সঞ্চয়ের পরামর্শ

ব্যাঙ্কে আপনার অধিকার

ব্যাঙ্ক আর গ্রাহকের সম্পর্ক পারস্পরিক প্রয়োজন নির্ভর। যাকে পোক্ত করতে শুধু আইনি অধিকার রক্ষা নয়, ব্যাঙ্কের কিছু নৈতিক দায়িত্ব পালন করার দায়ও থেকে যায়। অমিতাভ গুহ সরকারধরুন বাসে বসে আছেন। এমন সময়ে কোনও বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তি এসে সামনে দাঁড়ালেন। আপনার কী করা উচিত? আইনে কোথাও কিন্তু লেখা নেই যে আপনি বসার জায়গাটা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য। বা না-হলে আপনার হাজতবাস বা জরিমানা হবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১১
Share:

ধরুন বাসে বসে আছেন। এমন সময়ে কোনও বৃদ্ধ বা অসুস্থ ব্যক্তি এসে সামনে দাঁড়ালেন। আপনার কী করা উচিত? আইনে কোথাও কিন্তু লেখা নেই যে আপনি বসার জায়গাটা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য। বা না-হলে আপনার হাজতবাস বা জরিমানা হবে। তবে যাঁর পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর, তাঁকে বসতে দেওয়া একজন মানবিক চেতনাসম্পন্ন, সভ্য, ভদ্র নাগরিক হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর সেটা না-করলে মূল্যবোধ বজায় রাখার, মানবিক সম্পর্ক তৈরির ও সামাজিক ন্যায়-নীতি বোধের অলিখিত শর্ত ভাঙবেন আপনি। ঠিক যেমন মাঝেমধ্যেই তা ভাঙার অভিযোগ শোনা যায় কিছু ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে। বা আরও পরিষ্কার করে বললে ব্যাঙ্ককর্মী ও সেখানে চালু থাকা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অথচ সামাজিক পরিকাঠামোর এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে আর্থিক লেনদেন বা সঞ্চয়ের এই প্রতিষ্ঠানের উপরও কিছু নৈতিক দায়িত্ব পালনের দায় আপনা-আপনিই বর্তায়।

Advertisement

সমস্যা কোথায়?

Advertisement

আমজনতার জীবনে ব্যাঙ্ক অপরিহার্য। কারণ টাকা-পয়সা বাড়িতে ফেলে রাখা যায় না। ব্যাঙ্কে রাখতেই হয়। আবার গ্রাহক না-থাকলে ব্যাঙ্কের চলে না। কারণ তাঁদের একাংশ ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন। অন্য অংশ সেখান থেকে ঋণ নেন। আর দু’য়ের উপর ভর করেই রমরমা ব্যবসা করে ব্যাঙ্ক। কাজেই দু’পক্ষকেই যেখানে একে অপরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে, সেখানে গ্রাহক হিসেবে সময় মতো যথোপযুক্ত পরিষেবা পাওয়ার অধিকারও আপনার রয়েছে। কিন্তু এই অধিকারের দাবি জানাতে গেলেই অনেক সময়ে গণ্ডগোল বাধে। বহু ক্ষেত্রেই ন্যায্য পাওনা বা পরিষেবা চাইতে গেলে জোটে খারাপ ব্যবহার। তাতে মনে হয় যেন বাড়তি কোনও সুবিধা চাইতে গিয়েছেন আপনি।

যাঁদের জন্য ব্যাঙ্কের অস্তিত্ব, তাঁদের তো একটু বাবা-বাছা করে রাখতেই হবে। কিন্তু বাস্তবে অনেক সময়েই ঘটে উল্টোটা। এ ক্ষেত্রে আইনগত যে-অধিকারগুলি প্রাপ্য, সেগুলি আদায় করার জন্য অবশ্যই আইনের দরজা খোলা থাকে। কিন্তু সেগুলি ছাড়াও এমন কিছু পরিষেবা আছে, আইনি পথে যেগুলির দাবি জানানো যায় না। অথচ তার ব্যবস্থা করা ব্যাঙ্কগুলির নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। সেগুলি গ্রাহকের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা বা তাঁদের সুবিধা দেখার মতোই কিছু কিছু ব্যাপার।

কী কী চাইবেন?

