সুবীর (৪৬) • স্ত্রী (৪০) • ছেলে (১৫) • বাবা (৮৫)
বেসরকারি সংস্থার কর্মী • নিজেদের বাড়ি • স্ত্রী গৃহবধূ
• ইচ্ছা, ৫-১০ বছরে ব্যবসা শুরুর • আর্থিক পরিকল্পনা নিয়ে জানতে আগ্রহী
অনেক সময়েই দেখা যায়, মাইনে ভাল। কিছু লগ্নি করা আছে। পৈতৃক সম্পত্তিও মন্দ নেই। কিন্তু জমানো টাকার উপর ভবিষ্যতে তেমন ভাল রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কিংবা কাজের সময়ে অনেক হাতড়েও তহবিলের খোঁজ মিলছে না। কারণ সেই একটাই। পরিকল্পনার অভাব। সুবীরের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখতে পাচ্ছি আমরা।
বয়স ৪৬ বছর। ভাল বেতনের চাকরি করেন। পৈতৃক বাড়ি। থাকেন স্ত্রী, ছেলে, বাবার সঙ্গে। বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। ফলে মাস গেলে পেনশন পান ২০ হাজার টাকা। রয়েছে ৫০ লক্ষের সম্পদও। সুবীরের নিজের দু’টি ফ্ল্যাট। যার একটি বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। অর্থাত্ সেখান থেকে কোনও আয় হয় না। আর যেটি ভাড়া দিয়েছেন, তার থেকে হাতে আসছে মাত্র ৬,০০০।
বেশ কিছু জীবনবিমা প্রকল্পও রয়েছে তাঁর। যেগুলির মোট বিমামূল্য ৯৭ লক্ষের বেশি। এর বাইরে বাদবাকি সঞ্চয় প্রায় নেই বললেই চলে। পাশাপাশি সব খরচ এবং লগ্নির পরে সুবীরের হাতে মাস গেলে ৩৫ হাজারের বেশি থাকলেও, কোনও প্রকল্পে জমা করেন না সেই টাকা। অর্থাৎ এখানে সুবীরকে লগ্নি করতে দেখছি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই।
জীবনবিমার সমস্যা
• আগেও বহু বার বলেছি, জীবনবিমাকে সঞ্চয়ের মাধ্যম হিসেবে না-দেখাই ভাল। সুবীরকেই দেখুন, মাসে প্রায় ৪৯ হাজার টাকা তিনি রাখেন শুধু বিভিন্ন সংস্থার জীবনবিমা প্রকল্পে। অথচ সেই তুলনায় বিমামূল্য মাত্র ৯৭ লক্ষ টাকা। একই পরিমাণ বিমা যদি তিনি আগামী ১৪ বছরের জন্য এখন টার্ম পলিসি-র মারফত করেন, তা হলে তাঁর খরচ হবে বছরে ২৫ হাজারের মতো। অর্থাৎ মাসে ২,০০০ টাকার একটু বেশি। এটা অল্প বয়সে করলে প্রিমিয়াম আরও কম লাগত। তখন বাকি টাকা অন্যান্য খাতে লগ্নি করতে পারতেন। সে ক্ষেত্রে সুবীরের পক্ষে অনেক বেশি টাকার তহবিল তৈরি করা সম্ভব হত।
• সুবীরের বেশির ভাগ বিমার মেয়াদই শেষ হচ্ছে আগামী ৫-৬ বছরের মধ্যে। তখন তাঁর বয়স দাঁড়াবে ৫১-৫২ বছর। অথচ এই সময়েই সুবীরের বিমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যে-কারণে আমি বলব এখনই তাঁকে বেশ বড় অঙ্কের টার্ম পলিসি করতে। কমপক্ষে ৬৫-৭০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত যেন প্রকল্পের মেয়াদ থাকে।
• যে-পলিসিগুলির অনেক দিন প্রিমিয়াম দেওয়া হয়ে গিয়েছে, সেগুলি চালিয়ে যান। কিন্তু যেগুলি সবেমাত্র শুরু করেছেন, সেগুলি বন্ধ করবেন কি না, তা ভাল ভাবে ভেবে দেখুন। কথা বলুন বিমা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।
• মনে রাখবেন, চেনা বিমা এজেন্টের কথায় টাকা না-রেখে, প্রয়োজন বুঝে লগ্নি করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
অবসরের তহবিল
• বহু বেসরকারি সংস্থাতেই দেখা যায় কর্মীদের মূল বেতন কম, কিন্তু অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে মাস গেলে হাতে আসা টাকার অঙ্ক বেশ ভাল। কিন্তু এতে পিএফে জমানো টাকার পরিমাণ অনেকটাই কমে যায়। সুবীর মাস গেলে ১ লক্ষ টাকা বেতন পেলেও, তাঁর পিএফ কাটে মাত্র ২,০০০ টাকা। এই খাতে মোট জমা হয়েছে মাত্র আড়াই লক্ষ। তাই প্রতি মাসে যে ভাবে পিপিএফে ৮,৫০০ টাকা সুবীর লগ্নি করেন, তা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
• সুবীরের শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডে কিছু লগ্নি ছিল, যা তিনি ফ্ল্যাট কেনার কাজে লাগিয়েছেন। অথচ নতুন করে শেয়ার বাজারে টাকা ঢালতে আগ্রহী নন তিনি। আমার মতে, অল্প অল্প করে ফের শেয়ারে লগ্নি করুন। সরাসরি না-চাইলে সাহায্য নিন মিউচুয়াল ফান্ডের। এসআইপি পদ্ধতিতে এখানে টাকা রাখলে, ঝুঁকি অনেকটা কমানো সম্ভব। পাশাপাশি, মূল্যবৃদ্ধিকে কাবু করতে এবং অবসরের তহবিল গড়তে হলে তাঁকে এমন প্রকল্পে লগ্নি করতে হবে, যাতে ভাল রিটার্ন মেলে। তাঁর হাতে এখন সংসার খরচ চালানোর পরেও মাসে ৩৫ হাজারের বেশি টাকা থাকে। সেখান থেকে ১০ হাজার টাকার শেয়ার ভিত্তিক ফান্ডে এসআইপি চালু করুন। দেখবেন যেন নানা ধরনের প্রকল্পে লগ্নি ছড়ানো থাকে।
• ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডেও রাখতে পারেন ১৫ হাজার টাকা করে। যদি পুরো টাকা ঋণপত্র নির্ভর ফান্ডে না-রাখতে চান, তা হলে ৫ হাজার টাকা থাকুক রেকারিং-এ।
• হাতে থাকা বাড়তি টাকা আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য সেভিংস অ্যাকাউন্টে রাখুন।
• পৈতৃক সম্পত্তির অংশ রাখতে হবে সুবীরের অবসর জীবনের জন্য।
ফ্ল্যাট-বাড়িতে লগ্নি
জীবনবিমার পরে সুবীরের সবচেয়ে বেশি টাকা লগ্নি করা রয়েছে ফ্ল্যাট এবং বাড়িতে। তাঁর একটি পৈতৃক বাড়ি আছে এবং সঙ্গে দু’টি ফ্ল্যাট। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু সমস্যা।
• যে-পৈতৃক বাড়িতে তিনি থাকেন, তা তাঁর সম্পদ হিসেবে ধরতে পারব না। কারণ, প্রয়োজনে তিনি সেটি বিক্রি করতে পারবেন না। তা হলে পরিবার-সহ যাবেন কোথায়? ফলে তাঁর হাতে থাকছে দু’টি ফ্ল্যাট।
• এটা ভাল যে, দু’টি ফ্ল্যাটই ঋণমুক্ত। অর্থাৎ এগুলির জন্য বাড়তি ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে না সুবীরকে। কিন্তু একটি ফ্ল্যাট বন্ধ। ভাড়া দেওয়ার কথাও ভাবেননি। অন্যটি ভাড়া দিলেও, তার অঙ্ক তুলনায় অনেকটাই কম।
