প্রথম বার মুঠোয় নিজের বাড়ির চাবি। যেন স্বপ্নের মতো ঠেকে। কিন্তু তেমনই আবার ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনতে গিয়ে প্রবল হয়রানির তেতো অভিজ্ঞতা হয় অনেকের। যা তাড়া করে দুঃস্বপ্নের মতো।
কেউ হয়তো প্রোমোটারের কাছে গিয়ে-গিয়ে জুতোর শুকতলা খুইয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ফ্ল্যাট আর শেষ হয় না। কেউ হয়তো কষ্টের রোজগারে কিস্তি গুনে চলেছেন। অথচ প্রকল্প শেষ করতে গড়িমসি করছেন ডেভেলপার। কেউ অর্ধেক বাড়ি ওঠার পরে দেখছেন যে তার নক্শায় গলদ, তো কেউ মাথায় হাত দিচ্ছেন প্রকল্পে পুরসভার ঠিকঠাক অনুমোদন নেই দেখে। এমন হাজারো সমস্যায় জেরবার হতে হয় বলেই বাড়ি কেনার নামে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ। ভাবেন, এই বুঝি পা পড়ল কোনও ফাঁদে।
অফিসের ক্যান্টিন থেকে পাড়ার চায়ের দোকান— এত দিন যেখানেই এই সমস্ত সমস্যার কথা উঠত, সেখানেই অবধারিত ভাবে সকলে বলতেন, ‘হবেই তো। পুরো ব্যবস্থাটাই তো নিজের খেয়ালে চলে। কোথাও কারও উপরে সরকারের এক ফোঁটা নিয়ন্ত্রণ নেই। কেউ দেখার নেই যে, নিয়ম আদৌ মানা হচ্ছে কি না!’
কেন্দ্রের প্রস্তাব
বহু দিন ধরে এ সব নিয়ে অভিযোগের পাহাড় জমার পরে শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে নড়েচ়ড়ে বসেছিল মনমোহন সিংহের সরকার। কিন্তু তখন ওই বিল রাজ্যসভায় এনেও তা পাশ করানোর সময় পায়নি তারা। এর পরে জমানা বদলেছে। এখন সংশোধিত আকারে এই বিল পাশ করাতে চায় মোদী সরকার। এপ্রিলের গোড়ায় মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে রিয়েল এস্টেট রেগুলেটরি (আবাসন নির্মাণে নিয়ন্ত্রণ) বিল। এখনও পর্যন্ত এই বিল আইন হয়ে ওঠেনি। তার জন্য আগে তা সংসদে পাশ করতে হবে। তবেই তা গণ্য হবে আইন (অ্যাক্ট) হিসেবে। সরকারের দাবি, এই বিল আইনে পরিণত হলে, নির্মাণ শিল্পে স্বচ্ছতা আসবে। ফ্ল্যাট-বাড়ির ক্রেতাদের কাছে তা রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে। তবে আবারও বলছি, এখনও কিন্তু বিলটি সংসদে পাশ হওয়া বাকি।
কী আছে বিলে?
বিলে আদপে কী আছে? চলুন এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক—
• এই বিলের প্রথম শর্ত, নির্মাণ শিল্পের জন্য তৈরি করতে হবে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। যা দীর্ঘ দিনের দাবি।
শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য সেবি (সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া) রয়েছে। বিমা শিল্পের জন্য আছে আইআরডিএ (ইনশিওরেন্স রেগুলেটরি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি)। ঠিক সে ভাবেই নির্মাণ শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট নীতি তৈরি করতে গড়া হবে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা রেগুলেটরি বডি।
সেই নিয়ন্ত্রকের কাছে থাকবে নির্মাণ শিল্পের সম্পূর্ণ তথ্যভাণ্ডার। যেমন, সমস্ত প্রকল্পের বিশদ বিবরণ, প্রোমোটার-এজেন্টদের সম্পর্কে তথ্য ইত্যাদি। নিয়ন্ত্রকের কাছে নিয়মিত জমা দিতে হবে সব নির্মীয়মাণ প্রকল্পের অগ্রগতির রিপোর্টও।
ফ্ল্যাট-বাড়ি-আবাসন তৈরির প্রতিটি পর্যায়ে সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে চলা হচ্ছে কি না, তার নজরদারির দায়িত্ব বর্তাবে ওই নিয়ন্ত্রক সংস্থার উপর। কেউ নিয়ম ভাঙলে, নিয়ন্ত্রক তাদের তালিকা তৈরি করবে। নেবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও।
ফলে একবার এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা তৈরি হলে, যা খুশি তা-ই করতে দু’বার ভাববেন প্রোমোটাররা। হয়রান হতে হচ্ছে মনে করলে, তার দরজায় কড়া নাড়তে পারবেন আপনিও।
• কোনও আবাসন প্রকল্প গড়ার সময়ে আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে খেপে-খেপে টাকা নেন প্রোমোটাররা। ওই টাকার ৫০ শতাংশ তাঁদের রাখতে হবে প্রকল্পের জন্য খোলা নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টের (এসক্রো অ্যাকাউন্ট) ন্যূনতম ব্যালান্স হিসেবে। এবং তা জমাও দিতে হবে ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে। এই নিয়মের আওতায় আসবেন সমস্ত ডেভেলপার। নির্মাণের খরচ মেটাতে বাধ্যতামূলক করা হবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা অ্যাকাউন্টে রাখাও।
সে ক্ষেত্রে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার টাকা নেই, এ কথা বলা শক্ত হবে প্রোমোটারের পক্ষে। কারণ, সাধারণত নিজের ফ্ল্যাট তৈরির জন্য টাকা দেওয়ার পরেও জানার উপায় থাকে না, তা ওই প্রকল্পেই খরচ হচ্ছে কি না। অনেক সময়েই দেখা যায়, এক প্রকল্পের টাকা অন্য প্রকল্পে খাটাচ্ছেন প্রোমোটার। অনেকে মনে করছেন, এ বার প্রকল্পের টাকার অর্ধেক এসক্রো অ্যাকাউন্টে তুলে রাখতে হলে, সেই সমস্যা কিছুটা মিটবে। যদিও সংসদে বিল আটকে যাওয়ার অন্যতম কারণ এই বিষয়টি ঘিরে তৈরি হওয়া জটিলতা। তা নিয়ে একটু পরে আলোচনায় আসছি।
• বিলের আওতায় আসার কথা কমার্শিয়াল রিয়েল এস্টেট বা বাণিজ্যিক নির্মাণের ক্ষেত্রও (যেমন, অফিসবাড়ি)। সে ক্ষেত্রে এই বিলকে রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন ওই বাণিজ্যিক নির্মাণে জায়গা নেওয়া ক্রেতারাও।
• যে সমস্ত প্রকল্পের (বাণিজ্যিক বা ব্যক্তিগত) কাজ এখনও চলছে (অর্থাৎ নির্মাণ শেষের ‘কমপ্লিশন’ সার্টিফিকেট আসেনি), সেগুলিকেও বিলের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে ওই সব প্রকল্পকেও প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে নথিভুক্ত করতে হবে।
• প্রায়ই দেখা যায় যে, ক্রেতাকে শুরুতে এক রকম নক্শা দেখিয়ে, পরে নিজের সুবিধা মতো তা পাল্টে দিয়েছেন প্রোমোটার। জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। স্বাভাবিক ভাবেই তখন অকূলে পড়েন ক্রেতা। কিন্তু প্রস্তাবিত বিল অনুযায়ী, কোনও প্রকল্পের নক্শা বা কাঠামো এ ভাবে ইচ্ছেমাফিক বদলে ফেলা যাবে না। তার জন্য অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ক্রেতার অনুমতি নিতে হবে।
অনেকে মনে করছেন, এর দরুন নক্শার পাশাপাশি দুশ্চিন্তা দূর হতে পারে ফ্ল্যাটের মাপ নিয়ে। দূর হবে আসলে ফ্ল্যাটের ভিতর কতটা জায়গা (কার্পেট এরিয়া) পাওয়া যাবে, তা ঘিরে বিভ্রান্তিও।
• অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা থাকে এজেন্ট বা দালালদের। ফ্ল্যাটের সন্ধান দেওয়া থেকে শুরু করে লেনদেনের পুরো প্রক্রিয়াতেই জড়িয়ে থাকেন তাঁরা। সেই কারণে প্রোমোটারদের পাশাপাশি বিলের আওতায় আনা হয়েছে এজেন্টদেরও।
বিল অনুযায়ী, কোনও প্রকল্পের বাড়ি-ফ্ল্যাট বিক্রির আগে প্রস্তাবিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে নথিভুক্ত হতে হবে এজেন্টদের। নিয়ম অমান্য করলে পেতে হবে শাস্তিও। অনেক সময়ে দেখা যায়, ক্রেতাকে ভুল বুঝিয়ে যেনতেন প্রকারেণ ফ্ল্যাট বিক্রির চেষ্টা করছেন এজেন্ট। আশা করা হচ্ছে, নতুন আইন চালু হলে সেই প্রবণতা কমবে।
• বিল পাশ হয়ে আইন তৈরির এক বছরের মধ্যে রাজ্যগুলিকেও নিয়ম-কানুন তৈরি করতে হবে। গড়তে হবে আপিল আদালত (অ্যাপেলেট ট্রাইব্যুনাল)। যার মাথায় থাকবেন এক জন বিচারপতি। তিনি অবসরপ্রাপ্তও হতে পারেন। হয়রানির শিকার হলে এই আদালতের কড়া নাড়তে পারবেন ক্রেতারা। মামলা নথিভুক্তির জন্য অনলাইন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এবং আপিল আদালত তৈরির এক বছরের মধ্যেই চালু করতে হবে সেই ব্যবস্থা। যে-কোনও মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা ৬০ দিন।
• বাণিজ্যিক ও আবাসন প্রকল্প— দু’ক্ষেত্রেই প্রোমোটারদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে প্রকল্প নথিভুক্ত করতে হবে। বাধ্যতামূলক ভাবে জমা দিতে হবে তার যাবতীয় তথ্য। এর মধ্যে রয়েছে জমির অবস্থা, প্রকল্পের নক্শা, নির্মাণের বিভিন্ন ধাপের সময়সীমা, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক অনুমোদন ইত্যাদি। দিতে হবে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এজেন্ট, কনট্রাক্টর, আর্কিটেক্ট (স্থপতি) এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের নাম-ঠিকানাও।
• যে-প্রকল্পে ১,০০০ বর্গ মিটার নির্মাণ কিংবা ১২টির বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে, সেই প্রকল্প নিয়ন্ত্রকের কাছে নথিভুক্ত করা বাধ্যতামূলক।
• প্রকল্প নিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে স্থানীয় প্রশাসনের কাছ থেকে বিভিন্ন অনুমোদন নিতে হবে। বিপণনের প্রসঙ্গেও কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে এই বিল। যেমন, প্রকল্পের অবস্থান বা সেখানকার সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোনও বিভ্রান্তিকর তথ্য বিজ্ঞাপনে দেওয়া চলবে না।
নইলে শাস্তি নিয়ম না-মানলে, বন্দোবস্ত রাখা হচ্ছে কড়া শাস্তির। যেমন—
• নথিভুক্ত না-হলে, প্রকল্পের ১০ শতাংশ টাকা জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। তার উপরে নিয়ম-কানুন না মানলে, শাস্তি আরও ১০ শতাংশ টাকা জরিমানা বা তিন বছরের জেল।
অনিয়ম তেমন বাড়াবাড়ি রকমের হলে, জরিমানা ও জেল, দুই শাস্তিই বহাল হতে পারে। প্রয়োজনীয় তথ্য না-দিলে কিংবা ভুল তথ্য দিলে, প্রকল্পের পাঁচ শতাংশ টাকা জরিমানা হিসেবে দিতে হবে। এমনকী একাধিকবার নিয়ম ভাঙলে বাতিল হয়ে যেতে পারে রেজিস্ট্রেশনও।
সময়ে প্রকল্প শেষ করার জন্য প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার।
• নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ না-হলে, ক্রেতারা সুদ সমেত টাকা ফেরত চাইতে পারেন। দাবি করতে পারেন ক্ষতিপূরণও। ফ্ল্যাট সময়ে হাতে না-পেলে যেতে পারেন ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে। না-জানিয়ে প্রোমোটার বাড়ির নক্শা বদলে দিলেও আদালতে যাওয়া যেতে পারে।
তাহলে সমস্যা কোথায়?
আবাসনে নিয়ন্ত্রক এলে যে সাধারণ মানুষের সুবিধা হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিলের কয়েকটি বিষয় নিয়ে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। যেমন তাঁদের অভিযোগ, আগে প্রকল্পের জন্য ক্রেতার কাছে নেওয়া টাকার ৭০ শতাংশ এসক্রো অ্যাকাউন্টে রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু নতুন বিলে তা কমিয়ে করা হয়েছে ৫০ শতাংশ। তা ছাড়া তাঁদের মতে, প্রস্তাবিত আপিল আদালত নখদন্তহীন। নিয়ম ভাঙা নির্মাণ সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার তার নেই।
অবশেষে
সংসদের কক্ষ পেরিয়ে এই বিল কখন, কী ভাবে আইনে পরিণত হবে, তা বলবে সময়ই। তবে আগে থেকেই সে বিষয়ে দু’কথা জেনে রাখলে মন্দ কী?