তর সিডনির একটা পার্টিতে যাওয়ার রাস্তায় মিয়াঁদাদ আমাকে বলল, আম্পায়ার শেফার্ড নাকি ম্যাচ চলাকালীন ওকে ডেকে বলেছিলেন, উর্দুতে গালাগালি না দিয়ে ইংরেজিতে দিতে! মনে হয় এটা পুরোটাই বানানো গল্প। কারণ পাকিস্তানের অন্য কয়েক জন ফিল্ডারের কথা ছিল, আম্পায়াররা জাভেদ মিয়াঁদাদকে ঠান্ডা হতে বলেছিলেন।
অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত