A Special Article Of Tamal Kanti Mukhyopadhyay On Mother Teresa

ও আলোর পথযাত্রী...

ইংরিজি ‘সেন্ট’ শব্দটার সঙ্গে বাংলা ‘সন্ত’ শব্দটি যে একেবারে খাপে-খাপে মিলে যায়, এমনটা নয়। দুইয়ের মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। অর্থের পার্থক্য। ‘বোধ’-এর পার্থক্য। ভাবের পার্থক্য। এবং ভাবনার পার্থক্য। তবু...। লিখছেন তমালকান্তি মুখোপাধ্যায়

Advertisement

তমালকান্তি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ২০:৪৫
Share:

মাদার অ্যাগনেস টেরিজা সেন্ট হচ্ছেন।

Advertisement

মাদার অ্যাগনেস টেরিজা সন্ত হচ্ছেন।

ইংরিজি ‘সেন্ট’ শব্দটার সঙ্গে বাংলা ‘সন্ত’ শব্দটি যে একেবারে খাপে-খাপে মিলে যায়, এমনটা নয়। দুইয়ের মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। অর্থের পার্থক্য। ‘বোধ’-এর পার্থক্য। ভাবের পার্থক্য। এবং ভাবনার পার্থক্য। তবু...। তবু মাদারের সান্নিধ্যে, আমার দেশের সন্তাপগ্রস্ত মানুষের জুড়িয়ে যাওয়া প্রাণ, যেন সমস্ত পার্থক্যকে অতিক্রম করে, দুই শব্দকে প্রায় সমার্থক করে তুলেছে। তিনি সর্ব অর্থেই আদ্যোপান্ত সন্ত।

Advertisement

আরও খবর- মানবতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন মাদার

প্রায় চার দশক আগের কথা। ১৯৭৮। সবে প্র্যাকটিস শুরু করেছি। ক্রিমিনাল ল-ইয়ার। কিছু দিনের মধ্যে আচম্বিতে ঘটল একটা ঘটনা। আমার উদ্দাম উদাত্ত যৌবন এক পাহাড়ি ঝোরার রোম্যান্টিসিজমের মুখোমুখি হল— মাদার টেরিজা। সেখানে প্রকাণ্ড ঝর্নার প্রকাণ্ড শব্দ নেই। নৈঃশব্দের পথ ধরেই যে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায়।

মাদার নিঃশব্দে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আজীবন। যদিও, ট্যাজেডি এখানেই যে— মাদার না চাইলেও এক ভীষণরকম প্রচার ওই নৈঃশব্দে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, প্রচারের আধিক্যে মাদার সম্বন্ধে অনেকের অহেতুক বীতরাগও তৈরি করেছিল। আর এই ‘অহেতুক’ ব্যাপারটা মাদারের অন্ত্যেষ্টির সময়ে দুঃখজনক ভাবে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল।

আরও খবর- মাদার টেরিজা ঈশ্বরের এক প্রিয় মানুষ

মাদার কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন প্রচারের বাইরে থাকতে। পারেননি। হয়তো বা আমাদেরই জন্য। তবু একের পর এক হোম, একের পর এক শিশু, একের পর এক শৈশব মাদারের নিঃশব্দ উপস্থিতিতে শব্দ খুঁজে পেয়েছিল হারিয়ে যাওয়া জীবন থেকে। ‘হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে’ জল চেটে নেওয়া কুষ্ঠরোগী মাদারের রৌদ্রকরোজ্জ্বল উপস্থিতিতে অন্ধকার জীবনে আলো খুঁজে পেয়েছিল।

আরও খবর- আস্তাকুঁড় থেকে ককপিটে মাদারের শিশু

এমনিতে আলবেনিয়া থেকে কলকাতার দূরত্ব খুব একটা কম নয়। কিন্তু এক অভূতপূর্ব কোয়েন্সিডেন্সের মধ্য দিয়ে এই অপার অসীম দূরত্ব যেন পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে পরিণত হয়েছিল এক দিন। যে দিন মাদার সাত সমুদ্র পেরিয়ে চলে এসেছিলেন এ দেশে।

অ্যাগনেসের বয়স তখন আট বছর। আচমকা অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন বাবা। আর জীবনের এই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে আরও গভীর স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল মেয়ে। বলতে গেলে সেই সময় থেকেই চ্যারিটিকে জাপটে ধরে বাঁচার ও বাঁচানোর পথ খুঁজে পেল ছোট্ট অ্যাগনেস। ওই একরত্তি মেয়ের প্রসঙ্গে মায়ের সগর্ব উক্তি ছিল— ‘‘আমার মেয়ে একটা দানাও মুখে তুলবে না, যদি না তুমি অন্যের সঙ্গে শেয়ার কর।’’ কার সঙ্গে শেয়ার করবে সে? মায়ের উত্তর, ‘‘যাদের কেউ কেউ আমাদের আত্মীয়, আর যাদের সব্বাই আমাদেরই আশপাশের কেউ না কেউ।’’

আরও খবর- ‘মেমোরিজ অব মাদার টেরিজা’

১৯৩১ সালে যখন সন্ন্যাসিনী হয়ে দার্জিলিংয়ে এলেন অ্যাগনেস, তখন সেই মেয়ে কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তীর্ণ। নাম সিস্টার মেরি টেরিজা। আর তার পর কলকাতায়— সেই মেরি হাইস্কুলের শিক্ষিকা। অন্যের মাতৃভাষাকে মর্যাদা না দিলে নিজের মাতৃভাষাকেই যে আদতে অপমান করা হয়— এই বোধের জায়গা থেকে তিনি একে একে শিখে নিলেন বাংলা আর হিন্দি। আর লোরেটোর বাকি শিক্ষিকা সন্ন্যাসিনীদের ধাঁচেই খানিক বদলে গেল তাঁর নাম— মাদার টেরিজা।

’৭৮ সালে প্রথম বার মাদারের হাত স্পর্শ করে মনে হয়েছিল, ঈশ্বর আর কোথাও নেই। আছে শুধু এই স্পর্শে। আর তার পর? তার পর আমাকে ব্যাপটাইজড হতে হয়নি। আমাকে সন্ন্যাসী হতে হয়নি। আমাকে খ্রিস্টান হতে হয়নি। আমাকে শুধু মানুষ হতে হয়েছিল— চার পাশের জরা, ব্যাধি আর অনাথ শৈশবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

আরও খবর- কলকাতায় মাদারের এক্সক্লুসিভ ছবি

মাদারের এই প্রবলতর স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে আজ মনে হয়— কিছু কি করতে পেরেছি জীবনে? বোধহয় না।

তবে কিছু চেষ্টা আর কিছু প্রচেষ্টা আমার শিকড় ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে গেছে মাঝেমধ্যে। ’৮০-র দশকের শেষের দিক। ’৯০-এর দশকের গোড়ার দিক। কলকাতা (তখন ক্যালকাটা) হাইকোর্টে চলছে এক জনস্বার্থ মামলা। মহামান্য বিচারপতি দিলীপ বসু ও গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ। মামলার বিষয়: দীর্ঘ দিন ধরে জেলের অন্ধকারে রয়েছেন প্রায় ৬০০ জন ভিক্টিম গার্ল। ‘ভিকটিমাইজড’ হওয়ার পর তাঁদের ‘সেফ কাস্টডি’তে নিয়েছে রাষ্ট্র। আর ভয়ানক প্যারাডক্সিক্যালি সেই কাস্টডির ঠিকানা হল জেলখানা। কারণ, তাঁদের অন্যত্র নিরাপদে রাখার কোনও ব্যবস্থা নেই।

আরও খবর- শান্ত, সমাহিত মাদার হাউস মগ্ন দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে

এঁদের বার করে আনতে হবে। তাই জনস্বার্থ মামলা চলল। খানিক দূর এগনোর পর এক দিন মহামান্য আদালতে বললাম, আপনারা অনুমতি দিলে ওঁদের পুনর্বাসনের জন্য মাদারকে অনুরোধ করব। কোর্ট রাজি হয়ে গেল। আর সেই কোর্ট ডিরেকশন সঙ্গে নিয়ে আমি একছুট্টে চলে গেলাম মাদারের কাছে। মাদার তো শুনেই এক্সাইটেড। কী সাঙ্ঘাতিক খুশির হাসি সে দিন দেখেছিলাম মাদারের মুখে। তা আজও ভুলতে পারিনি।

আরও খবর- ফিরে দেখা: মাদারের মহাপ্রয়াণ

সেই থেকে শুরু হল মাদারের সঙ্গে আমার সেকেন্ড ইনিংস। কোর্টের নিযুক্ত স্পেশাল অফিসার হিসেবে মাদারের সঙ্গে গেলাম প্রেসিডেন্সি জেলে। শুরু হল মাদারের জেল ভিজিট। আমরা দেখলাম, বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা আর সমাজব্যবস্থার পাঁকগ্রস্ততার মধ্যে কী ভাবে ২৫ বছর ধরে অন্ধকার জীবন কাটাচ্ছেন এঁরা।

এই অন্ধকার থেকে মাদার খানিক আলোর দিকে আর খানিক আলিপুরের দিকে যাতায়াত শুরু করলেন।

আরও খবর- বিপন্ন বিস্ময়

এই মহিলাদের মধ্যে ‘নন ক্রিমিন্যাল লুনাটিক’-এর সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। যদিও ‘পাগল বাড়ি’র চিৎকার তখনও মেনস্ট্রিম সমাজকে এতটুকু ডিসটার্ব করতে পারেনি— সৌভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে। ‘ভিকটিম গার্ল’ই হোক কি ‘নন ক্রিমিন্যাল লুনাটিক’— বড় অদ্ভূত আচরণ করেছিল সমাজ এঁদের সঙ্গে। যেমন ধরা যাক, বেগুসরাইয়ের এক অজগাঁয়ের অর্চনা সাউয়ের কথা। জুটমিলে কাজ করা স্বামীর খোঁজে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। হাওড়া স্টেশনে বিনা টিকিটের যাত্রী সন্দেহে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন এই যুবতী। তার পর এ হাত, সে হাত, ও হাত ঘুরে ‘নন ক্রিমিন্যাল লুনাটিক’ তকমা নিয়ে প্রেসি়ডেন্সি জেলে ঠাঁই হয়েছিল তাঁর। আর তারও পর, বছরের পর বছর জেলের মধ্যে কাটিয়ে জীবনে থেকেও জীবন থেকে হারিয়ে যান তিনি। জেলখানার অন্ধকার এক রকম। আর তার বাইরের অন্ধকার আর এক রকম। ‘ভিকটিম গার্ল’রা জেল থেকে বেরিয়ে আরও গভীর কোনও অন্ধকারের শিকার হবেন না তো?

লেখকের সঙ্গে মাদার।

অতএব, ২৫ বছর ধরে জেলে থাকা এই মহিলাদের মুক্ত করা যত না কঠিন ছিল তার চেয়ে ঢের কঠিন ছিল তাঁদের নিরাপদ পুনর্বাসন। যাঁদের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন কোথায় আছে বা আদৌ আছে কি না তা বের করা এককথায় অসম্ভব ছিল। অতএব, পুনর্বাসনের উপরেই নির্ভর করছিল এই মামলার ভবিষ্যৎ। মাদার এগিয়ে এলেন আর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হল এই মামলার মহিলা বন্দিদের। আলিপুরের আকাশ সে দিন যেন এক অভূতপূর্ব পূর্বাভাস দিয়েছিল। শুধু মহিলারাই নন, পুরুষ বন্দিও ছিলেন এঁদের মধ্যে।