কয়েকটি ব্যাঙ্ক আইনগত নয় অথচ জরুরি, এমন কিছু পরিষেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গ্রাহকরা চান অন্য সকলেও তা অনুসরণ করুক। চলুন, দেখে নেওয়া যাক আমাদের প্রাপ্য কোন কোন পরিষেবা ব্যাঙ্কের নৈতিক দায়িত্বের আওতায় পড়ে—

যে-সব গ্রাহককে দীঘর্র্ক্ষণ ব্যাঙ্কে অপেক্ষা করতে হচ্ছে, তাঁদের জন্য বসার জায়গা রাখা। এ সি না-থাকুক, মাথার উপর পাখা যেন থাকে। বিশেষত প্রবীণ নাগরিকদের জন্য এই বন্দোবস্ত অবশ্যই প্রয়োজন।

আবেদনপত্র লেখা, ফর্ম ভর্তি করা ইত্যাদি কাজের জন্য টেবিলের ব্যবস্থা রাখা।

গ্রাহকের ব্যবহারের জন্য পরিষ্কার শৌচাগার থাকা।

হতেই পারে লিফ্‌টহীন বাড়ির দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় তলে ব্যাঙ্কের শাখা অবস্থিত। সে ক্ষেত্রে বয়স্ক এবং শারীরিক ভাবে অক্ষমদের জন্য সম্ভব হলে এক তলায় কোনও কোনও পরিষেবার ব্যবস্থা রাখা।

অতি বয়স্ক এবং পাকাপাকি ভাবে শয্যাশায়ী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে জরুরি অবস্থায় ব্যাঙ্ক সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে কি না, তা বিবেচনা করে দেখা।

যে-কাজ অল্প সময়ের মধ্যে করে ফেলা সম্ভব, তার জন্য গ্রাহককে যাতে বার বার ব্যাঙ্কে আসতে না-হয় তা নিশ্চিত করা।

কোনও একটি কাজের জন্য যত রকম কাগজ প্রয়োজন তা এক বারে বলে দেওয়া, যাতে একই কাজের জন্য বার বার ব্যাঙ্কে না-আসতে হয়।

দৃষ্টিহীন, শারীরিক ভাবে অক্ষম এবং বেশি বয়সের কারণে যাঁদের সই না-মেলার সম্ভাবনা থাকে, তাঁদের সহায়তা করা।

সব শ্রেণির গ্রাহকের সঙ্গেই ভাল ব্যবহার করা। ‘মে আই হেল্প ইউ’ কাউন্টারে যেন এমন মানুষ বসেন, যাঁর সত্যিকারের সহায়তা করার মানসিকতা আছে। বেশির ভাগ ব্যাঙ্কেই সুদের হার এবং অন্যান্য শর্ত কম-বেশি একই রকম। প্রতিযোগিতার বাজারে ব্যবসা বাড়াতে হবে ভাল পরিবেশ এবং ভাল ব্যবহার দিয়ে।

সকলেরই প্রাপ্য

এমন বহু পরিষেবা আছে, যেগুলি গ্রাহক হিসেবে সকলেরই প্রাপ্য। ব্যাঙ্ক আলাদা হলেও গ্রাহকের স্বার্থে এই পরিষেবাগুলি একই রকম হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায় না। ফলে অনেক অসুবিধা মুখ বুজে মেনে নেওয়া ছাড়া তাঁদের কোনও উপায় থাকে না। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি ব্যাঙ্কের উপর যেমন নির্ভর করেন, তেমন ব্যাঙ্কও আপনার উপর। নিজের দাবি জানানোর অধিকার আপনার আছে। কী সেই সব পরিষেবা? জেনে নিন—

পাসবই এবং ব্যাঙ্ক স্টেমেন্টে অনেক সময়েই টাকা কোন সূত্রে এল তার তথ্য লেখা হয় না। বোঝা যায় না কোনটা সুদ আর কোনটা ডিভিডেন্ড। এ ক্ষেত্রে একটি করযোগ্য অন্যটি নয়। পুরো তথ্য না-থাকার কারণে আয়কর হিসেব করা শক্ত হতে পারে। ‘বাই ক্লিয়ারিং’ না-লিখে খুব ছোট করে তথ্য লেখা যেতেই পারে। কোনও কোনও ব্যাঙ্ক লেখেও। এতে বিরাট পরিশ্রম বা খরচ হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের বড় উপকার হয়।

সুদ থেকে কর কাটা হলে তার জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে টি ডি এস সার্টিফিকেট দিতে হয়। কোনও কোনও ব্যাঙ্ক বছর শেষ হওয়ার পরেও এই সার্টিফিকেট দিতে দেরি করে। এমনকী রিটার্ন জমা করার শেষ তারিখের মধ্যেও অনেকে এই সার্টিফিকেট পান না। ফলে তখন বড়সড় সমস্যায় পড়েন করদাতা গ্রাহকেরা।

পাশাপাশি আবার, দু’বছর টি ডি এস কাটার পর ব্যাঙ্ক একটিমাত্র সার্টিফিকেট দিয়েছে, এমন অভিযোগও পাওয়া গিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এই ব্যাপারে একটু সচেতন হলে ভাল হয়।

কোনও ব্যাপারে ভুলচুক হলে অনেক সময়েই বলা হয় ‘সিস্টেম’ থেকে এটা বেরোচ্ছে, আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু এই উত্তর দেওয়ার আগে ব্যাঙ্ককর্মীদের ভাবা উচিত, ওই ব্যবস্থা মানে ‘সিস্টেম’টা তো ব্যাঙ্কেরই নিজস্ব। সে জন্য গ্রাহক ভুগবেন কেন?

টাকা বা চেক জমা করা হলে প্রাপ্তিস্বীকার রসিদ দেওয়া হয়। এতে যে- রাবার স্ট্যাম্প মারা হল অনেক সময়ে তা বহু ব্যবহারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ফলে সেই স্ট্যাম্পের কিছুই ভাল করে পড়া যায় না। এতেও অসুবিধায় পড়তে পারেন গ্রাহকেরা। এই ছোট ব্যাপারটাও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে।

অ্যাকাউন্ট নম্বর তো বটেই, কোনও কোনও ব্যাঙ্ক গ্রাহকের নামও ছেপে দেয় চেক বইয়ের প্রতিটি পাতায়। কিন্তু এই বিষয়টি খেয়াল রাখে না সব ব্যাঙ্ক। এমনও ব্যাঙ্ক আছে, যারা নাম দূর অস্ত্‌, অ্যাকাউন্ট নম্বরও বসিয়ে দেয় না। দায়িত্ব ছাড়া হয় গ্রাহকের হাতে। গ্রাহক অ্যাকাউন্ট নম্বর লিখতে ভুলে গেলে অথবা ভুল লিখলে সমস্যা হতে পারে। গ্রাহকের এইটুকু স্বার্থ রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের এ ব্যাপারে নজর দেওয়া উচিত।

শেষে একটা কথা বলে রাখি। গ্রাহকদের অধিকার সম্পর্কে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্প্রতি একটি খসড়া তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে এটিকে পরে একটি নির্দেশ আকারে জারি করা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই প্রয়াস থেকে বোঝা যায় শীর্ষ ব্যাঙ্ক কতটা গুরুত্ব সহকারে ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের অধিকারের ব্যাপারটি দেখছে। এ বার দেখা যাক কত তাড়াতাড়ি সবক’টি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের নৈতিক অধিকার পূরণের এই দায় কাঁধে নিতে পারে।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন