পাড়ায় বেশ কয়েকটি বাড়িতে ঘর মোছা, বাসন মাজার কাজ করেন কবিতা। কয়েকদিন আগে এসে বললেন, অন্য এক বাড়িতে শুনেছেন এ বার নাকি তাঁদের জন্য কী সব পেনশনের কথা বলা হয়েছে বাজেটে। এতে এখন নাম লেখালে বয়স হলে মাসে ৩,০০০ টাকা পাওয়া যাবে। জানতে চাইলেন, এর জন্য কী করতে হবে, কত টাকা করে দিতে হবে— এই সব নানা খুঁটিনাটি। তাঁর মতো বহু মানুষের আগ্রহে আজ সেই সব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজ নিতেই বসেছি আমরা।
গোড়ার কথা
• পুরো নাম প্রধানমন্ত্রী শ্রম যোগী মানধন পেনশন যোজনা।
• ফেব্রুয়ারিতে এ বারের অন্তর্বর্তী বাজেটে দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল এই পেনশন প্রকল্প।
• প্রকল্পে যোগ দিয়ে নিয়মিত টাকা জমা দিলে, ৬০ বছর বয়সের পর থেকে মাসে মাসে ৩,০০০ টাকা করে পেনশন পাওয়া যাবে।
• প্রকল্পটি পরিচালনার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় শ্রম মন্ত্রক।
• ঠিক মতো তা পরিচালনা করা হচ্ছে কি না, তাতে নজর রাখার দায়িত্বে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা পর্ষদ।
• প্রকল্পের টাকা জমা রাখা ও তহবিল পরিচালনার ভার জীবন বিমা
নিগমের (এলআইসি)।
• কর্মীদের পেনশন দেওয়ার দায়িত্বেও থাকবে তারাই।
কাদের জন্য
• দেশের মানুষের একটা বড় অংশ কাজ করেন অসংগঠিত নানা ক্ষেত্রে। যেমন, গৃহ পরিচারিকা, ফেরিওয়ালা, ঠেলা চালক, রিক্শা চালক, কাগজ কুড়ানি, গ্রামীণ ভূমিহীন চাযি, কৃষি ক্ষেত্রের অন্যান্য কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, বিড়ি শ্রমিক, ইট ভাটার কর্মী ইত্যাদি। তাঁদের সকলেই এই প্রকল্পে নাম লেখাতে পারবেন।
• যোগ দিতে পারবেন পুরুষ ও মহিলা, সব কর্মীরাই।
যোগ্যতা
• এই প্রকল্পে যোগ দিতে চাইলে বয়স হতে হবে ১৮ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
• মাসিক আয় হতে হবে ১৫,০০০ টাকার মধ্যে।
• তবে একবার প্রকল্পে যোগ দেওয়ার পরে আয় ১৫,০০০ টাকা ছাড়ালেও সেটি চালিয়ে যাওয়া যাবে।
• অটল পেনশন প্রকল্পে নাম থাকলে এতে যোগ দিতে বাধা নেই।
• পেনশন ব্যতীত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য আনা কোনও রাজ্য সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পেলেও এতে শামিল হতে পারবেন।
কারা পারবেন না
• কোনও অবস্থাতেই ৪০ বছরের বেশি বয়সীরা এতে নাম লেখাতে পারবেন না। অন্য কোনও পেনশন প্রকল্পে যোগ না দিয়ে থাকলে কিংবা অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিতে রাজি থাকলেও নয়।
• যাঁরা প্রভিডেন্ট ফান্ডের অথবা অন্য কোনও পেনশন প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন, তাঁরা শ্রম যোগী মানধনে যোগ দিতে পারবেন না।
কত টাকা দিতে হবে?
• কর্মীর বয়স অনুসারে স্থির হবে প্রিমিয়াম। ধরুন কেউ ১৮ বছর বয়সে যোগ দিলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁকে দিতে হবে মাসে ৫৫ টাকা করে। আবার ৪০ বছরে গিয়ে নাম লেখালে প্রিমিয়াম হবে ২০০ টাকা।
• ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রিমিয়াম দিতে হবে।
• কর্মী যে পরিমাণ টাকা দেবেন, কেন্দ্রও সেই একই অঙ্কের টাকা ওই খাতে জমা দেবে।
• কর্মীকে প্রথম মাসের প্রিমিয়াম দিতে হবে নগদে।
• তার পরের মাস থেকে প্রতি মাসে ব্যাঙ্ক থেকে অনলাইন মারফত সরাসরি টাকা কেটে নেওয়া হবে।
• চাইলেও নির্ধারিত অঙ্কের বেশি টাকা দেওয়া যাবে না।
নাম লেখানোর উপায়
• এই প্রকল্পে যোগ দিতে হলে থাকতে হবে সেভিংস অ্যাকাউন্ট। তা সাধারণ বা জনধন অ্যাকাউন্ট হতে পারে।
• থাকতে হবে আধার কার্ডও।
• ওই দু’টি নিয়ে যেতে হবে যে কোনও তথ্যমিত্র বা কমন সার্ভিস সেন্টারে (সিএসসি)।
• এলআইসি, কর্মী প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএএফ) এবং ইএসআই কর্তৃপক্ষকেও সমস্ত দফতরে প্রকল্পে নথিভুক্ত করার পরিকাঠামো চালু করতে বলা হয়েছে।
• কর্মীর নিজের জন্ম তারিখের প্রমাণপত্র লাগবে না। তাঁর সই করা জন্ম তারিখ (সেল্ফ সার্টিফিকেশন) এবং আধার কার্ডের ভিত্তিতেই নথিভুক্ত হওয়া যাবে।
• নমিনির ক্ষেত্রে জন্ম তারিখের প্রমাণপত্র লাগবে।
• ভুয়ো জন্ম তারিখ দাখিল করলে জরিমানা হতে পারে।
• নাম নথিভুক্ত করতে কর্মীকে কোনও টাকা দিতে হবে না।
• তবে প্রতিটি নাম নথিভুক্ত করতে ৩০ টাকা করে পাবে ওই সব কেন্দ্রগুলি। যা সরকারই দেবে।
টাকা বাকি পড়লে?
• কোনও কারণে কয়েক মাস প্রিমিয়াম দেওয়ার পরে গ্রাহক তা বন্ধ করতে বাধ্য হলে, পরে ফের সেই টাকা মেটানোর সুযোগ রয়েছে।
• সে ক্ষেত্রে কর্মীকে বকেয়া প্রিমিয়ামের পুরো টাকা সুদ-সহ মিটিয়ে দিতে হবে।
• এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে জরিমানা দিতে হতে পারে।
ঋণের সুযোগ
• মানধন পেনশন প্রকল্প থেকে ঋণ নেওয়ার সুবিধা নেই।
• মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আংশিক ভাবেও টাকা তোলা যাবে না।
• শুধু পেনশনই মিলবে।
প্রকল্প বন্ধ করলে
অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরির স্থায়িত্বের অনিশ্চয়তার বিষয়টি মাথায় রেখে, ৬০ বছরের আগে প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে এতে। তবে সে ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে টাকা পাওয়া যাবে। শর্তগুলি হল—
• কর্মী প্রকল্পে যোগ দেওয়ার পরে ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে বেরিয়ে আসলে, তাঁর নিজের অংশের জমা টাকা সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া সুদ-সহ ফেরত পাবেন। সরকারের দেওয়া অংশ পাবেন না।
• ১০ বছরের পরে বেরিয়ে এলেও নিজের অংশের টাকা সুদ-সহ ফেরত মিলবে। তবে এ ক্ষেত্রে সেভিংস অ্যাকাউন্ট বা পেনশন প্রকল্পে ঘোষিত হারের মধ্যে যেটি বেশি, সেই হারে সুদ পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রের দেওয়া টাকা মিলবে না।
• ৬০ বছরের আগে কোনও কারণে (ছাঁটাই, শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি) আয় বন্ধ হলে, নিজের অংশের টাকা সুদ-সহ তোলা যাবে। বা ৬০ বছর পর্যন্ত প্রিমিয়াম দিয়ে পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যাবে।
সংগঠিত ক্ষেত্রে গেলে
• এই প্রকল্পে যোগ দেওয়ার পরে কোনও কর্মী সংগঠিত ক্ষেত্রে যোগ দিলে, একই ভাবে নিজের জমা দেওয়া মোট টাকা তুলে নিতে পারবেন।
• তবে চাইলে এই প্রকল্পে থাকাও যাবে। সে ক্ষেত্রে ৬০ বছর পর্যন্ত প্রিমিয়াম দিয়ে যেতে হবে।
• ৬০ বছর বয়স হলে সুদ-সহ নিজের টাকা তোলা যাবে। সুদ মিলবে সেভিংস ও প্রকল্পে ঘোষিত সুদের মধ্যে যেটি বেশি, সেই হারে। পাওয়া যাবে না সরকারের অংশের টাকা।
পেনশন কী ভাবে?
• প্রকল্পে নাম নথিভুক্তির সময়ে যে সেভিংস অ্যাকাউন্টের তথ্য জমা দেওয়া হবে, সেখানেই প্রতি মাসে জমা পড়বে পেনশনের ৩,০০০ টাকা।
কর্মী মারা গেলে
• কর্মী প্রকল্পে যোগ দেওয়ার পরে কিন্তু ৬০ বছরে পেনশন শুরুর আগে মারা গেলে, তাঁর স্বামী বা স্ত্রীর কাছে দু’টি বিকল্প থাকবে—
এক, জমা হওয়া টাকা সুদ-সহ তুলে নিতে পারবেন।
দুই, চাইলে মূল কর্মীর বয়স ৬০ বছর হওয়া পর্যন্ত তাঁর অংশের টাকা জমা দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির যে সময়ে ৬০ বছর বয়স হত, সেই সময় থেকেই স্বামী বা স্ত্রী মাসে ৩,০০০ টাকা করে পেনশন পাবেন।
• পেনশন চালুর পরে কোনও কর্মী মারা গেলে, তাঁর স্বামী বা স্ত্রী সেই পেনশন পাবেন। পাওয়া যাবে মূল পেনশনের অর্ধেক টাকা।
• কর্মীর সন্তানেরা পেনশনের টাকা পাওয়ার অধিকারী নন। সে ক্ষেত্রে কর্মী এবং তাঁর স্ত্রী বা স্বামী মারা গেলে, তাঁর অ্যাকাউন্টের টাকা এই প্রকল্পের পেনশন তহবিলে চলে যাবে।
নমিনি
• কর্মী মারা গেলে তাঁর স্ত্রী বা স্বামী আপনা থেকেই নমিনি হিসাবে পেনশন পাওয়া বা টাকা তোলার অধিকারী হবেন।
• এ ছাড়া কর্মী চাইলে অন্য কাউকে নমিনি করতে পারেন।
• কর্মী পেনশন শুরুর আগে মারা গেলে অথবা স্বামী বা স্ত্রী না থাকলে, নমিনি কর্মীর অংশের টাকা সুদ-সহ তুলে নিতে পারবেন। তবে সরকারের টাকা পাবেন না। মিলবে না পেনশনও।
• স্বামী-স্ত্রী উভয়েই প্রকল্পের সদস্য হলে এবং দু’জনেই ৬০ বছর বয়স হওয়ার আগে মারা গেলে নমিনি তাঁদের নিজস্ব অংশ সুদ-সহ ফেরত পাবেন। কেন্দ্রের অংশ পাবেন না।
• একাধিক স্বামী বা স্ত্রী থাকলে, সংশ্লিষ্ট কর্মী যাঁকে নমিনি করে যাবেন তিনিই টাকা পাবেন।
• নমিনি না থাকা অবস্থায় একাধিক স্বামী বা স্ত্রী তা দাবি করলে, আদালত ঠিক করবে কে পেনশন পাবেন।
অভিযোগ জানাতে
• প্রকল্প নিয়ে কোনও অভিযোগ থাকলে, তা তথ্যমিত্র দফতরে অথবা শ্রম কল্যাণ দফতরে জানাতে হবে।
• অভিযোগ জানানোর জন্য নির্দিষ্ট কল সেন্টারও থাকবে। যার নম্বর: ১৮০০-২৬৭-৬৮৮৮।