মাদার মানুষটা আদতে কেমন ছিলেন? এক বার আমাদের বাবুবাগানে পুজো উদ্বোধনের জন্য আবদার করলাম তাঁর কাছে। যদিও এত দিন তিনি কোথাও দুর্গাপুজো উদ্বোধনে যাননি। আমার আবদার শুনে তিনি বললেন, ‘‘কত দেবে?’’ আমি উত্তর দিলাম, ‘২৫,০০০ টাকা’। দু’তরফেই তখন ছেলেমানুষি হাসি। মিশনারিজ অব চ্যারিটির টাকা শুধু যে কর্পোরেট ব্যবসায়ী মহল থেকে আসত না, তা বোঝাতে এই ২৫,০০০ টাকা আর বাবুবাগানই যথেষ্ট।

মাদারের বিরুদ্ধে বড় একটা অভিযোগ ছিল, তিনি ধরে ধরে ধর্মান্তরিত করতেন সবাইকে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি মাদার এ সবের ধারপাশ দিয়েই যেতেন না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি হিন্দুদের হিন্দু মতে বিয়ে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে, হিন্দু-মুসলিম বা কোনও ধর্মের সেন্টিমেন্টকে তিনি আঘাত করেননি। বরং মর্যাদা দিয়েছেন, সম্মান করেছেন।

মাদারের প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললেই নয়। তা হল মাদারের কাছে কোটিপতি শিল্পপতি ডোনারও যে মর্যাদা পেতেন, আমার মতো লোয়ার কোর্টে স্ট্রাগল চালিয়ে যাওয়া তরুণ আইনজীবীও সেই একই মর্যাদা পেত। সেই সময়ের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে আজ। এক বার পা ভেঙে বসে রইলাম বাড়িতে। খবর পেলেন মাদার। তার পর চার জন সিস্টারকে পাঠালেন বাড়িতে আমাকে দেখতে। এখনও মনে পড়ে, সিস্টার শান্তি, সিস্টার মণিকা, সিস্টার জুবিতারা এসেছিলেন আমাকে দেখতে।

মাদারের বিভিন্ন আশ্রমে বিভিন্ন সময়ে গিয়েছি। এখনও যাই, যাওয়ার চেষ্টা করি। আশ্রমগুলোর নাম আর করছি না। ‘নির্মল হৃদয়’ থেকে এক দিন মিশে গিয়েছিল বাংলার হৃদয়ে। বলতে গেলে সেগুলো এক সময়ে আমাদের ঘর-বাড়ি হয়ে গিয়েছিল।

আমরা যারা মাদারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে, নিজেদের বলতাম ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’র কো-ওয়ার্কার। আর, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে অনুভব করেছিলাম মাদারের কো-ওয়ার্কার হওয়ার প্রকৃত অর্থ কী।

মাদার বেঁচে থাকতেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর জন্মদিন পালন করতে শুরু করেছিলাম। মাদার কিছুতেই রাজি হবেন না। আর আমরাও ছাড়ব না। দু’পক্ষের লড়াইতে আমরা জিতেছিলাম। এর অল্প দিনের মধ্যেই মাদার চলে গেলেন চিরকালের জন্য।

‘ক্ষণকাল’। মাদার চলে যাওয়ার পর, আমরা ওই ‘ক্ষণকাল’কে অতিক্রম করে, নিয়ম করে প্রতি বছর পালন করে আসছি ওঁর জন্মদিন। তাতে যদি উনি বিরক্ত হন— আকাশ থেকে, হোন। আমাদের কিছু করার নেই। নতুন করে তাঁকে বোঝানোর দায় নেই যে, ওঁর জন্মদিনে শুধু সেলিব্রিটিরা এসে গেয়ে যান কৃতজ্ঞচিত্তে এমনটা নয়। ওঁর জন্মদিনে এখনও অনেক ব্যথিত হৃদয়, ‘নির্মল হৃদয়’-এর পানে চেয়ে থাকে। আর আমাদের সমস্ত হৃদয় মাদারকে খুঁজে পায় তাঁর পরবর্তী হৃদয়ের মাঝে। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।

আরও খবর- বিপন্ন বিস্ময়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন