অমূল্য (৩৩) • স্ত্রী (২৮) • ছেলে (৩ মাস)
স্কুল শিক্ষক • থাকেন গ্রামের বাড়িতে • সন্তানের জন্য সঞ্চয়ে আগ্রহী • চান, সুরক্ষিত ও সচ্ছল ভবিষ্যত্
• ইচ্ছা, বছরে এক বার বেড়াতে যাওয়া • চাকরি থাকতে তৈরি করতে চান নিজের বাড়ি
অমূল্যের প্রোফাইল রীতিমতো তারিফ করার মতো। নিজের ক্ষমতা বুঝে তিনি ইতিমধ্যেই যেমন জীবনবিমা, টার্ম পলিসি, পিপিএফ-এ লগ্নি করে করছাড়ের সুবিধা নিচ্ছেন, তেমনই মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নির মাধ্যমে সম্পদ বাড়ানোর কাজেও মন দিয়েছেন। মাথায় রেখেছেন স্বাস্থ্যবিমার কথাও।
আমরা অনেক প্রোফাইলই দেখি, যেখানে লগ্নিকারী বুঝে পান না, কোন খাতে লগ্নি করবেন। সেখানে অমূল্যর প্রোফাইল বাছাই কিন্তু বেশ গোছানো। কিন্তু মনে রাখতে হবে শুধু বিভিন্ন খাতে লগ্নি ছড়িয়ে দিলেই হবে না। যে-প্রকল্পে টাকা রাখছেন সেটি সঠিক কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। যে-প্রকল্পে রেখেছি, সেটি আমার জন্য কতটা উপযুক্ত, প্রয়োজনের সময়ে তার রিটার্ন কতটা কাজে আসবে, মাথায় রাখতে হবে সেই বিষয়টিও। এই দুই মিলিয়েই লগ্নির লক্ষ্যপূরণ সম্ভব।
আজ আমরা অমূল্যের প্রোফাইলও সে ভাবেই বিচার করব। দেখব ইতিমধ্যেই যে-প্রকল্পে লগ্নি করেছেন, সেগুলি তাঁর জন্য উপযুক্ত কি না। যদি না-হয়, সে ক্ষেত্রেই বা তাঁর কী করণীয়?
জীবনবিমা
অসুবিধা
• এনডাওমেন্ট এবং মানি ব্যাক মিলিয়ে চারটি বিমা প্রকল্পে বছরে ৩৯ হাজার টাকা প্রিমিয়াম দিলেও, বিমা মূল্য মাত্র ১১ লক্ষ টাকা। প্রয়োজনের তুলনায় এই বিমা মূল্য কিন্তু অনেকটাই কম।
• সম্প্রতি এলআইসি থেকে ৩৫ বছরের ৩৫ লক্ষ টাকার টার্ম পলিসি করেছেন অমূল্য। প্রিমিয়াম বছরে ১৩,২৯৩ টাকা। টার্ম পলিসি করা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু এই প্রকল্প চাহিদা মেটাতে পারবে কি না, ভেবে দেখুন।
করণীয়
• বিমা গোল্ড ও নিউ বিমা গোল্ড দু’টিই দীর্ঘমেয়াদি মানি ব্যাক এনডাওমেন্ট পলিসি। নির্দিষ্ট সময় অন্তর টাকা ফেরত পাওয়া যায় বলে, মেয়াদ শেষে পাওয়া টাকার পরিমাণ তুলনায় কম। আবার নির্দিষ্ট সময়ে যে টাকা মেলে, বেশির ভাগ সময়েই তা খরচ হয়ে যায়। ফলে নতুন করে সঞ্চয়ের সুযোগও থাকে না। ফলে এই প্রকল্পগুলি চালানো উচিত হবে কি না, তা ভেবে দেখা জরুরি।
• বিমা কিরণ এবং জীবন সরল প্রকল্প দু’টি আপাতত চালিয়ে যান।
• ৩৫ লক্ষ টাকার টার্ম পলিসিও অমূল্যের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কারণ, বর্তমানে তিনি পান ৩.৮৪ লক্ষ টাকা। এ বার ওই টাকা প্রতি বছর পেতে হলে তাঁর বিমার অঙ্ক হতে হবে ৩.৮৪ X ১০০/৮= ৪৮ লক্ষ টাকা। অর্থাত্ তাঁকে ন্যূনতম ৪৮ লক্ষের বিমা করাতে হবে।
এখন তাঁর বিমার অঙ্ক বেশ ভাল। তবে যেহেতু কয়েকটি প্রকল্প বন্ধের কথা বলেছি, তাই ঘাটতি মেটাতে অন্য সংস্থা থেকে টার্ম পলিসি নিন। মোট কথা, সব মিলিয়ে বিমার অঙ্ক হতে হবে ওই ৪৮ লক্ষ টাকা বা তার বেশি। আমার মতে, বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্পগুলি তুলনা করুন। মাথায় রাখবেন—
১) প্রিমিয়ামের অঙ্ক।
২) টাকা পাওয়ার ইতিহাস।
৩) সংস্থার ব্যবসার ইতিহাস।
৪) পরিষেবার মান ও স্বচ্ছতা।
পিপিএফ এবং জিপিএফ
অসুবিধা
এই দুই খাতেই অমূল্যের লগ্নি কম।
করণীয়
করছাড় ও বছরে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়ের সুবিধা থাকায় পিপিএফ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই আকর্ষণীয়। ফলে এই প্রকল্পে লগ্নি বাড়ান। হাতে যখনই টাকা আসবে, তা এই প্রকল্পে রাখতে থাকুন।
স্বাস্থ্যবিমা
অসুবিধা
এলআইসি-র ও টাটা এআইএ-র দু’টি স্বাস্থ্যবিমা রয়েছে অমূল্যের। মনে রাখতে হবে, এই দু’টি পলিসিই কিন্তু হেল্থ ইনশিওরেন্স। মেডিক্লেম নয়। সাধারণ ভাবে জীবনবিমা সংস্থাগুলি
যে-স্বাস্থ্যবিমা পলিসি বাজারে আনে, সেগুলি চিহ্নিত হয় হেল্থ ইনশিওরেন্স হিসেবে। আর সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি যে-স্বাস্থ্যবিমা আনে, সেগুলিই মেডিক্লেম হিসেবে পরিচিত।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এই ধরনের হেল্থ ইনশিওরেন্সে প্রিমিয়ামের অঙ্ক তুলনামূলক ভাবে বেশি। সাধারণত এগুলিতে ‘ক্যাশলেস’ সুবিধা থাকে না। আগে টাকা খরচ করার পরে তবেই তা ফেরত পাওয়া যায়। মেলে না বোনাসও। কভারেজও সেই অর্থে খুব বেশি নয়। ফলে এই বিমাগুলি প্রয়োজনের সময়ে কতটা কাজে আসবে, তা ভেবে দেখুন।
অমূল্য ইতিমধ্যেই ৫ লক্ষ টাকার আরও একটি ফ্যামিলি ফ্লোটার বিমা কিনেছেন। সেটি চালিয়ে যান।
করণীয়
অল্প অল্প করে হলেও, ফ্যামিলি ফ্লোটার বিমাটির অঙ্ক বাড়াতে থাকুন।
মিউচুয়াল ফান্ড
আমি বেশির ভাগ মানুষকেই সামর্থ অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করার পরামর্শ দিই। তবে তার জন্য বাছতে হবে সঠিক প্রকল্প। প্রত্যেকের জন্য যা আলাদা। অমূল্য ৪টি মিউচুয়াল ফান্ডে এসআইপি করেছেন। যা দেখে কয়েকটি কথা আমার মনে হয়েছে, তাই বলছি।
অসুবিধা
• লার্জ ক্যাপ, মিড ক্যাপ, গোল্ড ফান্ড ও করছাড়যুক্ত প্রকল্প মিলিয়ে ৪টি ফান্ডে এসআইপি করেছেন তিনি। লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়া ভাল, কিন্তু মাত্র ৪,০০০ টাকা হাতে নিয়ে তা করা উচিত কি না, সে বিষয়ে ভাবতে হবে।
• ফান্ডগুলি অমূল্যের ক্ষেত্রে উপযুক্ত কি না, ভেবে দেখতে হবে তা-ও। বিশেষত গোল্ড ফান্ডের অবস্থা এখন খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। স্বল্প মেয়াদে প্রত্যাশার তুলনায় রিটার্ন মিলছে কম। ফলে এই প্রকল্পে নতুন লগ্নি আপাতত বন্ধ রাখা ভাল। তবে, জমানো টাকা তুলে না-নিয়ে, তা রেখে দিন। এর পরে সোনা একটু ভাল ফল দেবে মনে হলে নতুন লগ্নি করতে পারবেন।
• অমূল্য ৫ বছরের জন্য করছাড়যুক্ত প্রকল্পে এসআইপি করেছেন। এই প্রকল্পগুলির সাধারণত নির্দিষ্ট লক-ইন পিরিয়ড থাকে। তাঁর ক্ষেত্রে সেই মেয়াদ ৩ বছর। করছাড় থাকায় প্রকল্পগুলি আকর্ষণীয় মনে হলেও মুশকিলটা হল, এই প্রকল্পটি থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড ফের সেখানেই লগ্নির নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তিনি। ফলে তিনি যে-ডিভিডেন্ডই পান না-কেন, তা-ও কিন্তু সেই প্রকল্পেই ফের লক-ইন হয়ে যাবে আরও ৩ বছরের জন্য। এ ভাবে চলতে থাকলে কখনওই প্রকল্পটি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন না।
করণীয়
• আপাতত গোল্ড ফান্ড বন্ধ রেখে সেই টাকা কোনও ইনডেক্স ফান্ডে লাগান।
• করছাড়যুক্ত প্রকল্পে ‘ডিভিডেন্ড রি-ইনভেস্টমেন্ট’-এর বদলে ‘গ্রোথ’ বা ‘ডিভিডেন্ড পে আউট’-এর সুযোগ নেওয়ার জন্য আবেদন করুন।
• অমূল্যের হাতে মাস গেলে যে-টাকা থাকছে, সেখান থেকে সন্তানের শিক্ষার জন্য এসআইপি করুন। তবে তার আগে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন।
• নির্দিষ্ট সময় অন্তর হাতে থাকা ফান্ডগুলির অবস্থা খতিয়ে দেখুন।
অন্যান্য
• ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে রেকারিং চালু করুন ৫ বছরের জন্য। সেখান থেকে যে-টাকা পাওয়া যাবে, তা স্থায়ী আমানতে রাখুন আপত্কালীন ব্যবস্থা হিসেবে।
• উপরের পদ্ধতিতেই অবসর ও বাড়ি তৈরির জন্য সঞ্চয় করুন। বেতন বাড়লে এই খাতে লগ্নিও বাড়ান।
• হাতে হঠাত্ করে থোক টাকা এলে ডাকঘর থেকে এনএসসি কিনুন।
• এই সব কিছুর পরে দেখুন হাতে কত টাকা থাকছে, সেই অনুসারে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করুন। প্রথম দিকে প্রতি বছর যাওয়া না-হলেও, দু’তিন বছর অন্তর তা হতেই পারে।
এ ভাবে পরিকল্পনা করলে আশা করব অমূল্যের কিছুটা হলেও সুরাহা হবে। তবে এ জন্য সঞ্চয়ের অভ্যাস বজায় রাখতে হবে।
(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)
অমূল্যের মতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পেতে পারেন আপনিও। নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানিয়ে চিঠি লিখুন—
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১.
ই-মেল: bishoy@abp.in