• মনে রাখতে হবে, অবসর যত এগিয়ে আসবে, টাকার প্রয়োজন ততই বাড়বে। কারণ, তিনি নিজের ব্যবসা শুরুর কথা ভাবছেন। আবার তাঁকে ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্যও বেশ কিছু টাকা জোগাড় করতে হবে। ফলে তখন তাঁকে কমপক্ষে একটি বা দু’টি ফ্ল্যাটই বিক্রি করতে হতে পারে। কিন্তু ফ্ল্যাট বা বাড়ি বিক্রি করা অতটা সহজ নয়। আসুন এক ঝলক দেখে নিই তিনি কী কী অসুবিধার মুখে পড়তে পারেন—
• গত কয়েক বছরে কলকাতা ও তার আশেপাশের এলাকায় হু হু করে বেড়েছে জমি, ফ্ল্যাট-বাড়ির দাম। কিন্তু সেই ধারা এখন থিতিয়েছে। আগামী ক’বছরে তা আর বেশি না-ও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে কিন্তু ফ্ল্যাট বিক্রি করে খুব বেশি লাভ না-করারই সম্ভাবনা।
• গত কয়েক বছরে অনেকেই জমি, বাড়িতে লগ্নি করেছেন। ফলে সেই চাহিদার সুযোগে দিকে দিকে বিভিন্ন ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। এখন অবস্থা এমন যে, চাহিদার তুলনায় ফ্ল্যাটের জোগান বেশি। ফলে আগামী দিনে বহু জায়গায় তার দাম কমতেও পারে। তখন ফ্ল্যাট বেচলে ক্ষতি।
• নতুন নতুন ফ্ল্যাট-বাড়ি তৈরি হওয়ায় পুরনো ফ্ল্যাট-বাড়িগুলির ভাল দর পাওয়া মুশকিল হতে পারে।
• একটি ফ্ল্যাট/বাড়ির কর এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচও মাথায় রাখতে হবে। এই খরচ কিন্তু মুনাফা অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। কিছু টাকা সুবীর ভাড়া থেকে আয় করেন ঠিকই, কিন্তু ওই টাকায় দু’টি ফ্ল্যাট দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। নিজের পকেট থেকেই এ জন্য বেশি টাকা দিতে হয়।
• স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করার প্রক্রিয়া কিন্তু অনেকটাই সময়সাপেক্ষ। তার উপর বিক্রির পরে মূলধনী লাভকরের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
অর্থাত্ দেখা যাচ্ছে ফ্ল্যাট-বাড়িতে লগ্নি করার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা করে না-এগোলে পরে তা বুমেরাং হতে পারে।
ব্যবসার টাকা
আগামী ৫-১০ বছরে ব্যবসা শুরু করতে চান সুবীর। কিন্তু কী ব্যবসা করতে চান বা সে জন্য কত মূলধন লাগবে, তা খোলসা করে জানাননি। তাই আলাদা করে তাঁকে এ বিষয়ে পরামর্শ দেব না। কিন্তু ব্যবসা ভাল মতো না-দাঁড়ালে সংসার চলবে কী ভাবে, সুবীর তা নিয়ে ভাবেননি বলেই আমার মনে হয়। তখন আর মাস গেলে বেতন থাকবে না। অথচ ছেলের পড়াশোনার খরচ-সহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় বাড়বে অনেকটাই। তাই পরিবার চালানোর খরচ কোথা থেকে আসবে, তা প্রথমেই ভেবে দেখতে হবে। তৈরি করে রাখতে হবে ব্যবসার বিকল্পও।
স্বাস্থ্যবিমা
নিজেদের ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা ছাড়াও, অফিস থেকে আরও ৩ লক্ষ টাকার বিমা পান সুবীর। কিন্তু চাকরি ছাড়লে বা অবসরের পরে তাঁর সেই সুবিধা থাকবে না। যে কারণে তাঁকে স্বাস্থ্যবিমার অঙ্ক বাড়াতে বলব।
(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)
(ছবি প্রতীকী)